মাদারীপুরের শিবচর উপজেলায় বাংলাবাজার ফেরিঘাটে বালুবাহী বাল্কহেডের সঙ্গে স্পিডবোটের সংঘর্ষে মৃত মানুষের সংখ্যা বেড়ে ২৬ হয়েছে। এ ঘটনায় নিখোঁজ আছেন বেশ কয়েকজন। গতকাল সোমবার সকাল সাতটার দিকে বাংলাবাজার ফেরিঘাটের পুরোনো কাঁঠালবাড়ি ঘাটে এ দুর্ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় পাঁচজনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। হতাহত ব্যক্তিদের নাম–পরিচয় এখনো জানা যায়নি। গুরুতর আহত একজনকে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
বাংলাবাজার ফেরিঘাটের ট্রাফিক পুলিশের পরিদর্শক আশিকুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, মুন্সিগঞ্জের শিমুলিয়া থেকে ৩০ জন যাত্রী নিয়ে একটি স্পিডবোট বাংলাবাজার ফেরিঘাটের দিকে যাচ্ছিল। স্পিডবোটটি বাংলাবাজার ফেরিঘাটের পুরোনো কাঁঠালবাড়ি ঘাটের কাছাকাছি আসার পর বালুবোঝাই বাল্কহেডের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। এতে স্পিডবোটটি উল্টে যায়। এ ঘটনায় ২৬ জনের লাশ এ পর্যন্ত উদ্ধার করা হয়েছে। উদ্ধারকাজ চলছে। ঘটনাস্থলে ট্রাফিক পুলিশ ও নৌ–পুলিশ উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করছে। স্থানীয় লোকজনও উদ্ধারকাজে সহায়তা করছেন।
স্পিডবোট-বাল্কহেড সংঘর্ষে নিহতের ঘটনায় তদন্ত কমিটি: মাদারীপুরের শিবচরে বাংলাবাজার-শিমুলিয়া নৌরুটের কাঁঠালবাড়ি ঘাট সংলগ্ন এলাকায় স্পিডবোট ও বালুবোঝাই বাল্কহেডের সংঘর্ষে নিহতের ঘটনা তদন্তে ছয় সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক রহিমা খাতুন এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, মাদারীপুর জেলা প্রশাসনের স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক আজহারুল ইসলামকে কমিটির প্রধান করে ৬ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ ঘটনায় নিহতের স্বজনকে ২০ হাজার টাকা করে দেয়া হবে। এর আগে সোমবার সকাল ৬টার দিকে বাংলাবাজার ফেরিঘাটের পুরনো কাঁঠালবাড়ি ঘাটে স্পিডবোট দাঁড়িয়ে থাকা বাল্কহেডে ধাক্কা দিয়ে উল্টে যায়। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ২৬ জনের প্রাণহানির খবর নিশ্চিত হওয়া গেছে। পাঁচজনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে।
মায়ের লাশ দেখতে গিয়ে আদুরি ফিরছেন স্বামী-সন্তানের লাশ নিয়ে: মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার দোতরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে বসে কাঁদছিলেন ৩৫ বছর বয়সী আদুরি বেগম। তাঁকে সান্ত¡না দেওয়ার কেউ নেই। স্বজন হারানোর কান্না থামছেই না। শিমুলিয়া-বাংলাবাজার নৌপথে দুই নৌযানের দুর্ঘটনার প্রতক্ষ্যদর্শী তিনি। দুর্ঘটনায় তাঁর স্বামী আরজু মিয়া (৪০) ও দেড় বছর বয়সী ছেলে ইয়ামিন প্রাণ হারিয়েছেন।
আদুরির বাড়ি ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা উপজেলার মাইগ্রো গ্রামে। স্বামী–সন্তান নিয়ে থাকতেন ঢাকার হাসনাবাদে।
গত রোববার রাতে আদুরির মা মনোয়ারা বেগম মারা যান। মায়ের লাশ দেখতে স্বামী–সন্তান নিয়ে গ্রামে যাচ্ছিলেন তিনি। সকাল ৬টার দিকে অন্তত ৩২ যাত্রী নিয়ে স্পিডবোট শিমুলিয়া ঘাট থেকে শিবচরের বাংলাবাজারের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। সাড়ে ৬টার দিকে বাংলাবাজার ঘাটে নোঙর করা বালুবোঝাই বাল্কহেডে ধাক্কা খায় স্পিডবোটটি। ঘটনাস্থলেই ২৬ যাত্রী প্রাণ হারান। স্থানীয় লোকজন পাঁচ যাত্রীকে জীবিত উদ্ধার করে হাসপাতালে নেন। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা লাশ উদ্ধার করে কাঁঠালবাড়ির ইয়াছিন মাদবরকান্দি গ্রামের দোতরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে রাখেন। মায়ের লাশ দেখতে যাচ্ছিল মেয়েটি। এখন স্বামী-সন্তানের লাশ নিয়ে তাকে ফিরতে হচ্ছে। আমরা কী বলে সান্ত¡না দেব তাকে? বিধাতা কেন এমন করল!
মৃত ২৬ জনের মধ্যে আছেন আদুরির স্বামী ও ছেলে। আর জীবিত উদ্ধার হন আদুরি। সকাল ১০টার দিকে আদুরি স্বামী-সন্তানের খোঁজে ছুটে যান নদীর তীরে। সেখানে কাউকে না পেয়ে যান দোতরা স্কুলের মাঠে। স্বামী–সন্তান নেই জেনে তাঁর কান্না আর থামছিল না। দুর্ঘটনার খবর পেয়ে সেখানে যান আদুরির দুই চাচা ও ফুফু। তাঁরা লাশের সারি থেকে আদুরির স্বামী আরজু মিয়া ও ছেলে ইয়ামিনকে শনাক্ত করেন। আদুরির চাচা বলেন, ‘মায়ের লাশ দেখতে যাচ্ছিল মেয়েটি। এখন স্বামী-সন্তানের লাশ নিয়ে তাকে ফিরতে হচ্ছে। আমরা কী বলে সান্ত¡না দেব তাকে? বাড়িতে একটি কবর খুঁড়ে এসেছি। ফোনে আরও দুটি কবর প্রস্তুত করতে বলেছি। বিধাতা কেন এমন করল!’ আদুরি কান্না করতে করতে বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন। তিনি বলেন, ‘লগডাউনের কারণে ঢাকায় আটকা পড়েছিলাম। মায়ের মৃত্যুর খবর পেয়ে গ্রামে যাচ্ছিলাম। দেড় বছরের ছেলে আমার কোলে ছিল। স্পিডবোট চলছিল অতিরিক্ত গতিতে। আমি এক হাতে ছেলেকে ও আরেক হাতে স্বামীকে ধরেছিলাম। হঠাৎ সজোরে ধাক্কা লাগে। আমরা সবাই ছিটকে পড়ি। জ্ঞান ফিরলে দেখি আমি হাসপাতালে। সঙ্গে সঙ্গে নদীর পাড়ে গিয়ে শুনি, আমার সব শেষ।’