দেশে কাজুবাদাম চাষ উপযোগী পাঁচ লাখ হেক্টর জমি আছে
বর্তমানে বিশ্বে মোট ৫৯.৩০ লাখ টন কাজুবাদাম উৎপাদিত হয়। কাজুবাদামের বাজার ৯.৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার; এর মধ্যে ভিয়েতনাম একাই ৩.৩৪ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি করে। কিন্তু সেই দেশে কাজু উৎপাদিত হয় পাঁচ লাখ টন; আরো ১৫ লাখ টন তারা আমদানি করে। কাঁচা কাজুবাদাম আমদানির পর দেশে প্রক্রিয়াজাত এবং রপ্তানি করে ভিয়েতনাম বিশ্ববাজারে এখন শীর্ষে। কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বাংলাদেশে কাজুবাদাম চাষ উপযোগী জমি রয়েছে পাঁচ লাখ হেক্টর; এর বেশির ভাগ পার্বত্যাঞ্চলে। দুই হাজার হেক্টর জমিতে চাষ শুরু করা গেলে দেশে কাজুবাদামের উৎপাদন পাঁচ লাখ টনে দাঁড়াবে। এই মুহূর্তে বান্দরবানে এক হাজার ৭৯৭ হেক্টর জমিতে চাষ হচ্ছে। ২০১৮ সালে যেখানে দেশে ৯১৬ টন ফলন হয়েছিল, সেখানে ২০২০ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় এক হাজার ৩২৩ টনে। অর্থাৎ তিন বছরের ব্যবধানে ফলন বেড়েছে ৩২ শতাংশ। পার্বত্যাঞ্চলের পাশাপাশি বরেন্দ্র অঞ্চলেও এখন কাজুবাদাম চাষের প্রক্রিয়া চলছে।
বাংলাদেশের পাহাড়ে পাহাড়ে আদা, হলুদ, কলা, আনারস। সঙ্গে জুমে হরেক ফসলের আবাদ। সুদীর্ঘকাল থেকেই পাহাড়ে চলছে এসব ফসল আর ফলফলাদির চাষবাস। এখন দিন বদলেছে। এসেছে ফসলের নানা বৈচিত্র্য। পাহাড়ে এবার কাজুবাদাম দেখাচ্ছে নতুন স্বপ্ন। এক দশক আগেও পাহাড়ে উৎপাদিত কাঁচা কাজুবাদাম ছিল ফেলনা। তবে এখনকার ছবি একেবারেই আলাদা। অনেক চাষি পাহাড়ের ঢালে কলা-আদা চাষের বদলে কাজুবাদামের চারা রোপণে নেমেছেন। তাঁদের দাবি, কলা-আদা চাষে মাটির ক্ষতি হয়। এ ছাড়া বাদাম দামি ফসল। তাই বাদাম চাষই বেশি লাভজনক। এ অঞ্চলের সাধারণ কৃষক কাজুবাদাম প্রক্রিয়াজাত করতে না পারলেও শুধু বাদাম বিক্রি করে টনপ্রতি এক লাখ থেকে এক লাখ ২০ হাজার টাকা আয় করা সম্ভব।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সম্ভাবনাময় রপ্তানি পণ্যের তালিকায় বৃক্ষজাতীয় ফলের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে কাজুবাদামের স্থান বর্তমানে তৃতীয়। আর বাদামজাতীয় ফসলের মধ্যে কাজু রয়েছে প্রথম স্থানে। এ রকম প্রেক্ষাপটে কাজুবাদাম ও কফি চাষের উন্নয়নে ২১১ কোটি টাকার একটি প্রকল্প একনেকে অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। ‘কাজুবাদাম ও কফি গবেষণা, উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ’ শীর্ষক প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) ও বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএআরআই)।
পাহাড়ি জনপদ খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবানে বাসিন্দাদের একটা বড় অংশই এখন ব্যস্ত সেই কাজুবাদাম গাছের পরিচর্যায়। তারা বলছেন, অর্থকরী এই বাদাম চাষের জুড়ি মেলা ভার। ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠা এই কৃষিপণ্যের চাষই তাদের সমৃদ্ধির পথ দেখাচ্ছে। কৃষি মন্ত্রণালয় জানাচ্ছে, পার্বত্য এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আগের তুলনায় কাজুবাদাম চাষের পরিমাণ অনেকটাই বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি বান্দরবানে এক হাজার ৭৯৭ হেক্টর জমিতে কাজু চাষ হয়। সম্প্রতি খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি ঘুরে দেখা গেছে, খাগড়াছড়িতে কোনো প্রক্রিয়াজাত করার কারখানা না থাকলেও বান্দরবান এবং রাঙামাটিতে তা আছে। খাগড়াছড়ি সদর ও রাঙামাটির কাপ্তাইয়ের রাইখালিতে পাহাড়ি কৃষি গবেষণা কেন্দ্রে উন্নত দেশি-বিদেশি কাজুবাদামের চারা নিয়ে গবেষণা চলছে।
রাইখালির পাহাড়ি কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. আলতাফ হোসেন বলেন, তাদের কেন্দ্রে কাজুবাদামের তিনটি মাতৃবাগানে ৯০টি গাছ রয়েছে। এর মধ্যে ভিয়েতনাম ও ভারত থেকে আনা উন্নত জাতের কিছু গাছও আছে। এগুলোর ওপর এখনও পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। বিদেশ থেকে আনা গাছের বাদাম সাইজে বড় এবং আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা করার মতো। মৌসুমে বিদেশি পূর্ণ বয়স্ক একটি গাছ থেকে ৫০-১০০ কেজির মতো কাজুবাদাম পাওয়া যায়। দেশে এখন প্রতি বছর মাত্র এক হাজার টন কাজুবাদাম উৎপাদন হয়। যদিও এটি চাষের উপযোগী জমি রয়েছে পাঁচ লাখ হেক্টর। দুই হাজার হেক্টর জমিতে এখনই এর চাষাবাদ শুরু করা যায়। তা করতে পারলে দেশে এর উৎপাদন পাঁচ লাখ টনে দাঁড়াবে। যা থেকে বছরে ১০০ কোটি ডলার বা ৯ হাজার কোটি টাকারও বেশি আয় করা সম্ভব। এ সম্ভাবনা নজরে এসেছে সরকারের। ফলে আগ্রহী কৃষকদের সরকারের পক্ষ থেকে কাজুবাদাম উৎপাদন, চাষ পদ্ধতি, প্রক্রিয়াজাত ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। চাষ নিয়েও চলছে নতুন নতুন গবেষণা।
খাগড়াছড়ির পাহাড়ি কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মুন্সী রাশীদ আহমদ বলেন, কাজুবাদাম গাছে বসন্তে ফুল আসে। বর্ষায় ফল সংগ্রহ করা যায়। প্রাপ্ত বয়স্ক একটি দেশি কাজুবাদাম গাছ থেকে ১৫-২০ কে.জি. পর্যন্ত ফল পাওয়া যায়। একটি গাছ ফল দেয় প্রায় ৪০-৫০ বছর পর্যন্ত। গাছ থেকে ফল সংগ্রহ করে ভালোভাবে রোদে শুকিয়ে, ভেজে প্যাকেটজাত করতে হয়। প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা গড়ে না ওঠায় চাষিরা ভালো দাম পাচ্ছেন না বলে স্বীকার করেন তিনি। সরেজমিন ঘুরে চাষি ও উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কাজুবাদামের আবাদ বাড়লেও প্রক্রিয়াজাতের ক্ষেত্রে বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। রাঙামাটি, বান্দরবান, চট্টগ্রাম ও নীলফামারী ছাড়া এখনও সেভাবে উল্লেখযোগ্য কোনো প্রক্রিয়াজাত কারখানা নেই। এতে কাঁচাবাদামই বিক্রি করছেন কৃষক। ফলে এটি চাষের শতভাগ সম্ভাবনা কাজে লাগানো যাচ্ছে না বলে অভিযোগ চাষিদের। প্রক্রিয়াজাত করার কারখানা সব জায়গায় গড়ে উঠলে তৈরি হতো কর্মসংস্থান। বাগান মালিকদের লাভের পরিমাণও কয়েকগুণ বেড়ে যেত। খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গায় ব্যক্তি উদ্যোগে চারশ গাছের একটি বাগান গড়ে উঠলেও কোনো সম্প্রসারণ কারখানা না থাকায় চাষাবাদ ব্যাহত হচ্ছে। উৎপন্ন বাদাম বিক্রি করতে না পারায় কিছু চাষি গাছ কেটেও ফেলেছেন। খাগড়াছড়ির চাষি মজিবুর রহমান বলেন, নির্ঝঞ্ঝাট চাষাবাদ। আমাদের বিশেষ কিছুই করতে হয় না। কিন্তু কাজুবাদাম প্রক্রিয়াজাত করাই যত কষ্টের। প্রক্রিয়াজাত করার ব্যবস্থা না থাকায় এ অঞ্চলে বাগানও গড়ে উঠছে না। অবশ্য কাজুবাদাম এবং কফি চাষের উন্নয়নে ২১১ কোটি টাকার একটি প্রকল্প একনেকে অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। ‘কাজুবাদাম ও কফি গবেষণা, উন্নয়ন ও সম্প্র্রসারণ’ শীর্ষক প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে কৃষি সম্প্র্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) এবং বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএআরআই)। প্রকল্পের মূল কার্যক্রম হচ্ছে- কাজুবাদামের দুই হাজার ২৫০টি প্রদর্শনী, কফি প্রদর্শনী পাঁচ হাজার ২৫০টি এবং কৃষক প্রশিক্ষণ ৪৯ হাজার ৫০০ জন। এ ছাড়া কাজুবাদামের উচ্চফলনশীল নতুন দুটি জাত উদ্ভাবন এবং ২৫ হাজার জার্মপ্লাজম সংগ্রহসহ আনুষঙ্গিক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হবে।
দেশে যাতে এই পণ্য প্রক্রিয়াজাত করার প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে সেজন্য কাঁচা কাজুবাদাম আমদানি শুল্ক্কমুক্ত করতে কৃষি মন্ত্রণালয় উদ্যোগ নিয়েছিল। ফলে সম্প্রতি প্রক্রিয়াজাত প্রতিষ্ঠানের জন্য কাঁচা কাজুবাদাম আমদানির ওপর শুল্ক্কহার প্রায় শতকরা ৯০ থেকে নামিয়ে ৫ থেকে ৭ ভাগে নিয়ে আসতে এনবি আর সম্মত হয়েছে। এ ছাড়া এ বছর কৃষকের মধ্যে কাজুবাদামের ৫০ হাজার চারা বিতরণ করা হয়েছে। কম্বোডিয়া থেকে প্রায় পাঁচ টন হাইব্রিড কাজুবাদামের বীজ আমদানিতে কৃষি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বেসরকারি উদ্যোক্তাকে সহযোগিতা করা হয়েছে। কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, কাজুবাদাম রপ্তানি ও উৎপাদন কাজ এগিয়ে নিতে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হবে। কিছুটা সুবিধা দিলে কাজুবাদাম ব্যাপক সম্ভাবনাময় রপ্তানিযোগ্য কৃষিপণ্য হিসেবে বাজারে জায়গা করে নিতে পারবে। এ ক্ষেত্রে কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা থাকলে তা দূর করা হবে।