আন্তর্জাতিক শিশু শান্তি পুরস্কার নিয়ে নড়াইলে এলেন সাদাত রহমান। শনিবার সকালে যশোর বিমানবন্দর থেকে সাদাতকে নিয়ে আসেন তার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আব্দুল হাই ডিগ্রী কলেজের শিক্ষকবৃন্দ এবং তার সংগঠনের সংশ্লিষ্টরা। বিমানবন্দরে এ সময় তাকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানান আব্দুল হাই ডিগ্রী কলেজের অধ্যক্ষ মনিরুজ্জামান মল্লিক। সাদাত নড়াইল পৌঁছালে নড়াইল প্রেসক্লাবের পক্ষ থেকে তাকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানানো হয়। এ সময় নড়াইল প্রেসক্লাবের সভাপতি এনামুল কবীর টুকু, সাধারণ সম্পাদক শামীমুল ইসলাম টুলুসহ সংশ্লিষ্টরা উপস্থিত ছিলেন। আন্তর্জাতিক শিশু শান্তি পুরস্কার প্রাপ্ত সাদাত রহমান বলেন, বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করে বিজয়ী হওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। আমি আমার সাধ্যমত চেষ্টা করেছি নড়াইল তথা দেশের জন্য কাজ করার। এ পুরস্কার পেয়ে সত্যিই আমি আনন্দিত।
তিনি আরো বলেন, আমি পুরস্কারের প্রাপ্ত একলাখ ইউরো ‘সাইবার টিনস’ অ্যাপসটি উন্নয়নের জন্য কাজ করবো পাশাপাশি দেশব্যাপী সাইবার বুলিং ও সাইবার ক্রাইম থেকে শিশুদের রক্ষার জন্য এ অর্থ ব্যয় করা হবে।
নড়াইলের জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসনসহ নড়াইলের সর্বস্তরের জনগণের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন সাদাত রহমান। সাদাত রহমানের পিতা সাখাওয়াত হোসেন এবং মাতা মলিনা খানম বলেন, আমাদের সন্তান আন্তর্জাতিক শিশু শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হওয়ায় আমরা খুবই আনন্দিত। নড়াইলসহ দেশবাসীর কাছে সন্তানের জন্য দোয়া কামনা করেন তারা। সাইবার অপরাধ থেকে শিশুদের সুরক্ষা নিয়ে কাজ করে তিনি ‘শিশুদের নোবেল খ্যাত আন্তর্জাতিক শিশু শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হন। গত ১৩ নভেম্বর নেদারল্যান্ডসে চূড়ান্ত পর্বে সাদাতের নাম ঘোষণা করেন কর্তৃপক্ষ। এরপর নোবেলজয়ী পাকিস্তানের মালালা ইউসুফজাই বিজয়ী সাদাত রহমানের হাতে ভার্চুয়াল কনফারেন্সের মাধ্যমে পুরস্কার তুলে দেন।
সাদাতের সঙ্গে চূড়ান্ত তালিকায় স্থান পাওয়া অন্য দুজন প্রতিযোগী ছিলেন মেক্সিকোর ইভান্না ওরতেজা সেরেট ও আয়ারল্যান্ডের সিয়েনা ক্যাস্টেলন। ৪২টি দেশের ১৪২ জন শিশুর মনোনয়নের মধ্যে দিয়ে এই প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিলো। আড়ম্বরপূর্ণ এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ওই পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত এক বা একাধিক শিশুর নাম আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হবে। এরপর নোবেলজয়ী মালালা ইউসুফজাই বিজয়ীর হাতে পুরস্কার তুলে দেন।
জানাগেছে, ২০০৫ সালে রোমে অনুষ্ঠিত নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ীদের এক শীর্ষ সম্মেলন থেকে এই পুরস্কার চালু করে ‘কিডস-রাইটস’ নামের একটি সংগঠন। শিশুদের অধিকার উন্নয়ন ও নিরাপত্তায় অসাধারণ অবদানের জন্য প্রতিবছর আন্তর্জাতিক শিশু শান্তি পুরস্কার দেয়া হয়। ১২ থেকে ১৮ বছর বয়সীরা ওই পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য। গত বছর সুইডেনের শিশু পরিবেশকর্মী গ্রেটা থুনবার্গ ও ক্যামেরুনের ডিভিনা মালম যৌথভাবে মর্যাদাপূর্ণ ওই পুরস্কারে ভূষিত হন। ২০১৩ সালে এই পুরস্কার বিজয়ী মালালা ইউসুফজাই পরের বছর জয় করেছিলেন নোবেল। নড়াইল আবদুল হাই সিটি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্র ১৭ বছর বয়সী সাদাত রহমান। সাদাত ও তার দল সাইবার বুলিং ও সাইবার ক্রাইম থেকে শিশু-কিশোরদের রক্ষায় নানা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। সাদাত সম্পর্কে কিডস রাইটসের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, সাদাত একজন ‘তরুণ চেঞ্জমেকার’ ও সমাজসংস্কারক। সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়ে এক কিশোরীর (১৫) আত্মহত্যার পর কাজে নামে সাদাত। সে তার বন্ধুদের সহায়তায় ‘নড়াইল ভলেন্টিয়ারস’ নামের একটি সামাজিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে। সংগঠনটি বেসরকারি সংস্থা একশনএইডের ‘ইয়ুথ ইনোভেশন চ্যালেঞ্জ–২০১৯ এ বিজয়ী হয়ে তহবিল পায়।
এই তহবিলের মাধ্যমে তারা ‘সাইবার টিনস’ মোবাইল অ্যাপ তৈরি করে। এই অ্যাপের মাধ্যমে কিশোর- কিশোরীরা জানতে পারে কীভাবে ইন্টারনেট দুনিয়ায় সুরক্ষিত থাকতে পারে। প্রায় ১হাজার ৮০০ কিশোর-কিশোরী এই অ্যাপ ব্যবহার করছে। এই অ্যাপের মাধ্যমে ৬০টির বেশি অভিযোগের মীমাংসা হয়েছে এবং ৮ জন সাইবার অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত হয়েছে। বর্তমানে সাদাত ‘সেফ ইন্টারনেট, সেফ টিনএজার’ নামের একটি কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। তিনি এবং তার বন্ধুরা ইন্টারনেট নিরাপত্তা নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে স্কুলে স্কুলে সেমিনার–, কর্মশালা করছে। প্রতিটি স্কুলে ‘ডিজিটাল স্বাক্ষরতা ক্লাব’ প্রতিষ্ঠায় কাজ করছেন।
সাদাত রহমান জানান, সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়ে পিরোজপুরের দশম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার ঘটনা তাকে নাড়া দেয়। দেশে এ ধরনের আরো ঘটনা ঘটছে। এক হিসাবে দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রায় ৪৯ শতাংশ কিশোর-কিশোরী এ রকম সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়। কিন্তু নিজেদের সমস্যা কাউকে বলতে পারে না তারা। পুলিশ তো দুরের কথা, অনেকেই নিজের মা-বাবাকেও এ ব্যাপারে কিছু জানায় না। শেষ পর্যন্ত অনেকেই আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।
সাদাত আরো বলেন, এ ধরনের উপলব্ধি থেকে সাইবার বুলিংয়ের শিকার হওয়া শিশু-কিশোরদের সাহায্য করতে অনলাইন প্লাটফর্ম সাইবার টিনসের যাত্রা শুরু করা হয় গত বছর অক্টোবর মাসে। এই অ্যাপের মাধ্যমে ভুক্তভোগী কিশোর-কিশোরীদের সঙ্গে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার যোগাযোগ সৃষ্টি করা হয়। প্রথমত, ভুক্তভোগীকে মানসিক সাপোর্ট দেয়া হয়। অভিযুক্তকেও নিবৃত্ত করার চেষ্টা করা হয়। তবে বিষয়টি অপরাধ পর্যায়ে পৌঁছালে পুলিশ বিভাগকে জানানো হয়। সাদাত ‘সাইবার টিন্স’ নামে একটি অ্যাপ্লিকেশন চালু করেছিলেন, যেখানে সাইবার বুলিংয়ের শিকার ব্যক্তিরা তাদের মামলাগুলি রিপোর্ট করতে এবং সহায়তা পেতে পারেন। সাইবার টিন্সের সাথে তার কাজ তাকে ৪২টি দেশের ১৪২ জন মনোনীত দলের দলে দাড় করিয়েছেন। এ বছর নড়াইলের ১৭ বছর বয়সী সাদাত রহমানকে বিজয়ী করা হয়েছে।