শনিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১১:২৫ পূর্বাহ্ন

আর্থিক প্রণোদনা : ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও হতদরিদ্রদের মাঝে হতাশা

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ৪ জুন, ২০২১

করোনাভাইরাস মহামারীতে অর্থনীতি, জীবন-জীবিকার স্বার্থে বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও বড় অংকের আর্থিক প্রণোদনা ঘোষণা করা হয়েছে, কিন্তু এর বাস্তবায়ন নিয়ে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী এবং হতদরিদ্র মানুষের মধ্যে দেখা দিয়েছে হতাশা এবং ক্ষোভ। বিভিন্ন প্যাকেজের আওতায় লক্ষাধিক কোটি টাকার ওই প্যাকেজের অর্থ থেকে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা খুব কমই ঋণ সহায়তা পেয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন। আর নগদ অর্থ সহায়তার ক্ষেত্রেও প্রাথমিক তালিকার ৫০ লাখ মানুষের সবাইকে সহায়তা পৌঁছে দেয়া যায়নি। যে কারণে প্যাকেজের অর্থ প্রাপ্তি নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন হতদরিদ্র মানুষ এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উদ্যোক্তারা। আর অর্থনীতিবিদরাও বলছেন, এ প্যাকেজের বাস্তবায়ন কিছু ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার অভাব এবং দুর্বলতা রয়েছে।
কী পরিমাণ প্রণোদনা বরাদ্দ ছিল? বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, করোনাভাইরাস মহামারীতে সম্ভাব্য অর্থনৈতিক প্রভাব মোকাবিলায় বিভিন্ন খাতে ২৩টি আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে সরকার। প্রণোদনা প্যাকেজের মোট অর্থের পরিমাণ হলো ১ লাখ ২৮ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, প্যাকেজ ঘোষণার পর ২০২১ সালে জুন পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক সংশ্লিষ্ঠ প্রণোদনা প্যাকেজের মোট বরাদ্দের প্রায় ৮৩ শতাংশ অর্থই ইতোমধ্যে বিতরণ হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের দাবি, প্রণোদনা প্যাকেজের প্রত্যক্ষ সুবিধাভোগীর সংখ্যা ১ কোটি ২৪ লাখ গ্রাহক। মহামারীর শুরুতে রফতানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠান পোশাক কারাখানার বেতন-ভাতা পরিশোধের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করেছিল সরকার। মালিকদের দাবির মুখে সেই ঋণ আরো বাড়িয়ে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি করা হয়। প্রায় ১৮ শ’ কারখানা মালিক এ ঋণ সুবিধা নিয়ে শ্রমিকদের বেতনভাতা দিয়েছেন বলে জানা যায়। পোশাক শ্রমিকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, মহামারীর শুরুতে কয়েক মাস তাদের বেতন-ভাতা মোবাইল অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে পেয়েছেন। এ মহামারীতে ছোট-বড় সব ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্যই ক্ষতির মুখে পড়েছে। প্রণোদনা প্যাকেজে দেশের ক্ষুদ্র, কুটির ও মাঝারি শিল্পের জন্য বরাদ্দ হয় ২০ হাজার কোটি টাকা।
এর মধ্যে ১৪ হাজার ৬৫৪ কোটি টাকা জুন পর্যন্ত বিতরণ হয়েছে। বরাদ্দের প্রায় চার ভাগের এক ভাগ টাকা পড়ে থাকলেও উদ্যেক্তাদের অনেকে চেয়েও ঋণ পাননি বলে অভিযোগ করেছেন।
প্রণোদনা না পাওয়ার অভিযোগ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের: শাহীন নামের একজন মাঝারি শিল্পের উদ্যোক্তা বলছিলেন, ‘এ ঋণ আমাদের জন্য না। যাদের ক্ষমতা আছে আর যোগাযোগ আছে তারাই সুবিধা নিতে পেরেছেন।’

রেশমা নামের একজন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা জানান, দুটি ব্যাংকে আবেদন করে শেষ মুহূর্তে তাকে আর টাকা দেয়া হয়নি। এখনো তিনি চেষ্টা করে যাচ্ছেন। অর্থ ছাড় করতে সাধারণ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য নানা জটিলতা রয়েছে বলেও তিনি মনে করেন। বাংলাদেশ উইমেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট সঙ্গীতা আহমেদ বলেন, তাদের ১০ হাজারের বেশি উদ্যোক্তা সদস্যের মধ্যে হাতেগোনা কয়েকজন এই প্রণোদনার সুবিধা পেয়েছে।
‘আমাদের অনেক মেম্বার বলেছেন, আমরা ব্যাংকের কাছে চেয়েছি তারা বলেছে, ওই প্রণোদনা প্যাকেজ শেষ। তিন-চার মাস আগে শুনেছি। কিন্তু আসলে তো শেষ হয়নি। আমরা শুনেছি ফুল ইউটিলাইজ হয়নি। কিন্তু ব্যাংক থেকে বলছে যে শেষ। এর দায়দায়িত্ব কে নেবে?’ নারী উদ্যোক্তা এবং উইমেন চেম্বারের নেতা সঙ্গীতা আহমেদের ভাষায়, ঋণ সুবিধা যথাসময়ে না পেলে সেটি আর ব্যবসায় কোনো কাজে আসে না। তাই বহু উদ্যোক্তাই এরই মধ্যে ক্ষতির শিকার হয়েছেন।
‘যদি সময়মতো আমি টাকাটা না পাই, তখন কিন্তু সে টাকা আসলে আমার কোনো কাজে আসে না ব্যবসায়ী হিসেবে। যেরকম আমাদের দুটো ঈদ চলে গেল, গত বছরও ঈদ চলে গেল, সেখানে আমাদের নারী উদ্যোক্তারা অনেক সাফার করেছে।’ তিনি বলছেন, ‘অনেকেরই ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। আমাদের ১০-১২ হাজার মেম্বারের মধ্যে অন্তত ৫ হাজার উদ্যোক্তার ব্যবসা বন্ধের পথে।’ আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় ঋণের সুদ সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ। পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে, স্বল্প সুদে এ ঋণের সুবিধা বড় বড় শিল্প কারখানা আর সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা ব্যবসায়ী উদ্যোক্তারাই পেয়েছেন এবং উপকৃত হয়েছেন। জানা যায়, বড় বড় শিল্পগোষ্ঠী শত শত কোটি টাকা এই প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে ঋণ নিয়েছেন।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, এ প্রণোদনার অর্থ ক্ষুদ্র, মাঝারি, অতিক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কাছে খুব একটা যায়নি। ‘বড়রাই কিন্তু এই ঋণ পুরোটা নিতে পেরেছে এবং সেটা নিয়ে তাদের ব্যবসায় কাজে লাগিয়েছে। কিন্তু ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা সেটা কিন্তু করতে পারেনি। সুতরাং তাদের এক্ষেত্রে খুব একটা সহায়তা হয়নি এই প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে।’ অন্যদিকে প্রান্তিক খেটে খাওয়া মানুষ আর হতদরিদ্র পরিবারের জন্য নগদ সহায়তা হিসেবে বরাদ্দ থাকলেও সবাইকে এই প্রণোদনার আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। শুরুতে ৫০ লাখ পরিবারের জন্য নগদ অর্থ বরাদ্দের উদ্যোগ নেয়া হলে তালিকা প্রণয়নে অনিয়ম আর ত্রুটির কারণে শেষ পর্যন্ত প্রায় ১৪ লাখ পরিবার এ সহায়তা থেকে বাদ পড়ে।

না পেয়ে হতদরিদ্র মানুষেরা অনেকেই হতাশ। ঢাকায় কয়েকজন রিকশাচালক বলছিলেন, আইডি কার্ড নিয়ে তালিকায় নাম ওঠানোর কথা বলা হলেও শেষ পর্যন্ত অনেকেই কোনো সহায়তা পাননি।
এ বিষয়ে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘৫০ লাখ পরিবারকে আড়াই হাজার টাকা করে দেয়ার কথা ছিল। সেখানে ৩৫ লাখের মতো পেয়েছে, বাকিরা কিন্তু পায়নি।’ ‘এখানে আবার কথা রয়েছে- যারা পেল, তাদের সবার প্রয়োজন ছিল কিনা এবং যারা বাইরে রয়ে গেল, তারা কেন এই তালিকায় আসতে পারল না।’ ফাহমিদা খাতুন বলছিলেন, নগদ অর্থের বিলি-বণ্টনের ক্ষেত্রেও স্বচ্ছতা এবং ব্যবস্থাপনার আরো উন্নয়ন দরকার।
‘গত দেড় বছরে যে উদ্যোগগুলো নেয়া হচ্ছে এবং বাস্তবায়নও চলছে – কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে বাস্তবায়নটা সুচারুভাবে হচ্ছে না, স্বচ্ছতার সাথে হচ্ছে না। এবং এখানে ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা রয়েছে। সেই ব্যপারে উদ্যোগটা খুব দুঃখজনক।’ করোনাভাইরাস মহামারী কবে শেষ হবে সেটি এখনো কেউ বলতে পারছেন না। এ অবস্থায় সরকারি প্রণোদনা বা নগদ আর্থিক সহয়তার যে প্যাকেজই হোক তার সুষ্ঠু বাস্তবায়ন না হলে সমাজে বৈষম্য আরো বাড়বে বলেই আশঙ্কা করা হচ্ছে। সূত্র : বিবিসি




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com