বর্ষীয়ান রাজনীতিক সাবেক এমপি এবং সাবেক শ্রম ও জনশক্তি প্রতিমন্ত্রী খালেদুর রহমান টিটো ইন্তেকাল করেছেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিলো ৭৬ বছর। গত শনিবার দুপুর ১টা ২০ মিনিটে যশোর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে মৃত ঘোষণা করেন। যশোর-২ আসনের সংসদ সদস্য মেজর জেনারেল (অব.) মুক্তিযোদ্ধা ডা. নাসির উদ্দিন বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে মরদেহ তার বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এর আগে সকাল ১০টার দিকে শারীরিক অবস্থা গুরুতর হলে তাকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। তার মেঝো ছেলে অ্যাড. খালিদ হাসান জিউস জানান, ফুসফুসে ইনফেকশন জনিত কারণে তিনদিন আগে তাকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আজ সকাল ১০টার দিকে অবস্থার অবনতিতে তাকে লাইফ সাপোর্টে দেয়া হয়।
খালেদুর রহমান টিটো ১৯৪৫ সালের ১ মার্চ কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা মরহুম অ্যাডভোকেট হবিবুর রহমান। তিনি একজন এমএ, বিএল ছিলেন। মা মরহুম করিমা খাতুন একজন এমএ, এম-এড ছিলেন। সাত ভাইবোনের মধ্যে টিটো দ্বিতীয়। বড়ভাই মাসুকুর রহমান তোজো ১৯৭১ সালে রাজাকার বাহিনীর হাতে নৃশংসভাবে খুন হন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে ডবল অনার্স নিয়ে ফিজিক্সে মাস্টার্স পাশ করেছিলেন।
খালেদুর রহমান টিটোর শিক্ষাজীবন শুরু হয় যশোর জেলা স্কুলে। ১৯৬০ সালে এখান থেকে তিনি ম্যাট্রিক পাশ করেন। ১৯৬৩ সালে ঢাকার কায়েদে আজম কলেজ হতে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। ১৯৬৭ সালে কারাগারে অবস্থানকালে যশোর এমএম কলেজ থেকে গ্রাজুয়েশন করেন। পরবর্তীতে মাস্টার্স করতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যান বিভাগে ভর্তি হয়েও রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে মাস্টার্স আর শেষ করা সম্ভব হয়নি।
খালেদুর রহমান টিটো রাজনৈতিক পরিম-লের মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠেছেন। ১৯৬৩ সালে যশোর এমএম কলেজ ছাত্র ইউনিয়নে সম্পৃক্ততার মধ্যদিয়ে রাজনীতিতে সক্রিয় হন।
১৯৬৭ সালে কলেজের লেখাপড়া শেষে করে তিনি শ্রমিক রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৬৯ সালের শেষের দিকে তিনি কৃষক আন্দোলন জোরদার করতে কোটচাঁদপুর, মহেশপুর ও কালীগঞ্জ এলাকায় ভ্রমণ করেন। ১৯৭০ সালের শেষের দিকে তার সাথে দলের রাজনৈতিক মতবিরোধ সৃষ্টি হয়। শ্রেণিশত্রু উৎপাটনের পদ্ধতিকে তিনি মেনে নিতে পারেননি। ফলে এক সময়ে দল থেকে বের হয়ে আসেন।
এ সময় তিনি পুলিশি অভিযানের কারণে কুষ্টিয়াতে চলে যান। ওই বছরের মার্চ মাসে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি আবার ভারতে চলে যান। বাম রাজনীতির সাথে জড়িত থাকার কারণে সেখানে তিনি শান্তিতে থাকতে পারেননি। আবার পূর্ব পাকিস্তানেও ঢুকতে পারতেন না। এর কারণ হিসেবে ঐ সময় পাক আর্মি তার মাথার দাম ধার্য করেছিলো ১০ হাজার টাকা। স্বাধীনতার পর তিনি দেশে ফিরে আসেন। ইতোমধ্যে বড়ভাই মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হলে সংসারের দায়িত্ব তার কাঁধে এসে পড়ে। সাংসারিক ব্যয়ভার বহন করার জন্য এ সময় তিনি ব্যবসা শুরু করেন এবং আব্দুস সামাদ মেমোরিয়াল স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি গ্রহণ করেন। ১৯৭৪ সালের প্রথমদিকে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ভাসানী-ন্যাপ) এ যোগদান করেন। ১৯৭৪ সালেই ন্যাপের জেলা সম্পাদকের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।
১৯৭৮ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় তিনি ন্যাপের পক্ষ থেকে তাকে সমর্থন করেন। নির্বাচনের পর বিএনপি নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠিত হলে তিনি ন্যাপের সাথেই থেকে যান। ১৯৮১ সালে ‘গণতান্ত্রিক পার্টি’ গঠিত হলে তিনি এই রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যোগ দেন। গণতান্ত্রিক পার্টির ১১জন স্টান্ডিং কমিটির মেম্বারদের মধ্যে তিনি ছিলেন একজন। ১৯৮৪ সালে যশোর পৌরসভার নির্বাচনে তিনি জয়লাভ করেন। ১৯৮৬ সালে তিনি জাতীয় পার্টি পক্ষ থেকে এমপি নির্বাচিত হন। ১৯৮৭ সালে তিনি জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক হন। ১৯৯০ সালের মে মাসে তিনি শ্রম ও জনশক্তি প্রতিমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। সরকার পতনের ফলে ১৯৯১ সালে তাকে জেলে যেতে হয়। ১৯৯১ এর শেষে জাতীয় পার্টির মহাসচিব হন। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে পরাজয়ের পর পার্টির চেয়ারম্যান জেনারেল এরশাদের সাথে তার মতবিরোধ হয়। এ সময় বিএনপি’র চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া তাকে বিভিন্ন প্রতিশ্রুতির মধ্যদিয়ে তার দলকে সহযোগিতা করার প্রস্তাব দেন। ২০০১ সালের নির্বাচনে তাকে দেয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করলে তিনি নির্বাচন বয়কট করেন।
২০০৫ সালে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা খালেদুর রহমান টিটোকে তার দলে যোগদানের জন্য আহবান জানান। ২০০৬ সালে ১১ জানুয়ারি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা গ্রহণের করে প্রায় ২ বছর শাসনকার্য চালায়। অবশেষে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২০০৮ সালের ২৯ জানুয়ারি সংসদ নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ করলে যশোর থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে নমিনেশন পান আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি আলী রেজা রাজু। কিন্তু কিছু দিন পর মি. রাজুর নমিনেশন প্রত্যাহার করে খালেদুর রহমান টিটোকে যশোর সদর আসনে নমিনেশন দেয়া হয়। খালেদুর রহমান টিটো তার প্রতিপক্ষ বিএনপি নেতা, সাবেক মন্ত্রী তরিকুল ইসলামকে নির্বাচনে পরাজিত করে যশোর সদর আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
১৯৭২ সালের ১৮ মে যশোর শহরের চুটিপট্টির মেয়ে রওশন আরা বেগমের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের তিন ছেলে। ২০০৭ সালে তার স্ত্রী মারা যান।