ইসলাম সর্বাগ্রে হৃদয়ে ধারণ করার বিষয়। তারপর জীবন ও কর্মে প্রতিপালনের বিষয়। অন্যভাবে বললে- ইসলামী চেতনা ও মূল্যবোধই একজন মানুষের মুসলমান হওয়ার প্রথম ও প্রধান শর্ত। বাহ্যিক আমলের স্থান দ্বিতীয় পর্যায়ে। আর সে কারণেই কেউ যদি ইসলামী চেতনায় বিশ্বাসী না হয় এবং ইসলামী মূল্যবোধ ধারণ না করে, তাহলে সে লেবাসে-পোশাকে মুসলমানের মতো দেখালেও প্রকৃত প্রস্তাবে সে মুসলমান নয়। ইসলামী পরিভাষায় তাকে বলা হবে মুনাফিক। মুনাফিকরা তাদের দ্বিমুখী চরিত্রের কারণে পার্থিব জীবনে কিছু সুখ-সুবিধা পেলেও পরকালে তারা মুক্তি পাবে না, তাদের জন্য রয়েছে জাহান্নামের কঠিন শাস্তি। যেমন পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে- ‘আর মানুষের মধ্যে এমন কিছু মানুষ রয়েছে যারা বলে, আমরা আল্লাহর প্রতি এবং পরকালের প্রতি ঈমান এনেছি কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে তারা মুমিন নয়। আল্লাহ ও মুমিনদেরকে তারা প্রতারিত করতে চায়, আসলে তারা নিজেদের ছাড়া কাউকে প্রতারিত করতে পারে না, কিন্তু তারা তা বোঝে না। তাদের অন্তরে ব্যাধি রয়েছে, এরপর আল্লাহ তাদের ব্যাধি আরো বাড়িয়ে দিয়েছেন আর তাদের মিথ্যাবাদিতার জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।’ (সূরা আল-বাকারা : ৮-১০)
ইসলামী মূল্যবোধ-বর্জিত, ইসলামী চেতনায় অবিশ্বাসী তথা মুনাফিকদের পরিণতি সম্পর্কে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ইরশাদ করেছেন- ‘নিশ্চয়ই মুনাফিকরা জাহান্নামের সর্বনি¤œ স্তরে অবস্থান করবে, আর তুমি কিছুতেই তাদের জন্য কোনো সাহায্যকারী পাবে না।’ (সূরা নিসা-১৪৫) ইসলামী জীবনের প্রথম ও প্রধান স্তর যেহেতু তার চেতনায় সন্দেহাতীত বিশ্বাস ও মূল্যবোধকে সুদৃঢ়ভাবে ধারণ করা সে কারণেই হাবশার সম্রাট নাজ্জাশি প্রকাশ্যে ইসলাম গ্রহণ না করলেও এবং ইসলামের বাহ্যিক বিষয়াবলি পালন না করা সত্ত্বেও তাকে রাসূলুল্লাহ সা: মুসলমান হিসেবে গণ্য করেন এবং তার মৃত্যুর পর রাসূলুল্লাহ সা: সাহাবায়ে কিরামকে নিয়ে গায়েবানা জানাজা আদায় করেন। এ সম্পর্কে হজরত আবু হুরায়রা রা: একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন, ‘যেদিন নাজ্জাশি মারা গেলেন সেদিন রাসূলুল্লাহ সা: সাহাবিদের তার মৃত্যুর সংবাদ দিলেন। এরপর তিনি তাদেরকে নিয়ে জানাজা আদায়ের স্থানে এসে তাদের কাতারবদ্ধ করলেন এবং চার তাকবির দিয়ে জানাজা আদায় করলেন।’ (বুখারি-১৩৩৭, মুসলিম-৯৫৬, জামে আত-তিরমিজি-৯৪৩, আবু দাউদ-৩২০৪, নাসায়ি-১৯৮০, মিশকাত-১৬৫২)
ঈমান ও ইবাদতের সমন্বয়ে মুসলিম পরিচয় : মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির সেরা জীব। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন- ‘নিশ্চয়ই আমি আদম সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি এবং জলে ও স্থলে তাদের চলাচলের জন্য বাহন দান করেছি, তাদেরকে উত্তম রিজিক দান করেছি এবং আমি যাদেরকে সৃষ্টি করেছি তাদের অনেকের ওপর তাদেরকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি।’ (সূরা বনি ইসরাইল-৭০) পৃথিবীর সৃষ্টিরাজির মধ্যে মর্যাদায় মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব শর্তহীন নয়। অর্থাৎ- বিষয়টি মোটেও এমন নয় যে, মানব সন্তান হিসেবে জন্মলাভ করলেই অন্যান্য মাখলুকের চেয়ে মর্যাদায় শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী হওয়া যাবে। আর সৃষ্টিগত কোনো বৈশিষ্ট্যও মানুষকে অন্যান্য প্রাণীর তুলনায় অধিক মর্যাদাবান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে না। মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের একমাত্র মাপকাঠি হলো ইবাদত। অনেকে বলে থাকেন, আমি নামাজ না পড়লে কি হবে, আমার ঈমান ঠিক আছে, আমি একজন মুসলমান! তাদের ধারণা, মসলমান পরিচয়ের জন্য বাহ্যিক আমলের আবশ্যকতা নেই। তাদের এই দাবি সম্পূর্ণ অমূলক। মহান আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন- ‘আমি শুধু আমার ইবাদত করার জন্যই মানুষ ও জিন জাতিকে সৃষ্টি করেছি।’ (সূরা জারিয়াত-৫৬)
আমাদের মধ্যে ইবাদত সম্পর্কে মারাত্মক ভুল ধারণা রয়েছে। নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত, তাসবিহ, তাহলিল, কুরআন তিলাওয়াত ইত্যাদি গুটিকতক কাজকে ইবাদত মনে করা হয়। আর জীবনের সুবিশাল পরিম-লে বিস্তৃত অসংখ্য অপরিহার্য বিষয়াবলিকে মনে করা হয় দুনিয়াদারি। অথচ ফিতরাতের ধর্ম ইসলামের কোথাও এমন কথা বলা হয়নি। ইবাদত শব্দটির আভিধানিক অর্থ হলো- দাসত্ব বা আনুগত্য। আর ইসলামী শরিয়তের পরিভাষায় ইবাদত বলতে জীবনের সব ক্ষেত্রে মহান আল্লাহর আনুগত্য করাকে বোঝায়। অর্থাৎ মহান আল্লাহর বিধান পালনের মাধ্যমে জীবন ও জগতকে সার্থক ও সুন্দর করে তোলার নামই ইবাদত। মানুষ তার জীবনের কর্মপন্থা নির্ধারণে সম্পূর্ণ স্বাধীন। জ্ঞানের আলোকে চিন্তাভাবনা করে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির মাধ্যমে গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জীবনের সমস্ত কামনা-বাসনা, আশা-আকাক্সক্ষাকে মহান আল্লাহর বিধানের অধীনে সমর্পণ করে বৈষয়িক জীবনের সব ক্ষেত্রে তাঁর আনুগত্যের নামই ইবাদত। আর এই ইবাদতই হলো মানুষের আশরাফুল মাখলুকাত হওয়ার আসল মাপকাঠি। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেছেন- ‘আমি বহু মানুষ ও জিনকে জাহান্নামের জন্য সৃষ্টি করেছি, তাদের অন্তর আছে কিন্তু তা দিয়ে তারা উপলব্ধি করে না, তাদের চোখ আছে কিন্তু তা দিয়ে তারা দেখে না, তাদের কান আছে কিন্তু তা দিয়ে তারা শোনে না। তারা হলো পশুর মতো; বরং তদপেক্ষা বেশি পথভ্রষ্ট, তারা হলো গাফিল।’ (সূরা আরাফ-১৭৯) সুতরাং ইবাদতকে নামাজের নামে মসজিদের চার দেয়ালের মধ্যে, রোজার নামে একটি মাসের মধ্যে, হজের নামে আরবের মক্কা-মদিনাতে সীমাবদ্ধ করে রাখা বড্ড অন্যায়। আর এ অধিকার কারো নেই। ইবাদত হবে জীবনজুড়ে, জগতব্যাপী, প্রতি মুহূর্তে, সব কাজে।
ইবাদতের মান নির্ধারণ করে ঈমান : অন্তরে বিশ্বাসের নাম ঈমান। বিশ্বাসই মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সব কাজের ভিত্তি। কোনো কাজের ফলাফল যতই লোভনীয় হোক না কেন, যদি ওই কাজের জ্ঞান ও তার ফলাফলের বিষয়ে অন্তরে বিশ্বাস না থাকে, তাহলে সে কাজ মানুষ করতে পারে না। তেমনি ঈমান যদি না থাকে তাহলে ইবাদত করাও সম্ভব নয়। যদিও বহ্যিকভাবে ঈমানহীন কারো কারো দ্বারা কোনো কোনো সময় ভালো কাজ হতে দেখা যায় কিন্তু সেটি মহান আল্লাহর দরবারে ইবাদত হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেছেন- ‘যারা তাদের পালনকর্তার সত্তায় অবিশ্বাসী, তাদের দৃষ্টান্ত এমন যে, তাদের কর্মসমূহ (ইবাদত) ছাইভষ্মের মতো, যা ঝড়ের দিনে প্রবল বেগে প্রবাহিত বাতাস উড়িয়ে নিয়ে যায়। তাদের উপার্জনের কোনো কিছুই তারা ভোগ করতে পারে না। এটি তো ঘোরতর বিভ্রান্তি।’ (সূরা ইবরাহিম, আয়াত-১৮) আরো ইরশাদ হয়েছে- ‘আর যে ঈমানকে অস্বীকার করবে, তার সমস্ত আমল বরবাদ হয়ে যাবে আর সে পরকালে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’ (সূরা মায়িদাহ-৫)
হজরত আম্মার ইবনে ইয়াসির রা: একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সা:-কে বলতে শুনেছি, ‘এমন অনেক মানুষ আছে যারা নামাজ আদায় করার পর নামাজের ১০ ভাগের ১ ভাগ, ৯ ভাগের ১ ভাগ, ৮ ভাগের ১ ভাগ, ৭ ভাগের ১ ভাগ, ৬ ভাগের ১ ভাগ, ৫ ভাগের ১ ভাগ, ৪ ভাগের ১ ভাগ, ৩ ভাগের ১ ভাগ বা অর্ধেক সওয়াব লাভ করে।’ (আবু দাউদ-৭৯৬) হজরত ওমর ইবনুল খাত্তাব রা: থেকে একটি বর্ণিত হয়েছে- তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই সমস্ত কাজের ফলাফল নির্ভর করে নিয়তের ওপর। আর প্রত্যেক ব্যক্তি যা নিয়ত করবে, বিনিময়ে সে সেটিই পাবে। সুতরাং যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে হিজরত করেছে, তার হিজরত আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকেই গণ্য হবে। আর যার হিজরত পার্থিব কোনো স্বার্থসিদ্ধির জন্য বা কোনো নারীকে বিয়ে করার জন্য, তার হিজরত সে জন্যই বিবেচিত হবে।’ (বুখারি-০১, মুসলিম-১৯০৭)
লেখক : পেশ ইমাম ও খতিব, রাজশাহী কলেজ কেন্দ্রীয় মসজিদ