গাধা হাতির হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে হাতির পতন হোয়াইট হাউজকে এনে দিয়েছে ডেমোক্র্যাটদের দখলে। বাইডেনের নির্বাচনি যাত্রার শুরু থেকেই অনুমান করা হচ্ছিল, রাজনীতির বৈশ্বিক পরিক্রমায় ঘটতে যাচ্ছে পরিবর্তন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণের পর প্রথম কর্মদিবসে বাইডেন ও দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টোনি ব্লিনকেন কর্তৃক পরিবর্তিত পররাষ্ট্রনীতি ঘোষণার ফলে সত্য হতে চলেছে অনুমিত সব জল্পনাকল্পনা। মার্কিন প্রেসিডেন্ট শুধু একজন রাষ্ট্রপ্রধান নন, বরং পুরো বিশ্বের রাজনৈতিক মোড়ল, তার চাওয়াতেই পালটায় রাষ্ট্রীয় সম্পর্কের সমীকরণ, বদলায় রাজনৈতিক হিসাবনিকাশ। রাজনীতির বৈশ্বিক চক্রের মতোই মার্কিন প্রেসিডেন্টের হাত ধরে প্রবর্তিত হয় মধ্যপ্রাচ্যের ভাগ্যও। রাষ্ট্রপতির রদবদলে মার্কিনিদের বিদেশনীতির উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের ইতিহাস না থাকলেও গত মেয়াদে অনেকটাই খেল দেখিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন। মধ্যপ্রাচ্যনীতিতে আমূল পরিবর্তন ও ইসরাইল ঘেঁষা আচরণে মধ্যপ্রাচ্যের ইসলামপন্থি দেশগুলোর মধ্যে জন্মেছিল চরম অসন্তোষ। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর প্রতি ভারসাম্যহীন ট্রাম্পনীতির জন্য একাধিকবার সমালোচিত হতে হয়েছে পূর্বসূরি এই প্রশাসনকে? তবে নির্বাচনের শুরু থেকে বাইডেনের মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক মন্তব্যে আশা জেগেছে আরব বিশ্বে।
পূর্বের শর্ত মানার সাপেক্ষে বাইডেন ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তিতে ফেরাসহ অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের যেই আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন, তা নিঃসন্দেহে ইরানের জন্য একাদশে বৃহস্পতি। মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশটির সঙ্গে ছয় জাতির চুক্তিতে ফেরার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন তিনি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা, বাইডেনের হাত ধরে উন্মোচিত হতে পারে ওয়াশিংটন-তেহরান সম্পর্কের শুভ সূচনা। তবে ইরানের প্রতি আন্তরিক হলেও মার্কিনিদের স্বভাবজাত ভারসাম্যমূলক নীতি থেকে পিছু হটবে না ওয়াশিংটন। পরমাণু চুক্তি পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসরণ করলে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি আরো চুক্তিতে যেতে পারে বলে জানিয়েছে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্ব্বী তেহরানের সঙ্গে ওয়াশিংটনের এই ঘনিষ্ঠতা নিঃসন্দেহে নাখোশ করছে রিয়াদকে? অপরদিকে বাইডেন কর্তৃক সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ক পর্যালোচনার বিবৃতিও সেই সম্ভাবনারই সাক্ষ্য দিচ্ছে। ইয়েমেনে সৌদি নেতৃত্বাধীন যুদ্ধে মার্কিন সমর্থন বন্ধের সোজাসাপটা ঘোষণায় আমেরিকা বনাম ট্রাম্পঘেঁষা সৌদির সম্পর্ক নতুন মোড় নিতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সম্প্রতি সৌদি ও আমিরাতের সঙ্গে অস্ত্র চুক্তি স্থগিতাদেশ ও অস্ত্র বিক্রি বন্ধের ঘোষণায় মার্কিন মহলের সঙ্গে এ দুই দেশের সম্পর্কের নতুন মোড়ে ঘটতে পারে বড়োসড়ো বাঁক বদল। বাইডেনের নির্বাচনি প্রচারণায় উপসাগরীয় দেশগুলোর ওপর সৌদি আগ্রাসন বন্ধ করার মর্মে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তা-ই যেন কালক্রমে প্রতীয়মান হতে চলেছে।
মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব বলয় বিস্তারের ব্যাপারটি ছাড়াও প্রতিপক্ষ রাশিয়ার কাছ থেকে ‘এস-৪০০’ মিসাইল ক্রয়ের জেরে তুরস্কের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যে মৌন সংঘাত চলে আসছিল তা ডালপালা মেলে বৃহৎ বিপত্তির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে তুরস্কের জন্য ? আপাতত বলা যায়, মধ্যপ্রাচ্যের নব্য এই পরাশক্তির বিস্তৃতি রোধকল্পে একে অর্থনৈতিক ভাবে কোণঠাসা করাই হবে ডেমোক্র্যাটদের নয়া তুরস্কনীতি।
বাইডেন নির্বাচনি প্রচারণার শুরু থেকেই ইসরাইল-ফিলিস্তিন সমস্যার দ্বি-রাষ্ট্রিক সমাধান চান বলে জানিয়ে আসছিলেন। ইসরাইলে অধিকৃত পশ্চিম তীরে বসতি নির্মাণের মতো পক্ষপাতী কর্মকা-ের বিরোধিতা করলেও ইসরাইলের মার্কিন দূতাবাস জেরুজালেম থেকে সরাচ্ছেন না নয়া এই রাষ্ট্রপ্রধান। ফিলিস্তিন ও ইসরাইল উভয়ের সঙ্গে বাইডেন বিশ্বস্ততার সম্পর্ক গড়তে চান, তবে জায়নবাদী আমেরিকা তার দীর্ঘদিনের মিত্র ইসরাইলের পক্ষপাতিত্ব থেকে সহজে সরে দাঁড়াবে না বলে ধারণা বিশ্লেষক মহলের। ফিলিস্তিনের ন্যায্য দাবি আদায়ে বাইডেন ইসরাইলের স্বার্থের বিপক্ষে না গেলেও ট্রাম্পের রহিত করা ফিলিস্তিনিদের প্রতি ৬০০ মিলিয়ন ডলার বার্ষিক সহায়তা পুনরায় চালু করতে পারে বাইডেন প্রশাসন। দীর্ঘমেয়াদি সমাধান না হলেও আপাতত এটুকুই স্বস্তি ফেরাতে পারে ফিলিস্তিনে। তালেবানদের সঙ্গে গত বছর স্বাক্ষরিত মার্কিন চুক্তি খতিয়ে দেখার বিষয়ে বাইডেন সরকারের মন্তব্যে আফগানিস্তান প্রসঙ্গে তৈরি হয়েছে ধোঁয়াশা। অপরদিকে ইয়েমেন ও সিরিয়াকে ঘিরে নীতিগত পরিবর্তনের খুব একটা আভাস দেখা না গেলেও জাতিসংঘের জানানো আহ্বানের পরিপ্রেক্ষিতে ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীদের ওপর ট্রাম্প সরকারের আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছেন বাইডেন? ডেমোক্র্যাটদের বিদেশনীতির পরিবর্তিত রূপ দেখতে হতে পারে ইয়েমেনবাসীদেরও। এটুকু বলা যায়, মধ্যপ্রাচ্যে ট্রাম্পনীতির অবসান ও আরব বিশ্বের দেশগুলোর সঙ্গে গঠনমূলক সম্পর্ক বজায় রেখে কূটনৈতিক স্বার্থ হাসিলের পথেই হাঁটবেন বাইডেন? শুরুটা ভালো, তবে শেষটায় মধ্যপ্রাচ্যের জন্য কী অপেক্ষা করছে তা সময় বলে দেবে?
লেখক :শিক্ষার্থী আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ