কথাসাহিত্যিক রাবেয়া খাতুনের জানাজা সম্পন্ন হয়েছে। গতকাল সোমবার (৪ জানুয়ারি) দুপুর তিনটায় চ্যানেল আই প্রাঙ্গণে তার জানাজা সম্পন্ন হয়। জানাজায় উপস্থিত ছিলেন দেশের শিল্প সাহিত্য অঙ্গন থেকে শুরু করে রাজনীতি, সংস্কৃতি ও সিনেমা অঙ্গনসহ সর্বস্তরের মানুষ।
জানাজা শুরুর আগে পরিবারের পক্ষে কথা বলেন রাবেয়া খাতুনের জামাতা, ইমপ্রেস টেলিফিল্ম লিমিটেড এর পরিচালক ও প্রকৃতি বন্ধু মুকিত মজুমদার বাবু। রাবেয়া খাতুনের আত্মার শান্তি কামনায় দোয়া প্রার্থনা করেন তিনি। ইহলোকে যেরকম যত্নে ছিলেন রাবেয়া খাতুন, পরকালেও যেন তিনি এরকম যত্নে থাকেন- এই কামনায় জানাজায় উপস্থিত সকলের কাছে দোয়া চান চ্যানেল আইয়ের পরিচালক ও বার্তা প্রধান শাইখ সিরাজ।
জানাজা শেষে রাবেয়া খাতুনের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বনানী কবরস্থানে। এরআগে দুপুর ১২টার দিকে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য রাবেয়া খাতুনের মরদেহ রাখা হয় বাংলা একাডেমির নজরুল মঞ্চের বেদিতে। সেখানে প্রায় ঘন্টা খানেক রাখা হয়। সাহিত্য সংস্কৃতি অঙ্গনের মানুষের পাশাপাশি এসময় রাবেয়া খাতুনকে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান সাধারণ পাঠকও। এসময় বাংলা সাহিত্যের গুণী এই লেখিকাকে শ্রদ্ধা জানাতে ছুটে আসেন তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ। স্বাধীনতা পুরস্কার, একুশে পদক ও বাংলা একাডেমিসহ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক রাবেয়া খাতুন। রবিবার বিকেলে বাধ্যর্কজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৬ বছর।
মহিয়সী এই নারীর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এক শোক বার্তায় রাষ্ট্রপতি বলেন, “রাবেয়া খাতুনের মৃত্যু দেশের সাহিত্য অঙ্গনের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। বাংলা সাহিত্যের প্রসারে তার অবদান চিরদিন স্মরণীয় হয়ে থাকবে।” রাষ্ট্রপতি মরহুমা রাবেয়া খাতুনের রুহের মাগফিরাত কামনা করেন এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
রাবেয়া খাতুনের মৃত্যুতে দেশের সাহিত্য ও শিল্প সংস্কৃতি অঙ্গনে শোক নেমে এসেছে। গভীর শোকাহত চ্যানেল আই পরিবার। ছিয়াশি বছরে মারা যাওয়া রাবেয়া খাতুন সাহিত্যের সকল শাখায় সফলভাবে বিচরণ করেছেন। দীর্ঘ জীবনে তিনি বাংলা সাহিত্যকে যেমন সমৃদ্ধ করেছেন তেমনি ভূষিত হয়েছেন অসংখ্য পুরস্কারেও।
বাংলা সাহিত্যে উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম রাবেয়া খাতুন। ১৯৩৫ সালে বিক্রমপুরে জন্ম তার। লেখালেখির পাশাপাশি শিক্ষকতা এবং সাংবাদিকতাও করেছেন। উপন্যাস, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, কিশোর উপন্যাস, স্মৃতিকথাসহ চলচ্চিত্র ও নাট্য জগতেও বিচরণ রাবেয়া খাতুনের। তার মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস ‘মেঘের পরে মেঘ’ জনপ্রিয় একটি চলচ্চিত্র। ‘মধুমতি’ এবং ‘কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টিও প্রশংসিত হয়েছে সব মহলে। তার স্বামী প্রয়াত এটিএম ফজলুল হক ছিলেন দেশের চলচ্চিত্র বিষয়ক প্রথম পত্রিকা সিনেমার সম্পাদক ও চিত্রপরিচালক। বাংলাদেশের প্রথম শিশুতোষ চলচ্চিত্র ‘প্রেসিডেন্ট’ এর পরিচালকও তিনি।
১৯৫২ সালের ২৩ জুলাই এটিএম ফজলুল হক ও রাবেয়া খাতুনের বিয়ে হয়। তাদের চার সন্তানের মধ্যে রয়েছে ফরিদুর রেজা সাগর, কেকা ফেরদৌসী, ফরহাদুর রেজা প্রবাল ও ফারহানা কাকলী।
বাংলা একাডেমি, চলচ্চিত্র জুরী বোর্ড, লেডিস ক্লাব, বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ, মহিলা সমিতিসহ অসংখ্য সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলেন রাবেয়া খাতুন। কথাসাহিত্যিক হিসেবে পরিচিত হলেও রাবেয়া খাতুন এক সময় শিক্ষকতা করেছেন। সাংবাদিকতার সঙ্গেও দীর্ঘদিন যুক্ত ছিলেন। ইত্তেফাক, সিনেমা পত্রিকা ছাড়াও তার নিজস্ব সম্পাদনায় পঞ্চাশ দশকে বের হতো ‘অঙ্গনা’ নামের একটি মহিলা মাসিক পত্রিকা।
তার প্রকাশিত পুস্তকের সংখ্যা একশ’রও বেশি। এর মধ্যে রয়েছে উপন্যাস, গবেষণাধর্মী রচনা, ছোটগল্প, ধর্মীয় কাহিনী, ভ্রমণকাহিনী, কিশোর উপন্যাস, স্মৃতিকথা ইত্যাদি। রেডিও, টিভিতে প্রচারিত হয়েছে অসংখ্য নাটক, জীবন্তিকা ও সিরিজ নাটক। তার গল্পে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে কয়েকটি।
রাবেয়া খাতুন উপন্যাস লিখেছেন পঞ্চাশটিরও বেশি। এ পর্যন্ত চার খণ্ডে সংকলিত ছোটগল্প সংখ্যায় চারশ’র বেশি। ছোটদের জন্য লেখা গল্প-উপন্যাসও সংখ্যায় কম নয়। রাবেয়া খাতুন বাংলাদেশের ভ্রমণ সাহিত্যের প্রধানতম লেখক। প্রথম উপন্যাস মধুমতী (১৯৬৩) প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই শক্তিমান কথাসাহিত্যিক হিসেবে পরিচিতি পান। ক্ষয়িষ্ণু তাঁতি সম্প্রদায়ের জীবন সংকট ও উঠতি মধ্যবিত্ত জীবনের অস্তিত্ব জিজ্ঞাসার মধ্যে ব্যক্তিকে আবিষ্কার করেছিলেন রাবেয়া খাতুন এই উপন্যাসে। রাবেয়া খাতুন ভ্রমণ সাহিত্য রচনাকে গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যকর্ম হিসেবে বিবেচনা করেছেন বলে তার ভ্রমণ সাহিত্যের বইও অনেক। বেশকিছু আত্মজৈবনিক স্মৃতিমূলক রচনা লিখেছেন। একাত্তরের নয় মাস (১৯৯০) বইয়ে লিখেছেন একাত্তরের শ্বাসরূদ্ধকর দিনগুলোর কথা।
সাহিত্যচর্চার জন্য পুরস্কার হিসেবে পেয়েছেন একুশে পদক (১৯৯৩), বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৭৩), নাসিরুদ্দিন স্বর্ণপদক (১৯৯৫), হুমায়ূন স্মৃতি পুরস্কার (১৯৮৯), কমর মুশতারী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৪), বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ পুরস্কার (১৯৯৪), শের-ই-বাংলা স্বর্ণপদক (১৯৯৬), ঋষিজ সাহিত্য পদক (১৯৯৮), লায়লা সামাদ পুরস্কার (১৯৯৯) ও অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৯)। ছোটগল্পের জন্য পেয়েছেন নাট্যসভা পুরস্কার (১৯৯৮)। সায়েন্সফিকশন ও কিশোর উপন্যাসের জন্য পুরস্কৃত হয়েছেন শাপলা দোয়েল পুরস্কার (১৯৯৬), অতীশ দীপঙ্কর পুরস্কার (১৯৯৮), ইউরো শিশুসাহিত্য পুরস্কার (২০০৩)। ছোটগল্প ও উপন্যাসের চলচ্চিত্রায়ন হয়েছে প্রেসিডেন্ট (১৯৬৬), কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি (২০০৩), মেঘের পরে মেঘ (২০০৪), ধ্রুবতারা, মধুমতি (২০১০)। টিভি নাটকের জন্য পেয়েছেন টেনাশিনাস পুরস্কার (১৯৯৭), বাচসাস (বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি) পুরস্কার, বাংলাদেশ কালচারাল রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন মিলেনিয়াম অ্যাওয়ার্ড (২০০০), টেলিভিশন রিপোর্টার্স অ্যাওয়ার্ডসহ (২০০০) তিনি এ পর্যন্ত অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা অর্জন করেছেন।