বুধবার, ২৬ মার্চ ২০২৫, ০৩:০৭ অপরাহ্ন

৫৪৯ বছরের প্রাচীন গয়ঘর ‘খোজার মসজিদ’

এহসান বিন মুজাহির (শ্রীমঙ্গল) মৌলভীবাজার :
  • আপডেট সময় রবিবার, ২৩ মার্চ, ২০২৫

প্রাচীন স্থাপত্যকলার এক অনন্য নিদর্শন মৌলভীবাজারের ঐতিহাসিক গয়ঘর ‘খোজার মসজিদ’। অপরূপ স্থাপত্যশৈলীর এ মসজিদটি মৌলভীবাজার সদর উপজেলার ১১ নং মোস্তফাপুর ইউনিয়নের গয়ঘর গ্রামে অবস্থিত। সুলতান শামস উদ্দিন ইউছুফ শাহ এর শাসনামলে হাজী আমীরের পৌত্র ও সেই সময়ের মন্ত্রী মজলিস আলম ১৪৭৬ খ্রিস্টাব্দে মসজদিটি নির্মাণ করেন। অপূর্ব নকশা-কারুকার্য সমৃদ্ধ ৫৪৯ বছরের প্রাচীন এ মসজিদটি এখন ইতিহাস-ঐতিহ্যের অংশ। সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, মৌলভীবাজার শহর থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে মোস্তফাপুর ইউনিয়নের গয়ঘর গ্রামের উঁচু স্থানে অবস্থিত মসজিদটিতে প্রবেশের জন্য রয়েছে তিনটি বড় দরজা এবং ছয়টি ছোট দরজা। মসজিদের ভেতরে পশ্চিম পাশের দেয়ালে রয়েছে কৃষ্ণ পাথরের বহু পুরোনো আরবি শিলালিপি। চুরি ঠেকাতে লোহার খাঁচার বেষ্টনী দেওয়া হয়েছে এতে। মসজিদের ভেতরে পূর্ব দিকের দেয়ালের একটি স্তম্ভে রযেছে ‘বাঘের পায়ের চিহ্ন’। এটি এখনও বিদ্যমান। মূল মসজিদ দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে ২৪ হাত করে। মসজিদের চারপাশের ইটের গাঁথুনি ও দেয়ালগুলো অনেক পুরু। দেয়ালের ওপরের দিকে আরবি লেখা ফুল-লতার ছবি আঁকা। মসজিদের উপরে গোল গম্বুজের দেয়ালে আরবিতে লেখা রয়েছে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ। পশ্চিম দেয়ালে একটি অতি প্রাচীন কালো পাথরের লিপি রয়েছে। মসজিদের মেহরাবটি পুরোটাই দেয়ালের ভেতরে। মসজিদের উপরে রয়েছে ১৮ ফুট উঁচু একটি গম্বুজ এবং পরবর্তীতে মসজিদের সাথে সংযুক্ত করা বারান্দায় রয়েছে ছোট আরও তিনটি দৃষ্টিনন্দন গম্বুজ। প্রত্যেক গম্বুজের ভেতরে গোল অংশে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন কারুকাজ। মূল মসজিদের গম্বুজের উপরের অংশ বেশ বড়, যা এখন সাদা টালিযুক্ত। দূর থেকেও মসজিদের দেয়ালের সাদা রঙ জ্বলজ্বল করে। মসজিদের মেঝে এবং বারান্দাও টালিযুক্ত। মসজিদের ভেতরের বিভিন্ন অংশে চোখে পড়ে নানা কারুকার্য। চুন, সুরকি, ইটের গাঁথুনি আর ভেতর ও বাইরের অপরূপ কারুকার্য মসজিদটির সৌন্দর্যকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। মসজিদের সাথে পরবর্তীতে ১৯৮৪ সালে একটি বারান্দা সংযুক্ত করা হয়েছে। এখানে মহিলারা নামাজ পড়েন, কুরআন তেলাওয়াত, তাসবিহ পাঠ করেন। মসজিদের দক্ষিণ পাশে রয়েছে একটি ছোট পুকুর। এখানে কয়েকটি গজার মাছকে খেলা করতে দেখা যায়। মসজিদের সীমার ভেতরে রয়েছে বিশাল একটি ঈদগাহ মাঠ। ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার জামাতে এই ঈদগাহ মাঠে হাজার হাজার মুসল্লিরা অংশ নেন। মসজিদের সীমানার ভেতরের পূর্ব পাশে রয়েছে কবরস্থান। পূর্ব এবং দক্ষিণ পাশে রয়েছে ছোট দুইটি গেইট। দূর থেকে মসজিদ ও কবরস্থানের বাউন্ডারির সাদা রঙ জ্বলজ্বল করে। গ্রামবাসীদের মতে, যখন এ মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছিল তখন এলাকাটি ঘন বনভূমিতে আবদ্ধ ছিল এবং বাঘের আনাগোনা ছিল। আজ পর্যন্ত মসজিদের ভিতর পূর্ব স্তম্ভে বাঘের পায়ের তিনটি চিহ্ন বিদ্যমান। এলাকাবাসী সুত্রে জানা যায়, ১৯৪০ সালে মসজিদের গম্বুজ ভেঙেগেলে গ্রামের মানুষের থেকে চাঁদা সংগ্রহ করে আজম শাহ নামের এক কামেল পীর মসজিদটি সংস্কার করান। ১৯৬০ সালে আরও একবার সংস্কার হয় মসজিদটি। পীর আজম শাহ এরপর মসজিদ ছেড়ে গেলে পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে মসজিদটি। ১৯৬৫-৬৬ সালের দিকে পুনরায় মসজিদটি সংস্কার করা হয়। ১৯৮৪ সালে মসজিদটি সংস্কারের সময় স্থান সংকুলান না হওয়ায় পূর্বদিকে বর্ধিত করা হয়। সেবারে প্রাচীন স্থাপত্যকলার নিদর্শন এ মসজিদটি সংস্কারের সময় কিছুটা আদল পরিবর্তন করা হয়। ফলে মসজিদের পুরনো সৌন্দর্যের অনেকটাই নষ্ট হয়ে যায়। ২০০৯ সালে সর্বশেষ বৃহৎ সংস্কার হয় মসজিদটির। ঐতিহ্য বিবেচনায় এলাকাবাসী ১৯৯৩ সালে মসজিদটি সংরক্ষণে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হয়েছিল। পরে লোকজন এসে মাপজোখ করে যান। কিন্তু এখন পর্যন্ত সাড়া মেলেনি। স্থানীয় বাসিন্দা মিসবাহ উদ্দিন জানান, খোজা মসজিদে সংরক্ষিত শিলালিপির একটি খ- সুলতান বরবক শাহের পুত্র সুলতান শামসুদ্দিন ইউসুফ শাহের শাসনামলে নির্মিত হয়েছিল। ১৪৭৬ খ্রিস্টাব্দে হাজী আমীরের নাতি ও তৎকালীন মন্ত্রী মজলিস আলম এটি নির্মাণ করেন। তবে মসজিদের পূর্ব পাশে দরজার সামনে টাইলসের ওপরে লেখা রয়েছে মসজিদের স্থাপিতকাল ৮৭১ হিজরি, ১৪৭৬ ইংরেজি এবং ৮৭৭ বাংলা এবং স্থাপিতকারীর নাম লেখা রয়েছে সুলতান শামস উদ্দিন ইউছুফ শাহ। এলাকার বাসিন্দা আজমল হোসাইন বলেন, খোজার মসজিদের নামকরণ সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো তথ্য নেই। অনেকে অনেক ধরণের তথ্য দেন। তবে সবচেয়ে প্রচলিত যে কথা, সেটা হলো বাংলার সুবেদার মানসিংহের কাছ থেকে বিতাড়িত হয়ে পলায়নের সময় পাঠান বীর খাজা ওসমান মসজিদটির এ স্থানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেই থেকে খাজা নামের অপভ্রংশ খোজা থেকে এর নামকরণ। খোজার মসজিদের মুয়াজ্জিন হাফেজ এখলাসুর রহমান বলেন, স্থানীয় প্রবীণ লোকজনের কাছ থেকে তিনি শুনেছেন, মসজিদটি ছোট একটি পাহাড়ের উপর নির্মাণ করা হয়েছিল। যখন মসজিদ নির্মিত হয় তখন এই এলাকাটি ঘন জঙ্গলে পরিপূর্ণ ছিল। বিচরণ ছিল বাঘসহ বিভিন্ন বন্য প্রাণীর। তাদের ধারণা সম্ভবত সেই সময় একটি বাঘ মসজিদের রুক্ষ দেয়ালে আঁচড় দিয়েছিল। সেই চিহ্ন মসজিদের দেয়ালে এখনো বিদ্যমান রয়েছে। তিনি বলেন, দেয়লের ওপরে আরবি লিপি রয়েছে। এই শিলালিপিতে কী লেখা রয়েছে কেউ স্পষ্ট বলতে পারেননি। অনেক বড় বড় আলেমরা এসে এই শিলালিপি দেখেছেন, পড়ার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু এতে কী লেখা তাদের পক্ষে বলা সম্ভব হয়নি। খোজার মসজিদের ইমাম মাওলানা আজিজুর রহমান খান রাজু বলেন, অনন্য নির্মাণশৈলীর এ মসজিদটি প্রায় ছয় শতাব্দি ধরে মুসলিম ঐতিহ্যের প্রাচীন ও অন্যতম নির্দশনের পরিচয় বহন করে আসছে। মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজসহ জুমআর নামাজে সহস্রাধিক মুসল্লি অংশ নিয়ে থাকেন। মূল মসজিদে মুসল্লিদের জায়গা সংকুলান না হওয়ায় পরবর্তীতে মূল মসজিদের সাথে মসজিদের পূর্ব পাশে বারান্দা সংযুক্ত করা হয় এবং উত্তর পাশে মহিলাদের নামাজ ও অন্যান্য ইবাদতের জন্য আরেকটি বারান্দা সংযুক্ত করা হয়। জুমআর দিনে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রচুর মুসল্লিরা আসেন। ঐতিহাসিক এ খোজা মসজিদটি দেখার জন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতিদিনই নানা শ্রেণি পেশার মানুষের আগমন ঘটে। স্থানীয়দের দাবি, সাড়ে পাঁচশ বছরের পুরনো ঐতিহাসিক এই মসজিদটি মৌলভীবাজার জেলার গর্ব। ইউনেস্কোতে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে সংরক্ষণের উদ্যোগ গ্রহণে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন তারা। দর্শনার্থীদের থাকার সুব্যবস্থা ও সংরক্ষণসহ সরকারিভাবে মসজিদের আরও উন্নয়নের উদ্যোগ নিলে পুরাতন কীর্তি হিসেবে এটি হতে পারে মৌলভীবাজারে জেলার অন্যতম প্রাচীন ইসলামি স্থাপত্য ঐতিহ্যের নির্দশন।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com