আজ ২৭ জানুয়ারি সোমবার দিবাগত রাতে পবিত্র শবে মিরাজ পালিত হবে। মেরাজ কোরআন-হাদিস ও ইজমায়ে উম্মত-এর অকাট্য দলিল দ্বারা প্রমাণিত। এই রাতের গুরুত্ব নিয়ে কোনো মুসলমানের সন্দেহ থাকতে পারে না। তবে, এ ঘটনার পর রাসুল (স.) অনেক বছর সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও শবে মেরাজকেন্দ্রিক কোনো আমলের ব্যাপারে বিশেষ হুকুম দেননি।
শবে মেরাজকে কেন্দ্র করে যেসব বিদআত প্রচলিত
বার্ষিক উদযাপনের দিন হিসেবে শবে মেরাজকে নির্ধারণ করা
এই রাতের আমলকে শবে কদর বা শবে বরাতের মতো মহিমান্বিত ও ফজিলতপূর্ণ মনে করা।
এই তারিখে দিনের বেলা রোজা রাখা।
শবে মেরাজের ইবাদত অন্য রাতের চেয়ে বেশি সওয়াবের ও মর্যাদাপূর্ণ মনে করা।
শবে মেরাজ উপলক্ষে বিশেষ নিয়মে ও বিশেষ নামাজ আছে মনে করা।
এই রাতে মসজিদে-কবরস্থানে জমায়েত হওয়া।
এই রাতে মসজিদ-খানকাহ আলোক-সজ্জা করা।
এই দিনকে গুরুত্ব দিয়ে দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ছুটি ঘোষণা করা।
শবে মেরাজ উপলক্ষে মসজিদে ওয়াজ-মাহফিল, মিলাদ মাহফিল আয়োজন করা।
বিশেষ ফজিলতলাভে মিষ্টি জিলাপি বিতরণসহ ভালো খাবারের আয়োজন করা।
শবে মেরাজ উপলক্ষে উল্লেখিত বিদআত সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়েছে। অথচ নবীজির (স.) কোনো সবল কিংবা দুর্বল হাদিস দ্বারাও এর কোনো একটি প্রমাণিত নয়। মূলত শবে মেরাজ হলো ঐতিহাসিক রাত, শরয়ি রাত নয়। যেমন- বদর যুদ্ধের দিন, মক্কা বিজয়ের দিন, ২৭ রজব ইত্যাদি ঐতিহাসিক দিন আর শবে কদর, শবে বরাত ইত্যাদি হলো শরয়ি রাত। শরয়ি রাতগুলোতে আমলের বিশেষ কদর রয়েছে আল্লাহর কাছে।
শাইখুল ইসলাম মুফতি তাকি উসমানি সাহেব বলেন, বিশেষ পদ্ধতিতে মেরাজের রাত উদযাপনের কোনো ভিত্তি নেই। এ রাত ইবাদতের ইহতেমাম করা বিদআত। এটি যদি ফজিলতের রাত হতো, তাহলে নবীজি সেটা অবহিত করতেন। অথচ মেরাজের পর তিনি আরও ১৮ বছর বেঁচেছিলেন। একটি বারের জন্যও তা পালন করেননি, অন্যদেরকেও উদযাপন করতে বলেননি। রাসুল (স.)-এর পর ১০০ বছর সাহাবায়ে কেরাম জীবিত ছিলেন। তাঁরা ২৭ রজবকে বিশেষভাবে উদযাপন করেছেন বলে একটি ঘটনাও পাওয়া যায়নি। বরং একটি বর্ণনায় পাওয়া যায়- কোনো কোনো অতি উৎসাহী লোক এ তারিখে রোজা রেখেছে বলে সংবাদ পেয়ে হজরত ওমর (রা.) খুব ক্রোধান্বিত হয়েছেন এবং প্রকাশ্যে পানাহার করতে বাধ্য করেছেন। (ইসলাহি খুতুবাত, প্রথম খ-)। অতএব অনর্থক কাজ থেকে নিজেদের বিরত রাখতে হবে। মেরাজের আসল তাৎপর্যকে অনুধাবন ও বাস্তবায়ন করাই হবে আসল কাজ।
মেরাজে আমাদের করণীয়
নবীজি (স.) মক্কা থেকে বায়তুল মুকাদ্দাসে গিয়েছিলেন। কোরআনের ভাষায় একে ইসরা বলা হয়। এর ওপর বিশ্বাস করা প্রত্যেক মুমিনের উপর ফরজ। এ ব্যাপারে সন্দেহ করা কুফর। কারণ এটি কোরআন দ্বারা প্রমাণিত। তাই ইসরার ঘটনার ওপর বিশ্বাস স্থাপন করতেই হবে, কোনো সন্দেহ-সংশয় পোষণ করা যাবে না।
নবীজি (স.) ইসরার ঘটনার পর বায়তুল মুকাদ্দাস থেকে সশরীরে উর্ধ্বজগতে পরিভ্রমণ করেছিলেন। এই অংশটিকে মিরাজ বলা হয়। এটিও বিশ্বাস করা জরুরি। অস্বীকার করা ইলহাদ ও জিন্দিকি তথা ধর্মদ্রোহিতা।
বিশুদ্ধ বর্ণনাগুলো থেকে মেরাজের ঘটনাগুলো জানা। মেরাজ সম্পর্কে অনেক অসতর্ক বক্তা অপ্রমাণিত বিষয়ে আলোচনা করে থাকেন। সেসকল আলোচনা বর্জন করা। হক্কানি আলেমদের থেকে মেরাজ বিষয়ে জানার চেষ্টা করা।
মেরাজের রাতে নবীজি (স) জান্নাত-জাহান্নাম দেখেছেন। অনেক পাপের শাস্তি সম্পর্কে তিনি এই রাতে অবগত হয়েছেন এবং জানিয়েছেন। আমাদের কর্তব্য হচ্ছে- সেসব পাপগুলো চিহ্নিত করে আমাদের জীবন থেকে সেগুলোকে ঝেড়ে ফেলা। বিশেষ করে শিরক না করা, পিতা-মাতার অবাধ্য না হওয়া, এতিমের মাল আত্মসাৎ করা থেকে বিরত থাকা, সম্পদের অপব্যবহার রোধ করা, খাদ্যাভাবে সন্তানকে হত্যা না করা, অহংকার ও অনুমাননির্ভর কাজ থেকে বিরত থাকা, জেনা-ব্যভিচারের ধারেকাছেও না যাওয়া, প্রতিবেশীর হক আদায় করাসহ ইত্যাদি বিষয়ের শিক্ষা আমরা মেরাজের ঘটনা থেকে পাই।
হক্কানি আলেমদের থেকে প্রাপ্ত মেরাজের বিভিন্ন শিক্ষাগুলোকে নিজেদের জীবনে বাস্তবায়ন করা।
মেরাজ সম্পর্কে সমাজে প্রচলিত ভুল ধারণা ও বিভিন্ন বিদআত থেকে নিজে বেঁচে থাকা। পরিবার-পরিজন ও অপর মুমিন ভাইদেরকেও এ ব্যাপারে সচেতন করা।
বিশেষ করে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রাপ্ত হাদিয়া নামাজ সঠিক সময়ে আদায় করা।
আমলের মাপকাঠি হলো সুন্নত
দ্বীনের সব আমল আল্লাহর রাসুলের অনুসরণ-অনুকরণ ও আনুগত্যের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু এই দিনকে বেশি ফজিলতপূর্ণ মনে করে, সুন্নত মনে করে, মুস্তাহাব ও অধিক সওয়াবের উপায় মনে করে রোজা রাখা এবং রাত জাগা কোনোটিই ঠিক নয়; বরং বিদআত। মনে রাখতে হবে- শয়তান উম্মতে মুহাম্মদিকে কোনোভাবে কোনঠাসা করতে না পারলে বিদআতকে শেষ অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। কারণ মানুষ ইবাদত মনে করেই বিদআত করে। সেই সুযোগটা ভালোভাবে কাজে লাগায় শয়তান। তার প্ররোচনায় মহানবী (স.)-এর উম্মত যখন বিদআতে লিপ্ত হয় তখন সে মানসিক তৃপ্তি বোধ করে। তার আনন্দের সীমা থাকে না। শয়তান বিদআতকে নাফরমানীর চেয়েও বেশি পছন্দ করে। কোনো মুসলমান জেনা-ব্যভিচার, খুন-খারাবি করলে সে যতটা খুশি হয় তার চেয়ে বেশি খুশি হয় সুন্নত ছেড়ে বিদআতে লিপ্ত হলে। প্রসিদ্ধ তাবেয়ি সুফিয়ান সাওরি (রহ) বলেন- ‘ইবলিসের নিকট নাফরমানির চেয়েও বিদআত বেশি প্রিয়। কারণ নাফরমানি থেকে তাওবা করার সম্ভাবনা থাকে, কিন্তু বিদআত থেকে তাওবা করার কোনো সম্ভাবনা থাকে না।’ (শাতিবি, আলইতিসাম: ১/১১; ইমাম সুয়ুতি, আলআমরু বিল ইত্তিবা পৃ-১৯)
শবে বরাতে রাত জাগার ব্যাপারে আলেমদের পরামর্শ হলো- রাত জেগে ইবাদত করা নিয়মিত আমল হলে শবে মেরাজে রাত জাগতে অসুবিধা নেই। যেমন- ২৫ বা ২৬ রজব রাত জেগে ইবাদত করেছেন, ২৭ তারিখেও রাত জাগতে অসুবিধা নেই। তেমনিভাবে ২৭ তারিখের পরও রাত জাগুন। আবার পুরো রজব মাসটিই আমলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি মাস।
নফল নামাজ-রোজা শুধু একদিন নয়
এই মাস তথা রজব থেকে মহানবী (স.) রমজানের প্রস্তুতি শুরু করতেন। নফল ইবাদতের মাত্রা বাড়িয়ে দিতেন। নফল রোজা রাখতেন। সারা বছর সোম ও বৃহস্পতিবার রোজা রাখার অভ্যাস ছিল নবীজির। এছাড়াও প্রতি হিজরি ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ তিনি রোজা রাখতেন। এগুলোই হলো সুন্নতি আমল। এগুলোর জন্য আমাদের যতটা না আবেগ, তার চেয়ে বেশি আবেগ হলো বিদআতের অনুসরণে। এসব নবীপ্রেমিকদের বৈশিষ্ট্য হতে পারে না। বরং আমরাও নবীজির অনুসরণে রজব ও শাবান মাসে নফল নামাজ ও রোজা রাখব। শুধুমাত্র শবে মেরাজকে কেন্দ্র করে নয়। উম্মে সালমা (রা.) বলেন, নবী করিম (স.) রমজান মাস ছাড়া সবচেয়ে বেশি রোজা পালন করতেন শাবান মাসে, অতঃপর রজব মাসে। আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) বলেন, ‘যখন রজব মাস আসত, তা আমরা নবীজি (স.)-এর আমলের আধিক্য দেখে বুঝতে পারতাম।’ নফল নামাজ-রোজা যেকোনো রাতে করতে নিষেধ নেই, বরং উৎসাহিত করা হয়েছে। তাই শবে মেরাজকে বিশেষ ইবাদতের জন্য নির্দিষ্ট করব না ইনশা আল্লাহ।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে দ্বীনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রত্যেক বিষয় সঠিকভাবে বোঝার ও আমল করার তাওফিক দিন। আমিন।