শুক্রবার, ১৪ মার্চ ২০২৫, ০৫:১১ পূর্বাহ্ন

ন্যায় বিচার চায় বনফুল আদিবাসী গ্রীনহার্ট কলেজের শিক্ষার্থীরা

শাহ বুলবুল:
  • আপডেট সময় সোমবার, ১৭ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫

ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করা হয়েছে হাসান আল মোস্তাহিদ রিফাতের মাথায়। রক্তাক্ত রিফাতকে প্রথমে ধামরাইয়ের একটি স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়, এরপর নেওয়া হয় সাভার এনাম মেডিকেলে। এখানকার নিউরো আইসিইউতে চিকিৎসা শেষে আরও উন্নত চিকিৎসার জন্য স্থানান্তরিত করা হয় রাজধানীর অরোরা হাসপাতালে। গতকাল এই প্রতিবেদন লেখার সময় রিফাত হাসপাতাল থেকে ছাড় পেলেও তার অবস্থা এখনও আশঙ্কাজনক। বনফুল আদিবাসী গ্রীনহার্ট কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী রিফাতের অবস্থা জানতে ফোন করা হলে তা রিসিভ করেন তার বোন মাফরুহা খানম। রিফাতের বোন মাফরুহার বর্ণনায় জানা যায় তার ভাইয়ের প্রতি ঘটে যাওয়া নৃশংস নির্মমতার কথা। প্রতিষ্ঠানটির আরেক শিক্ষার্থী আহনাফ হাবিব যার হাতে এবং পায়ে আঘাত করা হয়েছে ধারালো চাইনিজ কুড়াল দিয়ে। কথা হয় হাবিবের মা আফসানা আফরোজের সাথে। জানান, ধারালো অস্ত্রের আঘাতের ফলে লিগামেন্ট ছিঁড়ে যাওয়ায় কোনভাবেই হাত পা নাড়াতে পারছেন না হাবিব। ডান পা অনেকটাই অকেজো আর বাম পায়ের অবস্থাও ভালো না। আহতদের স্বজন ছাড়াও কথা হয় শিক্ষার্থী মেহের নিগারের সাথে। সে এবছর বনফুল আদিবাসী গ্রীনহার্ট কলেজ থেকে এসএসসি পরীক্ষার্থী। তার কথাও জানা যায় লোমহর্ষক এক নির্মম অবস্থার কথা। মেহের নিগার জানান, ঠুনকো অযুহাতে আমাদের সহপাঠী ভাইদের মেরে রক্তাক্ত করা হয়েছে। রাতে ক্যাম্পাসের সামনে ফিরে আসার পরই মনে হয়েছে আমরা একটা অরাজক অবস্থা থেকে জীবন নিয়ে বেঁচে আসতে পেরেছি।
কী ঘটেছিলো
এতক্ষণ যাদের কথা বলা হয়েছে এরা প্রত্যেকেই রাজধানীর মিরপুর ১৩ নং সেকশনে অবস্থিত বনফুল আদিবাসী গ্রীনহার্ট কলেজের শিক্ষার্থী। গত ১২ ফেব্রুয়ারি ছিলো কলেজের বার্ষিক শিক্ষাসফরের দিন। বাসযোগে কয়েক শত ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক আর কর্মকর্তা কর্মচারী মিলে আসেন রাজধানীর অদূরে ধামরাইয়ের কুল্লা ইউনিয়নের সীতি গ্রামস্থ আলাদিন পার্কে। প্রথম দফায় শিক্ষার্থীদের সাথে পার্ক কর্মচারীদের বাকবিতণ্ডা হয় সুইমিংপুলের লকার থেকে মোবাইল হারানোকে কেন্দ্র করে। সন্ধ্যা নাগাদ ফেরার পথে আবারও আলাদিনের কর্মচারীরা স্থানীয়দের সাথে নিয়ে আক্রমন করে নীরিহ ছাত্রদের উপর। কিছু বুঝে ওঠার আগে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে মারাত্মকভাবে জখম করা হয় বেশ কয়েকজন ছাত্রকে। সন্তানতুল্য ছাত্রদের রক্ষা করতে গিয়ে মারাত্মকভাবে আহত হন কয়েকজন শিক্ষক। এদের মধ্যে আশঙ্কাজনকভাবে আহত শিক্ষকের নাম রিপন হালদার। তিনি হাত, পিঠ এবং পায়ে মারাত্মকভাবে জখম হয়েছেন। পিকনিক বহরে থাকা নারীরাও লাঞ্চনা থেকে রক্ষা পাননি। এসময় সন্ত্রাসীরা ছাত্রছাত্রীদের বহন করা ১২টি বাসে ব্যাপক ভাঙচুর চালায় এবং সাথে থাকা জিনিসপত্র ছিনিয়ে নেয়। চোখের সামনে ঘটে যাওয়া এমন নৃশংসতা নিয়ে ১৩ ফেব্রুয়ারি নিজের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি পোস্ট দেন বনফুল আদিবাসী গ্রীনহার্ট কলেজের প্রভাষক মতিয়া খান। ১৩ ফেব্রুয়ারি নিজের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেওয়া পোস্টে তিনি লেখেন ‘হামলার সময়ে আমি বাসে মেয়েদেরকে ও আদিবাসী ছেলে সহ অন্যান্য ছেলেদের রক্ষা করার চেষ্টা করি এবং সন্ত্রাসীরা বাস ভাঙচুর করে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ শুরু করে। তারপর আমার মাথায় রড দিয়ে মারতে আসে। সমস্ত শরীরে কাঁচের গুড়ো নিয়ে ৩৫ জন ছাত্রী, ২৩ জন শিক্ষিকাসহ আহত ও রক্তাক্ত ছেলেগুলোকে বাসে লুকিয়ে ভেতরের লাইট বন্ধ করে অন্ধকারে অনেক কাকুতি মিনতি করে কোনোরকমে জীবন রক্ষা করে ফিরে আসি।’ পোস্টের শেষে মতিয়া খান লেখেন ‘আমরা শিক্ষার্থীদের নিয়ে মানবতার গান গাই অথচ আমরা এধরণের মানবাধিকার লংঘনের শিকার হয়েছি যা ভাবতেই হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে।’
মামলা হয়েছে। গ্রেফতার ছয়
সীতি গ্রামের আলাদিন পার্কটি এর আগেও সংবাদের শিরোনামে এসেছে নোংরামির অভায়রণ্য হিসেবে। পিকনিকে আসা প্রায় ৩৫ শিক্ষার্থীকে জখমের ঘটনায় আবারও সংবাদের শিরোনাম হলো ধামরাইয়ের আলাদীন পার্ক। সাংবাদিক, গণমাধ্যম আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বদৌলতে মুহুর্তেই সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে নৃশংসতার খবরটি। বনফুল আদিবাসী গ্রীনহার্ট কলেজের শিক্ষক আব্দুল হাই মজুমদার বাদী হয়ে ঘটনার দিন রাতেই মামলা করেছেন ধামরাই থানায়। আসামী করা হয়েছে পার্ক মালিক আলাদীন, আলাদীনের সন্তান এবং পার্কটির ব্যবস্থাপক রনিসহ হামলায় জড়িত সংশ্লিষ্টদের। মামলাটির বর্তমান অবস্থা নিয়ে কথা হয় তদন্তকারী কর্মকর্তা সাব-ইন্সপেক্টর এস এম কাওছার সুলতানের সাথে। তার ভাষ্যমতে, আদিবাসী কলেজের মামলায় এ পর্যন্ত ছয়জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
ন্যায় বিচার চায় শিক্ষার্থীরা
এদিকে হামলার ঘটনায় ন্যায় বিচার চেয়ে মানববন্ধন ও সমাবেশ করেছে বনফুল আদিবাসী গ্রীনহার্ট কলেজের শিক্ষার্থীরা। গত ১৭ ফেব্রুয়ারি মিরপুরে কলেজ ক্যাম্পাসের সামনে অনুষ্ঠিত এই মানববন্ধনে অন্যান্য শিক্ষার্থীদের সাথে বেশ কয়েকজন আহত শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবকরাও অংশগ্রহণ করেন। মানববন্ধন ও সমাবেশকালে শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের নামে করা হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহার, সকল আসামীদের গ্রেফতার, যথাযথ বিচার এবং ধামরাইয়ের আলাদিন পার্কটি সন্ত্রাসী কার্যকলাপের দায়ে বন্ধ করে দেওয়ার দাবী জানান। এসময় শিক্ষার্থীদের কথা মনোযোগসহকারে শুনেন ধামরাই থানার অফিসার ইনচার্জ মনিরুল ইসলাম এবং মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সাব-ইন্সপেক্টর এস এম কাওছার সুলতান। ধামরাই থানার অফিসার ইনচার্জ মনিরুল ইসলাম শিক্ষার্থীদের শান্ত থাকার অনুরোধ করেন এবং আইনের প্রতি আস্থা রেখে ন্যায় বিচার প্রাপ্তির আশ্বাস দেন।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com