চায়ের রাজধানী ও পর্যটন নগরীখ্যাত মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলায় ১৯৬৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বন্যপ্রাণীকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী সেবা ফাউন্ডেশন। গত কয়েক বছরে অনেকটা বদলে গেছে সেবা ফাউন্ডেশনে আশ্রিত প্রাণীকুল পরিবারের জীবনধারা। প্রায় প্রতিটি প্রাণী জন্ম দিয়েছে বাচ্চা। চলতি মাসের গত ২ এপ্রিল ভোর সাড়ে ৫টায় ফাউন্ডেশনে একটি চিতা বিড়াল বাচ্চা প্রসব করেছে। দুর্লভ প্রজাতির লজ্জাবতী বানর, বেগুনি কালেম, অজগর, গন্ধ-গোকুল, কোন প্রাণীই বাদ যায়নি বাচ্চা প্রসবে। এসব প্রাণী কোলাহলমুক্ত বন্দি খাঁচায় ফিরে পেয়েছে নিজস্ব পরিবেশ। শ্রীমঙ্গল উপজেলার নোয়াগাঁও গ্রামের পশু প্রেমিক সিতেশ রঞ্জন দেব ১৯৬৫ সালে ব্যক্তি উদ্যোগে নিজ গ্রামে প্রতিষ্ঠা করেন বন্য প্রাণী আশ্রয়কেন্দ্র। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় আশ্রয়কেন্দ্রটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। ১৯৭২ সালে শ্রীস চন্দ্র দেবের ছেলে সীতেশ রঞ্জন দেব তাঁর রামকৃষ্ণ মিশন রোডের বাসায় ক্ষুদ্র পরিসরে পুনরায় চালু করেন আশ্রয়কেন্দ্রটি। পরে রূপসপুর গ্রামে নিজের সাড়ে পাঁচ বিঘা জমির খামারবাড়িতে এটি স্থানান্তরর করেন সীতেশ রঞ্জন দেব। স্থানীয়ভাবে এটি সীতেশ বাবুর চিড়িয়াখানা নামে পরিচিত হলেও প্রকৃত নাম বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী সেবা ফাউন্ডেশন। ছুটির দিনসহ প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শিশু-কিশোর, নারী-পুরুষ প্রাণীদের দেখা আর তাদের সঙ্গে পরিচিত হতে এখানে ছুটে আসেন। সম্প্রতি সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, গ্রামীণ নির্মল পরিবেশে খাঁচাবন্দি বন্যপ্রাণীরা কেউ চিৎকার করছে, কেউ খুনসুটিতে মেতেছে। বিশেষ করে মেছো বাঘ বা মেছো বিড়াল, ভল্লুক, উল্লুক, ইমু পাখি, মায়া হরিণ, চিত্রা হরিণ, বিশালাকার অজগর, বানর, চশমা হনুমানসহ নানা প্রজাতির প্রাণীরা বিচরণ করছে নিজেদের মতো করে। পুকুরে দেশি ও পরিযায়ী পাখিরা জলকেলিতে ব্যস্ত। এছাড়া নানা প্রজাতির এসব বন্যপ্রাণী নিজেদের মতো করে খেলায় মত্ত। যে কারো প্রথম দেখায় মনে হতে পারে এটি একটি চিড়িয়াখানা। কিন্তু এটি চিড়িয়াখানা নয়, সম্পূর্ণ ব্যক্তি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত বন্য প্রাণী সেবা ফাউন্ডেশন। গত কয়েক বছরে পাল্টে গেছে এখানকার চিত্র। অনুসন্ধানে জানা যায়, গত ১৩ বছরে লোকলয়ে আসা ৬৫২ বন্যপ্রাণী উদ্ধার করে অবমুক্ত করেছে সংগঠনটি। এছাড়া গত এক বছরে ৩২৬টি বন্যপ্রাণী উদ্ধার করা হয়েছে। এরমধ্যে জীবিত ২২২ এবং মৃত ১০৪ প্রাণী উদ্ধার করা হয়েছে। বন্যপ্রাণী সেবা ফাউন্ডেশন জানায়, ২০১২ সাল থেকে ২০২৫ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত ৬৫২টি বন্যপ্রাণী অবমুক্ত করা হয়েছে। এরমধ্যে অজগর সাপ ১৩১টি, লজ্জাবতী বানর ৪০টি, গন্ধগোকুল ৪৬টি, মেছো বিড়াল ৩৩টি, বানর ২৭টি, তক্ষক ১৭টি, সোনালি বিড়াল ৫টি, বনবিড়াল ৪৫টি, হিমালয়ান পাম সিভেট ১টি, কালনাগিন সাপ ৪টি, হনুমান ১টি, বনরুই ১টি, গুঁইসাপ ৪টি, বন্য শূকর ৩টি, উড়ন্ত কাঠবিড়ালী ৫টি, লেজহীন চিকা ১টি, বোম্বেটিনকেট স্নেক ১টি, ধনেশ পাখি ১টি, কাছিম ৩টি, পেঁচা ১৮টি, সবুজ বুড়াল সাপ ১৪টি, শঙ্খিনী সাপ ১২টি, ফনিমনসা সাপ ৮টি, বিভিন্ন প্রজাতির পাখি ১৩৯টি, শিয়াল ১টি ,পদ্মগোখরা সাপ ৩টি, হিমালয়ান ধূরা সাপ ৫১টি, দুধরাজ সাপ ২টি, দাঁড়াশ সাপ ৭টি, সবুজ বুড়াল সাপ (পিট ভাইপার সাপ) ৬টি, বাজপাখি ২টি, খইয়া গোখরা সাপ ২টি, সবুজ ফনিমনসা সাপ ৩টি, কোবরা (কালা খড়িশ) সাপ ১টি, বিরল লালডোর সাপ ১টি, আইডক্যাট স্নেক ৫টি, কালো বক ১টি, নিশি বক ১টি, রেসাস বানর ১টি, ঘর গিন্নি সাপ ৩টি, গ্রে কেট েেস্নক ১টি, ক্যান্টরের (কুকরী) সাপ ১টি এবং মেটে সাপ ১টি। বন্যপ্রাণী ফাউন্ডেশনে দুর্লভ ও বিলুপ্তপ্রায় নানা প্রজাতির অর্ধশতাধিক বন্যপ্রাণী রয়েছে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য মেছো বিড়াল বা মেছো বাঘ, ভল্লুক, উল্লুক, চশমা হনুমান, গাধা, লজ্জাবতী বানর, চিত্রা হরিণ, মায়া হরিণ, ইমু পাখি, গন্ধগোকুল, অজগর, শঙ্খিনীসহ বিভিন্ন প্রজাতির সাপ, সাধারণ প্রজাতির বানর, ধূসর বানর, সোনালি বিড়াল, বন বিড়াল, হিমালয়ান পাম সিভিট, হনুমান, বনরুই, গুইসাপ, গোখরা, কাল নাগিনি, বন্য শূকর, উড়ন্ত কাঁঠবিড়ালি, বোম্বেটিনকেট গ্লেইক, ধনেশ পাখি, কাছিম, পেঁচা, বাজপাখি, শকুন, ময়নাসহ বিভিন্ন প্রজাতির পাখি। শ্রীমঙ্গল শহর থেকে কমলগঞ্জের লাউয়াছড়া বনের দূরত্ব প্রায় ৮ কিলোমিটার, চাউতলী বনের দূরত্ব ১০ কিলোমিটার এবং কালাছড়া বনের দূরত্ব ১৫ কিলোমিটার। ধারণা করা হচ্ছে এসব বন থেকে খাবারের সন্ধানে কখনও দলছুট হয়ে আবার কখনও দল বেঁধে শহর ও শহরতলিতে আসে বন্যপ্রাণীরা লোকালয়ে এসে মানুষের রোষানলে পড়ে বা সড়ক দুর্ঘটনায় আহত প্রাণীদের এখানে ঠাই হয়।
বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবসসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় দিবসে বন্যপ্রাণী সেবা ফাউন্ডেশন থেকে নানা প্রজাতি ও বিলুপ্তপ্রয় বন্যপ্রাণী বনে অবমুক্ত করা হয়। বন্যপ্রণী সেবা ফাউন্ডেশনের পরিচালক স্বপন দেব সজল বলেন, আহত বন্যপ্রাণীকে উদ্ধার করে আমরা সেবার মাধ্যমে সুস্থ করে বন বিভাগের কাছে হস্তান্তর করি। পরে বন বিভাগ বনাঞ্চলে অবমুক্ত করেবন্যপ্রাণীকে। এছাড়া আমাদের এখানে জন্ম নেওয়া প্রাণীগুলো এককভাবে জীবনযাপনে সক্ষম হলেই বনে ছেড়ে দেওয়া হয়। তবে বনাঞ্চলে ছাড়ার পরও খাদ্য ও বাসস্থানের সংকটে অনেক প্রাণী আবার লোকলয়ে এসে ধরা পড়ে।
পরে এসব প্রানীকে উদ্ধার করে বন বিভাগে হস্তান্তর করা হয়। বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী সেবা ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান সিতেশ রঞ্জন দেব বলেন, খাদ্য ও বাসস্থানের সন্ধানে লোকালয়ে আসা প্রাণীদের উদ্ধার করে নিবিড় পর্যবেক্ষণ, সেবা ও চিকিৎসা দিয়ে পুনরায় বনে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। যে প্রাণীগুলো বনের পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে না বা সুস্থ নয়, এমন প্রাণীদের এখানে রেখেই পরিচর্যা করা হয়। বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) জামিল মোহাম্মদ খান বলেন, বন্যপ্রাণী সেবা ফাউন্ডেশন থেকে অক্ষত অবস্থায় যেসব বন্য প্রাণী আমাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছিল সেসব জীবিত বন্য প্রাণীকে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে অবমুক্ত করা হঢেছে এবং মৃত প্রাণীকে মাটি চাপা দেওয়া হয়েছে।