বৃহস্পতিবার, ১৬ জানুয়ারী ২০২৫, ০৩:৩১ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম ::
শূরা বৈঠক ডেকে আজাদী বাজার মাদ্রাসায় ডুকতেই পারেননি হেফাজত আমীর ধনবাড়ীতে ছেলে মেয়েদের আত্মরক্ষার কৌশল শেখাতে মার্শাল আর্ট প্রশিক্ষণ স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসাকে সরকারী করণের দাবিতে স্মারকলিপি প্রদান বেনাপোল বিজিবি ও বিএসএফ সেক্টর কমান্ডার পর্যায়ে সীমান্ত সমন্বয় সভা কাপাসিয়ায় তারুণ্যের উৎসব টিউলিপের পদ্যতাগ : এবার তোপের মুখে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কতিপয় ব্যক্তির অনৈতিক সুবিধা গ্রহণের কারণে ধুঁকছে বনফুল আদিবাসী গ্রীনহার্ট কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম সংস্কার প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই নির্বাচন: প্রধান উপদেষ্টা মেয়াদ বাড়লো ৬ কমিশনের, ফেব্রুয়ারির শুরুতে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা কিশোরগঞ্জে আবদুল হামিদের বিরুদ্ধে মামলা

কতিপয় ব্যক্তির অনৈতিক সুবিধা গ্রহণের কারণে ধুঁকছে বনফুল আদিবাসী গ্রীনহার্ট কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় বুধবার, ১৫ জানুয়ারী, ২০২৫

রাজধানী ঢাকার বুকে শিক্ষার্থীদের কাছে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত একটি সুপরিচিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম ‘বনফুল আদিবাসী গ্রীনহার্ট কলেজ’। ‘বনফুল আদিবাসী ফাউন্ডেশন ট্রাস্ট’ দ্বারা পরিচালিত হলেও কলেজটি শিক্ষামন্ত্রণালয় ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের সকল নিয়ম কানুন মেনে চলতে অঙ্গীকারাবদ্ধ থেকেই সুনামের সাথে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিলো। পরিতাপের বিষয় হলো ঐতিহ্যবাহী কলেজটি আজ ধুঁকছে এর পরিচালনার সাথে জড়িত কয়েকজন শীর্ষ ব্যক্তির অনৈতিক সুযোগ সুবিধা গ্রহণের কারণে। নানা রকম ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শিক্ষার্থীদেরকে। কোন প্রকার কর্ম সম্পৃত্ততায় না থেকেও শুধুমাত্র ট্রাস্টের সদস্য হওয়ার অজুহাতে কলেজের আয় থেকে কয়েকজন ট্রাস্টির অনৈতিক সুবিধা গ্রহণ এবং ফলশ্রুতিতে ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানটির দুরবস্থা নিয়ে আজকের এই প্রতিবেদন: তৃপ্তি (ছদ্মনাম) একজন শিক্ষক, বিগত ১৬ বছর ধরে ঢাকার বনফুল আদিবাসী গ্রীনহার্ট কলেজে কর্মরত আছেন। এ সময়ে তার জীবন ব্যয় বৃদ্ধি পেলেও বর্তমানে ১৬ বছর চাকরি করার পর তার বেতন শুধুমাত্র ২১,০০০ টাকা। তৃপ্তি বনফুল আদিবাসী গ্রীনহার্ট কলেজে শিক্ষকতা শুরু করার পর থেকে বাংলাদেশে টাকার ৭৩.১৭ শতাংশেরও বেশি অবমূল্যায়ন হয়েছে। ¯œাতক সম্পন্ন করার পরে অনেক স্বপ্ন নিয়ে তিনি শিক্ষকতা শুরু করেছিলেন কিন্তু এই ক’বছরে বিভিন্ন কারণে তার স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে। তৃপ্তির স্কুলগামী সন্তান বর্তমানে তার বাবার সাথে ঢাকার বাইরের একটি জেলায় তার থেকে অনেক দূরে থাকেন কারণ তার পরিবারের পক্ষে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় একসাথে বসবাস করার সামর্থ্য নেই। বিগত কয়েক বছর অর্থনীতির চড়াই-উৎরাই এর মধ্যে এই পরিবারটি ভয়াবহ দুঃসহ অবস্থা পার করেছে।
তৃপ্তি বলেন ‘এখন আমি দুই রুমের একটি ফ্লাটে ভাড়া থাকি যার জন্য প্রতি মাসে ১৬,০০০ টাকা দিতে হয়, তার মধ্যে একটি রুম সাবলেট দিতে হয়েছে। দেশের অর্থনৈতিক ছন্দপতনের পাশাপাশি তৃপ্তির জীবনকে সবচেয়ে হতাশায় ফেলেছে তা হলো বিশ্বাস ভঙ্গ। তার প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ ব্যক্তিদের ক্ষমতার অপব্যবহার, কাজ না করেও সম্মানীর নামে বড় অংকের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে এসব অসাধুরা যার ফলে একজন শিক্ষক হিসেবে তার যে ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার কথা ছিল তা তিনি পাননি। বনফুল আদিবাসী ফাউন্ডেশন ট্রাস্ট এর অংশ হিসেবে ২০০৪ সালে বনফুল আদিবাসী গ্রীনহার্ট কলেজটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে কলেজের চেয়ারম্যান হিসেবে একজন বৌদ্ধ ভিক্ষু ভেন. প্রজ্ঞানন্দ মহাথেরো সার্বক্ষণিক স্কুলের যাবতীয় বিষয়াদি দেখভাল করে আসছেন। তিনি ছাড়াও প্রসেনজিৎ চাকমা, রিয়েল দেওয়ান, ধনমনি চাকমা, প্রীতিময় চাকমা ও কামনা দেওয়ান ট্রাস্টি হিসেবে যুক্ত আছেন। কলেজের বেশ কিছু বিশ^স্ত সূত্রের বরাত দিয়ে জানা গেছে কলেজের চেয়ারম্যান প্রজ্ঞানন্দ মহাথেরো ও হোস্টেল পরিচালক প্রীতিময় চাকমা বাদে অন্য ট্রাস্টিরা কলেজের জন্য কোন কাজ না করেই কলেজের একজন সেরা বেতনভুক্ত শিক্ষকের আয়ের চেয়ে
অনে বেশি বেতন নেন। আরো জানা যায়, চারজন ট্রাস্টি সম্মানির নাম করে মোটা অংকের বেতন নেন যা ২০১৬ সাল থেকে আজ পর্যন্ত বেড়েছে বহু গুণ। গত এক দশকে কলেজের ট্রাস্টি এবং বাংলা ও ইংরেজি ভার্সনের শিক্ষকদের বেতন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে যে, চারজন ট্রাস্টি প্রসেনজিৎ চাকমা, রিয়েল দেওয়ান, ধনমনি চাকমা, কামনা দেওয়ান প্রত্যেকের প্রাপ্ত বেতন দীর্ঘ এক দশকের বেশি সময় ধরে কাজ করা একজন সেরা শিক্ষকের বেতনের চেয়ে দ্বিগুন বেশি। আরো দেখা গেছে চারজন ট্রাস্টির মধ্যে একটি দম্পতিও রয়েছেন। ট্রািস্ট বোর্ডের সভাপতি প্রজ্ঞানন্দ মহাথেরো এই প্রসঙ্গে বলেন, ‘ট্রাস্টিরা কলেজে আসেন না এবং কোনো কাজই করেন না। ২০১৪ সালে প্রধান ট্রাস্টি প্রজ্ঞানন্দ মহাথেরো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সফরে থাকাকালীন চারজন ট্রাস্টি নিজেরাই নিজেদের পদ সৃজন করেছিলেন। তিনি ফিরে এসে অবাক হয়ে দেখেন যে তার সহকর্মীরা আলাদা আলাদা দায়িত্ব বন্টন করে নিয়েছেন এবং সেজন্য তাদের বেতনও নির্ধারণ করেছেন। তাদের মধ্যে একজন ট্রাস্ট ম্যানেজমেন্টের ভূমিকা নিয়েছিলেন, একজন হয়েছিলেন অর্থ ও নিয়োাগ পরিচালক, একজন উন্নয়ন এবং পরবর্তীতে একজন মহিলা কল্যাণ ব্যবস্থাপক হয়েছিলেন। এ পর্যন্তই, বাস্তবে তারা কোন কাজেই যুক্ত নন।
প্রজ্ঞানন্দ উল্লেখ করেন, দলিল অনুসারে ‘বনফুল আদিবাসী ফাউন্ডেশন ট্রাস্ট’ একটি অলাভজনক, অরাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হওয়ার কথা। তবে, ট্রাস্টের জন্য কোনো কাজ বা দায়িত্ব পালন করলে ট্রাস্টিদের সম্মানী গ্রহণের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। ১৮৮২ সালের ট্রাস্ট আইনে বলা আছে, একজনের সুবিধার জন্য অন্যজনের ক্ষতি করে ট্রাস্টিদের ট্রাস্ট অব্যাহত রাখা উচিত নয়। ট্রাস্টিরা ট্রাস্টের উদ্দেশ্য পূরণ করতে বাধ্য, আইনে বলা আছে ট্রাস্টির উপর আরোপিত কোনো দায়িত্ব লঙ্ঘনকে ‘বিশ্বাসের লঙ্ঘন’ বলা হয়। বিশ্বাস ভঙ্গের কারণে ট্রাস্ট বাতিল হতে পারে যা ট্রাস্ট আইনে স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের জনৈক আইনজীবী বলেন ট্রাস্টের ধারণাটি এর নামের মধ্যে সম্পূর্ণরূপে প্রতিফলিত হয়েছে যেখানে ট্রাস্টিরা অন্যের কল্যাণের জন্য আস্থা ও সততার সাথে কাজ করবেন এবং বিশ্বাস রক্ষা করে চলবেন। আইনগতভাবে ট্রাস্ট তার ট্রাস্টিদের অর্থ নিতে বাধা দেয় না তবে এটি একজন ট্রাস্টি হিসাবে বড় অঙ্কের অর্থ নেওয়ার চেতনার বিরুদ্ধে, তিনি বলেন। তিনি আরো বলেন, কোনো ধরনের কাজ না করে বতন পাওয়া বিশ্বের কোনো আইনে যৌক্তিক নয়। তবে ট্রাস্ট মিটিংয়ে যোগদানের জন্য ট্রাস্টিদের কনভেয়েন্স গ্রহণের প্রচলন রয়েছে।
ট্রাস্টের ঋণ পরিশোধ করাও ট্রাস্টিদের একটি দায়িত্ব, এই ক্ষেত্রে সেটাও স্পষ্টভাবে লঙ্ঘন করা হয়েছে। কারণ বর্তমানে কলেজেটি প্রায় ৬০ লক্ষ টাকার দেনায় জর্জরিত। ১৯৭৬ সালে সরকার কর্তৃক পার্বত্য বৌদ্ধ সংঘকে দেওয়া জমিতে ভাড়া নিয়ে কলেজটি পরিচালিত হচ্ছে। তবে জানা গেছে বিগত ৬ বছর ধরে পার্বত্য বৌদ্ধ সংঘকে কোনো ধরনের ভাড়া পরিশোধ করা হয়নি যার মূল্য দাঁড়িয়েছে প্রায় ৬০ লক্ষ টাকা। শুরুর দিকে কলেজ ভবনটির ভাড়া ছিল মাসে ২৫,০০০ টাকা, যা কয়েক বছর ধরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ টাকায়। ৬ বছরের ভাড়া বকেয়া রেখে কলেজটি চলছে, আর চার জন ট্রাস্টি কোনো কাজ না করেই প্রতিমাসে নিয়মিত বড় অংকের সম্মানি গ্রহণ করছে।
ট্রাস্ট সদস্যদের দ্বারা অনৈতিক সুবিধা গ্রহণের দ্বারা সৃষ্ট করুণ অবস্থা ৩৭ জন আদিবাসী আবাসিক শিক্ষার্থীর মধ্যেও ফুটে উঠেছে। কলেজটিতে ১০০ জন আদিবাসী শিক্ষার্থীর আবাসিক সুবিধা থাকলেও বর্তমানে সে সংখ্যা অনেক কমে গেছে। ট্রাস্টের দুরবস্থার কারণে সুবিধাবঞ্চিত আদিবাসী শিক্ষার্থীরা এ সুযোগ গ্রহণ করতে পারছে না এবং তারা শিক্ষালাভের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। হোস্টেলের খাবারের ম্যানুতে সর্বদাই সস্তা পাঙ্গাস বা ফার্মের মুরগির মতো কমদামি আইটেম রাখা হয়। আর মাংসের পরিবর্তে প্রায় সময় ডিম রাখা হয়। দুধের মতো পুষ্টিকর খাবারের কথা শিক্ষার্থীরা কল্পনাও করতে পারে না।
‘আমার সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হল সেরা শিক্ষকরা নিয়মিত কলেজ ছেড়ে চলে যাচ্ছেন,’ আহমেদ হোসেন (ছদ্মনাম) নামে একজন অভিভাবক বলেন। তিনি অরো বলেন, অর্থেকষ্টে দুশ্চিন্তায় থাকা শিক্ষকরা প্রায়ই প্রইভেট টিউশন করাতে বাধ্য হন। সাক্ষাৎ্কার নেওয়া কয়েকজন শিক্ষক স্বীকার করেছেন যে বেতন কম হওয়ার কারণে তাদের প্রতিদিন আলাদা করে প্রাইভেট টিউশন করতে হচ্ছে। এই প্রাইভেট টিউশনের জন্য প্রায়ই শিক্ষকরা শ্রেণিকক্ষে পর্যাপ্ত পাঠদান করান না বলে অভিযোগ রয়েছে। বর্তমানে স্কুল ও কলেজ সেকশন মিলিয়ে মোট ৮৬ জন শিক্ষক রয়েছেন যা একসময় ছিলো ১১৪ জন। এমতাবস্থায় কলেজটির শিক্ষার্থীর সংখ্যাও দিন দিন কমে যাচ্ছে। এ চিত্রই বলে দিচ্ছে কলেজটির শিক্ষার করুণ অবস্থা।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com