হঠাৎ করে কোনো বন্ধু বা আত্মীয়ের বাড়ি গেছেন, বসার ঘরে আসতেই রঙিন শতরঞ্জিতে পা রেখে আরামদায়ক একটি চেয়ারে বসলেন। ঘরের এক কোণে বইয়ের তাকগুলোর ওপরে অল্প কিছু মাটির জিনিস সাজানো। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে দেখলেন জানালার সামনে ছোট্ট রোদটুকু এসে পড়ছে সাদাসিধে একটি পাতাবাহারের গায়ে। মনের অজান্তে হয়তো প্রশংসা করেই ফেলবেন। তবে ভেবে দেখেছেন কি- একটি ঘর বা বাসা সুন্দর করে সাজানোর এই আয়োজন আসলে কার জন্য? শুধুই অতিথির মন জয় করার জন্য? নগরের এই ব্যস্ত জীবনে অর্থ, সময় ও এনার্জি খরচ করে আমরা কেন সাজাই নিজের ছোট্ট আবাসটি?
কখনো কখনো অতিথির চোখের জন্য আমরা সবাই ঘর পরিষ্কার করি আর সুন্দর করে গুছাই, এ কথা অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু আপনার নিজের ঘরটি আপনার চোখে দেখতে কেমন লাগে, সেখানে থাকতে আপনার আরাম লাগে কি না, আশেপাশে আপনার পছন্দের জিনিসগুলো আছে কি না, ঘরটি আসলেই আপন মনে হয় কি না- এসবের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আপনার জীবনযাপনের অনেকগুলো দিক। তাই নিজের জন্য, নিজের মতো করে ঘর সাজানো এক ধরনের ‘সেল্ফ কেয়ার’।
বাড়ি মানে শুধু চার দেওয়াল নয়, বাড়ি হলো আমাদের দিনের শুরু আর শেষের সাক্ষী। একটি স্নিগ্ধ ও সুসংগঠিত বাড়ি শুধু চোখে ভালো লাগে না, এটি আমাদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্যও এক ধরনের থেরাপি। কেননা প্রতিটা ঘরে আসবাবপত্রের পছন্দ, রঙের ব্যবহার, ফাঁকা জায়গার পরিমাণও এক বা একাধিক অর্থ বহন করে। বাইরে থেকে আসা অতিথিকে যেমন আপনার সম্পর্কে বার্তা দেয় আপনার ঘর, তেমনই আপনার অবচেতন মনের সঙ্গেও আপনার পরিবেশের কথোপকথন হয়।
কেমন সে কথোপকথন
১. মন ভালো করে দেওয়ার ম্যাজিক
গবেষণা বলছে, অগোছালো এবং নোংরা পরিবেশ আমাদের মস্তিষ্কে চাপ বা স্ট্রেস হরমোন- কর্টিসলের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু যখন বাড়িটি পরিষ্কার, গোছানো এবং সুন্দরভাবে সাজানো থাকে, তখন আমাদের মন নিজে থেকেই হালকা হয়ে যায়। চারপাশে সুন্দর জিনিস দেখলে আমাদের মস্তিষ্ক ডোপামিন নামক ‘ফিল-গুড’ হরমোন নিঃসরণ করে, যা আমাদের খুশি এবং সন্তুষ্ট বোধ করতে সাহায্য করে।
২. উৎপাদনশীলতার গোপন রহস্য
কাজে মনোযোগ দেওয়ার জন্য একটি সুসংগঠিত পরিবেশ খুব কার্যকরী। অগোছালো পরিবেশে আমাদের মস্তিষ্ক বিভ্রান্ত হয় এবং কোনো কাজে ফোকাস করতে অসুবিধা হয়। কিন্তু যখন প্রয়োজনের প্রতিটি জিনিস তার নির্দিষ্ট স্থানে থাকে, তখন আমাদের মস্তিষ্কও সুসংগঠিত থাকে। এটি আমাদের কাজের দক্ষতা এবং উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে তোলে। তাই, যদি আপনি মনে করেন কাজে মন বসছে না, তাহলে একবার ঘরটি গুছিয়ে নিন, দেখবেন কাজের গতি বেড়ে গেছে!
৩. ঘুমের সেরা বন্ধু
শোবার ঘরের পরিবেশ আমাদের ঘুমের মানের উপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। একটি পরিষ্কার, গোছানো এবং আরামদায়ক শোবার ঘরের আমাদের ঘুমাতে সাহায্য করে। গবেষণায় দেখা গেছে, যারা তাদের বেডরুমকে সুন্দরভাবে সাজিয়ে রাখেন এবং পরিষ্কার রাখেন, তাদের ঘুমের মান তুলনামূলকভাবে ভালো হয়। ভালো ঘুম আমাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
৩. শারীরিক সুস্থতার চাবিকাঠি
শুধু মনের স্বাস্থ্য নয়, পরিচ্ছন্নতা বা সাধারণ হাইজিন শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্যও খুব গুরুত্বপূর্ণ। ধুলো, ময়লা এবং অগোছালো পরিবেশে জীবাণু এবং অ্যালার্জেনের পরিমাণ বেড়ে যায়, যা শ্বাসকষ্ট, অ্যালার্জি এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যার কারণ হতে পারে। একটি পরিষ্কার বাড়ি এই ধরনের সমস্যা থেকে আমাদের দূরে রাখে।
৪. পারিবারিক বন্ধনের বন্ধু
একটি সুন্দর এবং সুসংগঠিত বাড়ি পারিবারিক সম্পর্কেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। বাড়ির পরিবেশ শান্তিপূর্ণ এবং সুন্দর হলে পরিবারের সদস্যরা একে অপরের সঙ্গে বেশি সময় কাটাতে আগ্রহী হন। এটি পারিবারিক বন্ধনকে মজবুত করে এবং সুখী পরিবেশ তৈরি করে।
৫. সৃজনশীলতার উৎস
আমাদের চারপাশের পরিবেশ সুন্দর এবং অনুপ্রেরণাদায়ক হলে আমাদের মস্তিষ্ক নতুন ধারণা নিয়ে চিন্তা করতে উৎসাহিত হয়। যদি আপনি কোনো সৃজনশীল কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকেন, যেমন লেখালেখি, আঁকা বা ডিজাইন করা, তাহলে আপনার জন্য এটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
যেভাবে বাড়িকে সুন্দর ও সুসংগঠিত রাখবেন
কেউ কেউ নিজের বাসাটি সাজানো নিয়ে অনেক বেশি সিরিয়াস। সবকিছু চাই পরিপাটি, একদম টিপটপ। কেউ বা আবার একদম গা-ছাড়া, কিছুতেই কোন যায় আসে না। আর বাকিরা হয়তো আমার মতো মাঝামাঝিতে আছেন। ফলে ‘গুছানো’ বা ‘সাজানো’ শব্দটি একেজনের কাছে একেকরকম অর্থ বহন করে। তবে সাধারণ হাইজিন রক্ষা করা এবং আপনার বাড়িকে সুসংগঠিত রাখার জন্য সহজ কিছু পদক্ষেপ অনুসরণ করতে পারেন-
১. অপ্রয়োজনীয় জিনিস বাদ দিন: যেসব জিনিসের প্রয়োজন নেই, ব্যবহার উপযোগী হলে সেগুলো দান করে দিন অথবা ফেলে দিন।
২. জিনিসপত্রের নির্দিষ্ট স্থান নির্ধারণ করুন: প্রতিটি জিনিসের জন্য একটি নির্দিষ্ট স্থান রাখুন, যেন দরকারের সময় পরিবারের যে কেউ সহজে খুঁজে পান।
৩. রঙের ব্যবহার: বাড়ির দেয়ালে হালকা রঙয়ের ব্যবহার করলে ঘর সাজানো সহজ হয়। তবে রঙয়ের সঙ্গে মুডের সম্পর্ক খুব গভীর, তাই আপনার তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগে, এমন রঙকে প্রাধান্য দিন। এদিকে আবার বর্তমানে ঘরের একটি দেয়ালে গাঢ় রঙ বা অ্যাকসেন্ট দেয়াল করা এক ধরনের ট্রেন্ড, যা সুন্দর করে সাজালে দেখতে চমৎকার লাগে।
৪. প্রাকৃতিক আলো এবং গাছ: বাড়িতে পর্যাপ্ত আলো এবং কিছু গাছ রাখুন, যা পরিবেশকে প্রাণবন্ত করে তোলে।
মনে রাখবেন, আপনার বাসাটি আপনার জীবনযাপনের সম্প্রসারণ। সেখানে নিরাপদ ও নিরুদ্বেগ অনুভব করা আপনার অধিকার। তাই নিজের খেয়াল রাখার অংশ হিসেবেই আপনার ঘরকে আপন মনে সাজিয়ে তুলতে শুরু করুন।