অস্থির হয়ে আছে দেশের ভোজ্যতেলের বাজার। দাম যেভাবে বেড়েই চলেছে এর লাগাম কোনোভাবেই টেনে ধরা যাচ্ছে না। বাজারে মানা হচ্ছে কোনও নিয়মনীতি। আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে দাম নির্ধারণের উদ্যোগ নিলেও কোনও অগ্রগতি নেই। সরকারের দিক থেকে এখনও চলছে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের কাজ। কবে নাগাদ এ কাজটি সম্পন্ন হবে বা আদৌ এটি সম্ভব কিনা সে সম্পর্কে কেউ মুখ খুলছেন না। অতি প্রয়োজনীয় এই নিত্যপণ্যটি নিয়ে অনেকটাই বেকায়দায় রয়েছে সরকার তথা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
অপরদিকে ভোজ্যতেলের পাশাপাশি চিনি, লবণ, পেঁয়াজ, রসুন, মসুর ডাল, ছোলা, শুকনা মরিচ, দারুচিনি, লবঙ্গ, এলাচ, ধনে, জিরা, আদা ও তেজপাতা- খুচরা পর্যায়ে এই পণ্যগুলোর দামও বাড়ছে। এসব পণ্যের আকস্মিক লাগামহীন মূল্যে অনেক ক্রেতাই দিশেহারা।
বাজারের এই অস্থিরতা দূর করতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনকে দায়িত্ব দিয়েছে সরকার। কমিশনের যুগ্ম প্রধানকে আহ্বায়ক করে ৯ সদস্যের এক কমিটি কাজ শুরু করেছে। তবে এখানেও তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের কাজ চলছে। কবে নাগাদ কাজটি করতে পারবেন তা বলছেন না কমিশনের কেউই। ফলে অনিশ্চিতই রয়ে যাচ্ছে ভোজ্যতেলসহ ১৫টি নিত্যপণ্যের দাম নির্ধারণে সরকারি উদ্যোগের বাস্তবায়ন।
আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদার তুলনায় সয়াবিন ও পামঅয়েলের সরবরাহ কম এমন অজুহাতে দেশের বাজারে গত প্রায় দুই মাস ধরেই ভোজ্যতেলের দাম ঊর্ধ্বমুখী। ৮৮ টাকা লিটার দরের সয়াবিন তেল এখন বিক্রি হচ্ছে ১৩০ টাকা, আবার কোথাও ১১৫ টাকা। একই পণ্যের দামে এতো পার্থক্যের কোনও ব্যাখ্যা কারও কাছে নাই। সরকারের বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসেবে গত এক বছরে দেশে সয়াবিন তেলে ২৪ দশমিক ৩২ শতাংশ ও পামঅয়েলে ২২ দশমিক ৮৪ শতাংশ দাম বেড়েছে।
টিসিবির তথ্য মতে, গত এক মাসের ব্যবধানে প্রায় সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। খোলা ও প্যাকেটজাত আটার দাম বেড়েছে কেজিতে দুই টাকা, খোলা সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে লিটারে ছয় টাকা, পাঁচ লিটার বোতলজাত সয়াবিনের দাম বেড়েছে ৪০ টাকা, মসুরের ডাল কেজিতে বেড়েছে ১০ টাকা, দেশি রসুন কেজিতে বেড়েছে ২০ টাকা ও আমদানি করা রসুন ২০ টাকা, দেশি শুকনা মরিচ কেজিতে ৮০ টাকা, আমদানি করা শুকনা মরিচ ২০ টাকা, হলুদ কেজিতে ১০ টাকা, তেজপাতা কেজিতে ৪০ টাকা বেড়েছে।
উল্লেখ্য, এর আগে ভোজ্যতেলের বাজার সহনীয় পর্যায়ে রাখতে কয়েকটি সুপারিশসহ প্রতিবেদন বাণিজ্য মন্ত্রণালয় পাঠিয়েছিল ট্যারিফ কমিশন। প্রতিবেদনে ভোজ্যতেলের দাম সহনীয় রাখতে উৎপাদন ও ব্যবসায়ী পর্যায়ে বিদ্যমান ভ্যাট মওকুফ এবং সরবরাহ ও খুচরা পর্যায়ে কমিশনের হার লিটারপ্রতি যথাক্রমে ৩ ও ৫ টাকা নির্ধারণ করা যেতে পারে বলে জানানো হয় সরকারকে।
দ্বিতীয় সুপারিশে কমিশন বলেছে, ভোজ্যতেলের ওপর যে অগ্রিম কর রয়েছে, সেটি তুলে নিলেও বাজারে ভোজ্যতেলের দামে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে এবং দাম কমবে। তৃতীয় সুপারিশে ট্যারিফ কমিশন বলেছে, আমদানি মূল্যে শতকরা হারের পরিবর্তে টনপ্রতি নির্দিষ্ট হারে ভ্যাট আরোপ করলেও সুফল পাওয়া যাবে। কমিশন আরও বলছে, আমদানিকারকদের দুই পর্যায়ে ভ্যাট অব্যাহতি, অগ্রিম কর প্রত্যাহার এবং সরবরাহ ও খুচরা পর্যায়ে কমিশন যৌক্তিক করলে সয়াবিন তেলের দাম লিটারপ্রতি ১১০ টাকার মধ্যে রাখা যাবে। তবে এসব সুপারিশের কোনোটাই বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গ্রহণ করেনি।
এদিকে আর্ন্তজাতিক বাজারের দোহাই দিয়ে দেশের ব্যবসায়ীরা সয়াবিন তেলের দাম বাড়িয়েছেন। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিনের দাম কিছুটা কমেছে। তবে এখন আর দাম কমাতে রাজি নন দেশের তেল ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, আজ দাম কমালে কাল যদি আবার বাড়ে? তখন কী হবে? ব্যবসায়ীরা সরকারকে পরামর্শ দিয়েছেন, ভোজ্যতেলের আন্তর্জাতিক বাজার পরিস্থিতি আরও কিছুদিন বিচার-বিশ্লেষণ করার পরই দাম সমন্বয় করা উচিৎ।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ব্যবসায়ীদের এই পরামর্শ গ্রহণ করে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে স্থানীয় বাজারে সয়াবিনের দাম নির্ধারণের দায়িত্ব দিয়েছে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড টারিফ কমিশনকে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সরকারের সচিবের পদমর্যদায় বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান মুনশী শাহাবুদ্দীন আহমেদ জানিয়েছেন, ভোজ্যতেলসহ ১৫টি নিত্যপণ্যের দাম নির্ধারণের বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর। তার পরেও ট্যারিফ কমিশন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের গাইডলাইন অনুসারে নিত্যপণ্যের দাম নির্ধারণ পদ্ধতি প্রণয়নের জন্য গঠিত কমিটি কাজ করছে। কমিটি তথ্য-উপাত্ত জোগাড় করে বাজারে পণ্যের দাম যাচাই করে একটি সুনির্দিষ্ট প্রতিবেদন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠাবে।
তিনি জানিয়েছেন, ট্যারিফ কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের বিষয়টি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ওপর বর্তায়। তাই খোলামেলা এ বিষয়ে আলাপ করাটা আমাদের জন্য বিব্রতকর। কমিশনের দেওয়া সুপারিশ আদৌ বাস্তবায়ন হবে কি হবে না সে বিষয়ে মন্ত্রী-সচিবই ভালো বলতে পারবেন বলেও জানান তিনি।
সরকার দাম বেঁধে দিলেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসবে কিনা জানতে চাইলে মৌলভীবাজারের ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক গোলাম মওলা জানিয়েছেন, দাম ঠিক করে দিয়ে পণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ কতোটা বাস্তবসম্মত তা আমি জানি না। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে আমদানিনির্ভর পণ্যের দাম বেঁধে দিয়ে পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে কিনা তা বলা যাচ্ছে না। পণ্যের সঠিক চাহিদা নির্ধারণ করে আমদানি বাড়াতে হবে। চাহিদা ও সরবরাহ সমানতালে চললেই পণ্যের দাম নাগালে থাকবে।
এদিকে এ বিষয়ে ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানোর বিষয়ে ভেজিটেবল অয়েল ও বনস্পতি ম্যানুফেকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তফা হায়দার বলেন, বাজার স্থিতিশীল রাখতে সবার আগে নিত্যপণ্যের চাহিদা সঠিকভাবে নিরূপণ করতে হবে। অনেক সময় মন্ত্রণালয় ও দফতরের দেওয়া উৎপাদিত পণ্যের চাহিদা ও মজুতের পরিসংখ্যানে দেওয়া তথ্যে কারসাজির অভিযোগ পাওয়া যায়। তিনি জানান, আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত সয়াবিন ও পামতেলের দাম গত কয়েক মাসে অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। সেটি পর্যালোচনা করেই স্থানীয় বাজারে দাম সমন্বয় করার জন্য ট্যারিফ কমিশনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। দেখি ট্যারিফ কমিশন কী সুপারিশ করে। এ বিষয়ে একেবারেই মুখ বন্ধ রেখেছেন বাণিজ্য সচিব মোহম্মদ জাফর উদ্দিন। সরাসরি দেখা করে জানতে চাইলেও কৌশলে প্রশ্ন এড়িয়ে যান। ফোন করলে তিনি ফোনও ধরেন না।
এ বিষয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি জানিয়েছেন, ট্যারিফে কমিশন কাজ করছে। কমিশন কী প্রতিবেদন দেয় সেটির অপেক্ষায় আছি। তবে ভোজ্যতেল আমদানিতে সরকারের রাজস্ব না কমিয়ে চার স্থানের ডিউটির পরিবর্তে এক স্থানে নেওয়ার জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে আবার চিঠি দেওয়া হবে। এতে ব্যবসায়ীদের সময় বাঁচবে, হয়রানি কমবে। ভোজ্যতেলে আগে ১৫ শতাংশ ডিউটি নেওয়া হতো একটা স্থানে। এখন একই পরিমাণ অর্থ ভেঙে চার জায়গায় নেওয়া হয়।-বাংলাট্রিবিউন