দিনটি ছিল গেল বছরের ৪ আগস্ট। তখন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে উত্তাল সারাদেশ। বৈষম্যহীন নতুন বাংলাদেশ দেখার স্বপ্নে বিকেলে ঢাকার বাইপালের আশুলিয়ায় বন্ধুদের সঙ্গে আন্দোলনে রাস্তায় নেমেছিলেন পোশাক কারখানার শ্রমিক নাঈম বাবু (১৮)। সেদিনের একটি বুলেট কেড়ে নেয় তাঁর প্রাণ। সেইসঙ্গে ভেঙে যায় পরিবারের সকল স্বপ্ন।
পরিবারের পরিকল্পনা ছিল কিছুটা সচ্ছলতা ফিরলেই নাঈমকে বিয়ে দেওয়ার। এরপর সেলাই মেশিন কিনে বাড়ির কাছে স্থায়ী একটি সেলাইয়ের (দর্জি) দোকান দেওয়ার। সে আয়ে পরিবারে ফিরবে সচ্ছলতা। এ জন্য জমিয়েছিলেন ২৬ হাজার টাকা। সে টাকায় পালনের জন্য কিনেছিলেন একটি গরু। আর কিছুটা টাকা জমলেই লক্ষ্য অর্জনের দিকে এগোবেন তিনি।
এ জন্য সময় নিয়েছিলেন এক বছর। কিন্তু একটি বুলেটের আঘাতে সব স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে পরিবারটির।
নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলার রণচ-ী ইউনিয়নের সোনাকুড়ি গ্রামে শহিদ নাঈম বাবুর বাড়ি। আশুলিয়ার একটি পোশাক কারখানায় কর্মরত ছিলেন তিনি। ছোটবেলা থেকে বেড়ে ওঠা মামা আনিছুর রহমান (৪০) ও মামি রোখসানা বেগমের (৩৫) পরিবারে।
গত ৪ আগস্ট পোশাক কারখানার ছুটির পর বিকেলে কয়েক বন্ধু মিলে বৈষম্যবিরোধী মিছিলে অংশ নেন নাঈম বাবু। এরপর পেটে গুলি লাগলে তাকে আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৫ আগস্ট দিবাগত রাত দুইটার দিকে তার মৃত্যু হয়। ৬ আগস্ট বেলা ১১টার দিকে বাড়িতে তার মরদেহ এসে পৌঁছালে আসরের নামাজের পর পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।
তাঁর মামি রোখসানা বেগম জানান, ছয় বছর বয়সে মারা যায় নাঈমের বাবা মো. মোস্তফা। এর দুই বছর পর মা হাছনা বানুর অন্যত্র বিয়ে হয়। এক বোন তিন ভাইয়ের মধ্যে নাঈম সবার ছোট। বড়বোন নাজমিনের (২৮) বিয়ে হয়েছে তার বাবার মৃত্যুর আগে। জীবিকার তাগিদে বড়ভাই নাজমুল ইসলাম (২৪) চট্টগ্রামে এবং মেজোভাই আব্দুল হাকিম থাকেন ঢাকায়।
জন্মের পরেই নাঈমকে নিয়ে তাঁর বাবা মা-সহ আসেন এখানে। এরপর ছোট নাইমকে মামির কাছে রেখে জীবিকার তাগিদে ঢাকায় চলে যান তারা (বাবা-মা)। নাঈমের ছয় বছর বয়সে তাঁর বাবার মৃত্যু হয়। এর দুই বছর পর মা হাছনা বানুকে অন্যত্র বিয়ে দেয় পরিবার। পরের সংসারে তাঁর মায়ের চার বছরের এক কন্যা সন্তান রয়েছে।
মামি রোখসানা বেগম বলেন, ‘জন্মের পর থেকে আমি তাকে লালন পালন করেছি সন্তানের মত করে। আমার দুই সন্তানের সঙ্গে তাকে আমি বড় সন্তান মনে করতাম। সেও ধরে নিয়েছিল এটিই তার পরিবার। আমাদের মামা-মামি ডাকলেও বাবা-মায়ের মতই মনে করতো। আমার দুই সন্তানকেও নিজের ছোট ভাই মনে করে দেখাশোনা করতো। তার ইচ্ছা ছিল বড় হয়ে আয় রোজগার করে দুই ছোটভাইকে লেখাপড়া শিখিয়ে অনেক বড় করবে। কিন্তু সে সাধ আর পূরণ হলো না তার।’
গ্রামের একটি হাফেজিয়া মাদ্রাসায় মাহতামিম হিসেবে কাজ করেন নাঈমের মামা। মামি বাড়িতে কাজ করেন দর্জির। তাদের সামান্য আয়ে অনেক অভাব অনটনে চলতো সংসার।
এমন কষ্টের সংসারে নাঈম লেখাপড়া করেছেন চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত। পরে একটি মাদ্রাসায় কোরআন হেফজ করেন ১৫ পারা। শেষে সংসারের অভাব দূর করতেই ঢাকায় পোশাক কারখানায় কাজ নিয়েছিলেন তিনি।
মামা আনিছুর রহমান জানান, এক বছর পর বাড়িতে নতুন একটা ঘর তুলে বিয়ে দেওয়ার কথা ছিল নাঈমের। এরপর সেলাই মেশিন কিনে বাড়ির কাছে তার মামিসহ একটি দর্জির (সেলাই) দোকান দেওয়ার কথা ছিল। এ জন্য নাঈম টাকা জোগাড় করতে ঢাকায় যায়। সেখানে প্রতিমাসে যে আয় হতো নিজের খরচের পর কিছুটা সঞ্চয় এবং কিছু টাকা মামা-মামির খরচের জন্য পাঠিয়ে দিত। তার সঞ্চয়ের টাকায় বাড়িতে পালনের জন্য ২৬ হাজার টাকায় একটি গরু কেনা হয়। আরকিছু টাকা জমলেই বাড়িতে চলে আসার কথা ছিল নাঈমের। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে একটি বুলেটের আঘাত সব তছনছ করে দিয়েছে। সবাইকে কাঁদিয়ে বিদায় নিয়েছে নাঈম।
তিনি বলেন, ‘আন্দোলন চলাকালে তাকে নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলাম আমি। এ জন্য সেদিন (৪ আগস্ট) দুপুরে ফোন করেছিলাম। সে বলেছিল মামা ব্যস্ত আছি। সন্ধ্যায় তোমাকে ফোন দেব। সে ফোনের অপেক্ষায় থেকে শেষ পর্যন্ত গুলিতে আহত হওয়ার খবর পাই।’
জীবিত আছেন নাঈমের নানী আবেদা খাতুন (৬০)। নানা তছকিন আলী মারা গেছেন দেড় বছর আগে। আদরের নাতিকে নিয়ে ছিল অনেক স্বপ্ন। কিন্তু সে স্বপ্ন পূরণের আগে নাতিকে হারানোর শোক যেন বইতে পারেছেন না নানী আবেদা খাতুন। নাতির কথা স্মরণ করলেই ভারি হয়ে ওঠে তাঁর কণ্ঠ। এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলার সময় ঘটেছিল তেমনটাই।
তিনি বলেন, ‘ওর (নাতি) নানাতো চলি গেইল। মুই (আমি) আশা করিছিনু নাতির সুখ দেখি তার পরোত মরিম। এলা মোর আগোত নাতি দুনিয়া ছাড়ি গেইল’।
পারিবারিক সূত্র জানায়, জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী অফিসারের দপ্তর এবং একটি রাজনৈতিক দলের পক্ষে কিছু অর্থনৈতিক সহযোগিতা করা হয়েছে পরিবারকে। নাঈমের চিকিৎসার সময়ে হওয়া বিভিন্ন ধারদেনা পরিশোধ করতে হচ্ছে এখন পরিবারটিকে।