রবিবার, ১৮ মে ২০২৫, ১০:৪৩ পূর্বাহ্ন

অন্যায়ের বিরুদ্ধে জীবন দিতে সংকল্পবদ্ধ ছিলেন শহীদ মেহেদী হাসান

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৫

রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর কাজলা এলাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ১৯ জুলাই শহীদ হন ১৮ বছর বয়সী গাড়ির ওয়ার্কশপকর্মী মেহেদী হাসান। সাহস ও দৃঢ়তার প্রতীক হয়ে ওঠা এই কিশোরের মৃত্যু আন্দোলনে এক বেদনাময় মাইলফলক হয়ে রয়ে গেছে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে রাজপথ উত্তাল। আন্দোলন দমাতে মরিয়া হয়ে উঠেছে সরকারের বিভিন্ন বাহিনী। এমন অশান্ত ও সহিংস পরিস্থিতিতে বাড়িতে থাকার জন্য পরিবারের অনুরোধ উপেক্ষা করে ‘ছাত্র ভাইদের’ সঙ্গে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর অদম্য সংকল্প নিয়ে বেরিয়েছিলেন মেহেদী। আর তাতেই শহীদ হন তিনি।
২০২৪ সালের ১৭ জুলাই থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণে রূপ নেয় ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে। এই আন্দোলন দমনে যখন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যাপক দমন-পীড়ন শুরু করে, তখনই শহীদ হন মেহেদী।
মেহেদীর শোকাহত মা পারভীন আক্তার বলেন, ‘আমার ছেলে ১৭ ও ১৮ জুলাই আন্দোলনে অংশ নেয়। ১৮ তারিখ রাতে আমি তাকে জোর করে বাড়ি ফিরিয়ে আনি। তখন অনেক মানুষ মারা যাচ্ছিল, তাই আমরা তাকে যেতে দিইনি।’
তিনি বলেন, ১৯ জুলাই সারাদিন ঘুমিয়ে ছিল মেহেদী। আসরের আজানের সময় সে জেগে ওঠে এবং জানতে চায় কেন তাকে জাগানো হয়নি। পারভীন বলেন, ‘আমি বলি, রাস্তায় পরিস্থিতি খুব খারাপ, তাই ডাকিনি।’
কিন্তু মেহেদীর সংকল্প ছিল অবিচল। সে বলেছিল ‘আমার ছাত্র ভাইরা রাস্তায় মরছে আর আপনি বলছেন আমি বাসায় থাকি? আমি কি এখনও শিশু? আমি ১৮ বছর বয়সী। আমাকে যেতে দিন।’
শেষমেশ যাত্রাবাড়ীর কুতুবখালীর ভাড়া বাসার দরজা তালাবদ্ধ করেও তাকে আটকাতে পারেননি তার বাবা মেহের আলী। ‘আমি আন্দোলনে যাবই… প্রয়োজনে দেশের জন্য শহীদ হব,’ বলেছিল মেহেদী।
মেহের আলী বলেন, ‘আমরা তাকে ঘরে আটকে রাখার চেষ্টা করেছিলাম, কারণ রাস্তায় নির্বিচারে গুলি চলছিল। কিন্তু কিছুতেই আটকাতে পারিনি।’
বাড়ি ছাড়ার আগে মেহেদী গোসল করে, মায়ের দিকে অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে থাকে অনেকক্ষণ। তারপর খেয়ে ১০ টাকা চায়, কিন্তু তখন পারভীনের হাতে কোনো টাকা ছিল না।
শেষ পর্যন্ত আসরের আজানের পর সে বাসা ছাড়ে। মাত্র ১০-১৫ মিনিট পরই কয়েকজন শিশু এসে বলে, মেহেদী গুলিবিদ্ধ হয়েছে এবং শনিরআখড়ার একটি হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।
তখন শুরু হয় তার পরিবারের মরিয়া খোঁজ। শনিরআখড়ার হাসপাতালে না পেয়ে যাত্রাবাড়ীর সব হাসপাতালে খোঁজ করেন তারা। পরে জানতে পারেন, তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।
‘কিন্তু আমরা যখন পৌঁছাই, তখন লাশ মর্গে। শুনে মনে হলো আকাশ ভেঙে পড়েছে,’ বলেন পারভীন।
মর্গে লাশ দেখার সুযোগ না দিয়ে পুলিশ কাগজপত্র আনার জন্য যাত্রাবাড়ী থানায় যেতে বলে। পরদিন (২০ জুলাই) সকালে থানা গেলে পুলিশ খারাপ ব্যবহার করে। পারভীন বলেন, ‘পুলিশ আমাদের গালিগালাজ করে, এমনকি গুলি করার হুমকিও দেয়।’
পরে সন্ধ্যায় এক পুলিশ সদস্য শাহবাগ থানায় যেতে বললে, ২১ জুলাই সকালে তারা আবার ঢাকা মেডিকেল যান এবং অনেক খোঁজাখুঁজির পর পুলিশের সহায়তায় লাশটি শনাক্ত করেন।
২১ জুলাই রাত ৯টার দিকে ময়নাতদন্ত শেষে লাশ বুঝে পায় পরিবার। সেদিন রাতেই তাকে জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীর বরাত দিয়ে পারভীন বলেন, মেহেদী গুলিবিদ্ধ হয় যখন পুলিশ ও আওয়ামী লীগ সমর্থকেরা আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে নির্বিচারে গুলি চালাচ্ছিল। কার গুলিতে সে নিহত হয় তা নিশ্চিত না হলেও, তার পেটের বাঁ পাশে তিনটি গুলির চিহ্ন ছিল।
অর্থনৈতিকভাবে সংগ্রামী পরিবারে জন্ম মেহেদীর। তার বাবা মেহের আলী (৪৯) আগে বাড়ি-বাড়ি গিয়ে আবর্জনা সংগ্রহ করতেন, বর্তমানে অটোরিকশা চালান। মা পারভীন আক্তার (৩৫) একজন গৃহিণী।
চার ভাইবোনের মধ্যে দ্বিতীয় মেহেদী পরিবারের আর্থিক বোঝা বহনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত। বড় বোন শ্রাবণী বিবাহিত। ছোট ভাই রমজান আলী (১৪) মেহেদীর মৃত্যুর পর একটি দরজার কারখানায় কাজ শুরু করেছে। সবচেয়ে ছোট ভাই ইয়াসিন (৯) যাত্রাবাড়ী বড় কওমি মাদ্রাসায় পড়ে।
“আমাদের তিন ছেলের মধ্যে মেহেদী ছিল বড়। পরিবারে তার ভূমিকা ছিল সবচেয়ে বেশি,’ বলেন শোকসন্তপ্ত পারভীন।
মেহেদীর মৃত্যুতে পরিবার ভেঙে পড়েছে। ছোট ভাই রমজানকে সংসার চালাতে কাজে নামতে হয়। পারভীন বলেন, ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে আমরা ৫ লাখ টাকা ও জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে ২ লাখ টাকা পেয়েছি।’
মেহের আলী জানান, জামায়াতের দেওয়া টাকা দিয়ে একটি অটোরিকশা কিনে তিনি আবর্জনা সংগ্রহের অস্বাস্থ্যকর কাজ ছেড়ে দেন।
পরিবারের দাবি, মেহেদীর হত্যার সঙ্গে জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তি—খুনিদের মৃত্যুদ- দাবি করেন তারা।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com