(গত দিনের পর)
লাইলাতুন নিসফি মিন শাবানকে কাজে লাগানোর কৌশল : ইমাম ইবনে রজব রাহ. বলেছেন, ‘মুমিনের কর্তব্য এই যে, এ রাতে খালেস দিলে তওবা করে জিকির, দোয়া ও ইস্তিগফারের জন্য প্রস্তুত হয়ে যাবে। যতেœর সাথে নফল নামাজ পড়বে। সওয়াব লাভের আশা নিয়ে ১৫ তারিখের রোজাও রাখবে। কেননা, কখন মৃত্যু এসে যায় বলা যায় না। তাই কল্যাণের মৌসুম শেষ হওয়ার আগেই তার মূল্য দেয়া কর্তব্য। তবে অত্যন্ত জরুরি বিষয় হলো- ওইসব গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা, যেগুলো এ রাতের সাধারণ ক্ষমা ও দোয়া কবুল হওয়া থেকে মানুষকে বঞ্চিত করে দেয়। যথা- শিরক, হত্যা ও বিদ্বেষ। এগুলো সবই কবিরা গুনাহ। আর বিদ্বেষ তো এতই গর্হিত বিষয় যে, এটি অধিকাংশ সময়ই মানুষকে আল্লাহর রহমত ও মাগফিরাত থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। (লাতাইফুল মাআরিফ, পৃষ্ঠা-২৬৫)
লাইলাতুন নিসফি মিন শাবানের নফল আমলসমূহ ব্যক্তিগত : এ রাতের নফল আমলসমূহ, বিশুদ্ধ মতানুসারে একাকীভাবে করণীয়। ফরজ নামাজ তো অবশ্যই মসজিদে আদায় করতে হবে। এরপর যতটুকু নফল পড়ার তা নিজ নিজ ঘরে একাকী পড়বে। এসব নফল আমলের জন্য দলে দলে মসজিদে এসে সমবেত হওয়ার কোনো প্রমাণ হাদিসেও নেই আর সাহাবায়ে কেরামের যুগেও এর রেওয়াজ ছিল না। (ইক্তিযাউস সিরাতিল মুসতাকিম-২/৬৩১-৬৪১, মারাকিল ফালাহ, পৃষ্ঠা-২১৯)
তবে কোনো আহ্বান ও ঘোষণা ছাড়া এমনিই কিছু লোক যদি মসজিদে এসে যায়, তাহলে প্রত্যেকে নিজ নিজ আমলে মশগুল থাকবে, একে অন্যের আমলের ব্যাঘাত সৃষ্টির কারণ হবে না।
কোনো কোনো জায়গায় এই রেওয়াজ আছে যে, এ রাতে মাগরিব বা এশার পর থেকেই ওয়াজ-নসিহত আরম্ভ হয়। আবার কোথাও ওয়াজের পর মিলাদ-মাহফিলের অনুষ্ঠান হয়। কোথাও তো সারা রাত খতমে-শবিনা হতে থাকে। তা ছাড়া এসব কিছুই করা হয় মাইকে এবং বাইরের মাইকও ছেড়ে দেয়া হয়।
মনে রাখতে হবে, এ সব কিছুই ভুল রেওয়াজ। এ রাতে মাইক ছেড়ে দিয়ে বক্তৃতা-ওয়াজের আয়োজন করা ঠিক নয়। এতে না ইবাদতে আগ্রহী মানুষের পক্ষে ঘরে বসে একাগ্রতার সাথে ইবাদত করা সম্ভব হয়, আর না মসজিদে। অসুস্থ ব্যক্তিদের বিশ্রামেও মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটে। আল্লাহ আমাদের এসব ভুল কাজকর্ম পরিহার করার তাওফিক দিন।
লাইলাতুন নিসফি মিন শাবানের রজনীতে আপত্তিকর কাজকর্ম : মসজিদ, ঘরবাড়ি বা দোকানপাটে আলোকসজ্জা করা। পটকা ফুটানো, আতশবাজি ফুটানো। কবরস্থান ও মাজারে ভিড় করা। কবরস্থান ও মাজারে আলোকসজ্জা করা। মহিলাদের বিনাপ্রয়োজনে ঘরের বাইরে যাওয়া, বিশেষত বেপর্দা হয়ে দোকানপাট, মাজার ইত্যাদিতে ভিড় করা। তরুণ ও যুবক ছেলেদের সারা রাত শহরের অলিগলিতে ঘুরে বেড়ানো, হৈ-হুল্লোড় করা।
শায়েখ আবদুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী রাহ. বলেন, এই রাতের নিকৃষ্ট বিদআতসমূহের মধ্যে নিচের বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত- ঘরবাড়ি, দোকানপাট আলোকসজ্জা করা, হইচই ও আতশবাজির উদ্দেশ্যে সমবেত হওয়া ইত্যাদি। এগুলো সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন এবং এগুলোর সপক্ষে কোনো জাল রেওয়ায়েতও পাওয়া যায় না। সম্ভবত হিন্দুদের ‘দেওয়ালি’ প্রথা থেকে তা গ্রহণ করা হয়েছে। (মা ছাবাতা বিস সুন্নাহ, পৃষ্ঠা : ৩৫৩-৩৬৩)
খিচুড়ি বা হালুয়া-রুটি : শবেবরাতে কৃত কিছু কাজ তো অন্য সময়েও হারাম। আর কিছু কাজ আছে, যা অন্য সময় করা জায়েজ কিন্তু শবেবরাতে সেগুলোর পেছনে পড়ে শবেবরাতের আমল থেকে বঞ্চিত হওয়া কিছুতেই ঠিক নয়। যেমন খিচুড়ি বা হালুয়া-রুটি রান্না করে নিজেরা খাওয়া বা গরিবদের খাওয়ানো। সাধারণ সময়ে এগুলো করা জায়েজ কিন্তু শবেবরাতে এগুলোর পেছনে পড়ে শবেবরাতের মূল কাজ তওবা-ইস্তিগফার, নফল ইবাদত প্রভৃতি থেকে বঞ্চিত থাকা একেবারেই ঠিক নয়। বস্তুত এগুলোও শয়তানের এক প্রকারের ধোঁকা, মানুষকে মূল কাজ থেকে বিরত রাখার জন্য শয়তান এসব কাজকর্মে মানুষকে ব্যস্ত করে দেয়।
শবে বরাতের পরদিন শাবান মাসের ১৫ তারিখের রোজার হুকুম : শবেবরাতের পরের দিন শাবান মাসের ১৫ তারিখ। এ দিন অনেকে রোজা রেখে থাকেন। এ সম্পর্কে একটি বিষয় জেনে রাখা প্রয়োজন। প্রতি চান্দ্র মাসে তিন দিন রোজা রাখা সুন্নত। নবী সা: নিজেও প্রতি মাসে তিন দিন রোজা রাখতেন, সাহাবিদেরও মাসে তিন দিন রোজা রাখতে বলতেন। (জামে তিরমিজি : ৭৬০, ৭৬৩)
সে হিসাবে মাসে তিন দিন রোজা রাখা সুন্নত। এই তিন দিন মাসের শুরুতেও হতে পারে, মাঝেও হতে পারে, আবার শেষেও হতে পারে। কিন্তু কিছু কিছু হাদিসে স্পষ্ট আছে যে, নবী সা: সাহাবিদের বিশেষভাবে মাসের ১৩, ১৪, ১৫ তারিখ (যাকে আইয়ামে বিজ বলা হয়) রোজা রাখতে বলেছেন। (জামে তিরমিজি-৭৬১, সুনানে আবু দাউদ-২৪৪৯, ফাতহুল বারি-১৯৮১ নং হাদিসের আলোচনা)
এসব হাদিসের ওপর ভিত্তি করে হাফেজ ইবনে হাজার রাহ. বলেছেন, যে তিন দিনের কথা নবী সা: বলে গেছেন, সেই তিন দিন রোজা রাখাই সর্বোত্তম। (ফাতহুল বারি-১৯৮১ নং হাদিসের আলোচনা)
সে হিসাবে প্রতি মাসের আইয়ামে বিজে রোজা রাখা সুন্নত। শাবান মাসও এর ব্যতিক্রম নয়। তাই শাবান মাসের আইয়ামে বিজে (১৩, ১৪, ১৫) রোজা রাখাও সুন্নত। ১৫ তারিখ আইয়ামে বিজের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কারণে ১৫ তারিখ রোজা রাখাও সুন্নত।
বাকি থাকল একটি বর্ণনায় বিশেষভাবে ও পৃথকভাবে ১৫ শাবান রোজা রাখার কথা বর্ণিত হয়েছে। (সুনানে ইবনে মাজাহ, বর্ণনা-১৩৮৪) কিন্তু বর্ণনাটি শাস্ত্রীয় বিচারে দুর্বল। শাস্ত্রীয় বিচারে দুর্বল হওয়ার কারণে কেবল এই বর্ণনার ওপর ভিত্তি করে ১৫ শাবানের রোজাকে পৃথকভাবে সুন্নত কিংবা মুস্তাহাব মনে করা সঠিক নয় বলে মতামত দিয়েছেন মুহাক্কিক আলেমরা।
তবে, যেমনটি পূর্বে বলা হলো- ১৫ তারিখ আইয়ামে বিজের অন্তর্ভুক্ত- এ হিসাবে এই দিনের রোজাকে (১৩ ও ১৪ তারিখের রোজাসহ) নিঃসন্দেহে সুন্নত মনে করা যাবে।
মোটকথা, সর্বাবস্থায় শাবান মাসের ১৫ তারিখে রোজা রাখা যাবে। আগের দুই দিন তথা ১৩ ও ১৪ তারিখের সাথে মিলিয়ে একসাথে যেমন তিন দিন রোজা রাখা যাবে, তেমনি পৃথকভাবে কেবল ১৫ তারিখও রোজা রাখা যাবে। এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে তিন দিন রাখাই উত্তম।
এমনিভাবে ১৫ তারিখ আইয়ামে বিজের একটি দিন হিসেবে ১৫ তারিখের রোজাকে সুন্নতও মনে করা যাবে। কিন্তু পৃথকভাবে শাবান মাসের ১৫ তারিখ বিশেষ একটি দিন, সে হিসাবে পৃথকভাবে এ দিনে রোজা রাখা সুন্নত- এমন ধারণা রাখা যাবে না। লেখক : ইমাম ও খতিব, দৌলতখান উপজেলা মডেল মাসজিদ।