উত্তরের সীমান্তবর্তী জেলা পঞ্চগড়ের পাঁচটি উপজেলায় গড়ে ওঠা সবুজ চা-বাগানগুলো দিন দিন বদলে দিচ্ছে বেকার মানুষদের জীবন। চা-বাগান করে চাষিরা যেমন হয়েছেন স্বাবলম্বী, তেমনি দূর হচ্ছে বেকারত্বের হার। চা চাষ করে চাষিরা যেমন তাদের ভাগ্য পরিবর্তন করেছেন, অন্যদিকে বাগানে শ্রমিকরাও চা-পাতা তুলে সুন্দরভাবে জীবিকা নির্বাহের পথ খুঁজে পেয়েছেন। জেলার বিভিন্ন এলাকায় সকাল হলে সমতল ভূমির চা-বাগানে শ্রমিকদের চা-পাতা তোলার দৃশ্য চিরচেনা এক অপরূপ চিত্র হলেও এ জেলার দৃশ্য অন্য রকম। চা-শ্রমিকদের রাতের আঁধারে চা তোলার চিত্র একেবারে নতুন। দিন দিন এ জেলার শ্রমিকরা রাতের আঁধারে চা-পাতা তোলার কাজে আত্মনিয়োগ করে নিজেদের জীবন বদলে দিয়েছে। ঘড়ির কাঁটা রাত ২টার ঘরে। সরব হয়ে উঠেছে দেশের সর্ব উত্তরের প্রান্তিক জেলার পঞ্চগড়ের সমতলে গড়ে ওঠা চা-বাগানগুলো। বাগানজুড়ে মিটিমিটি আলোর খেলা। যেন জোনাকিরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। দূর থেকে দেখলে ভৌতিক মনে হবে। কারণ, চা-শ্রমিকরা রাতে মাথায় টর্চলাইট বেঁধে পাতা তোলার কাজ করছেন।
একসময় দিনের বেলায় সূর্যের করা তাপ সয়েই চা পাতা তোলার কষ্টসাধ্য কাজ করেছেন এসব শ্রমিক। এতে যেমন ভোগান্তি পোহাতে হতো তাদের, তেমনি শুকিয়ে যেত সবুজ চা-পাতা। কারখানার মালিকরা নিতে চাইতেন না শুকনা পাতা। তবে দুই বছর ধরে শ্রমিকরা রাত জেগে পাতা তোলার কাজ শুরু করেন। দিন দিন বাড়তে থাকে রাতের শ্রমিকের সংখ্যা। প্রতিটি দলের শ্রমিক থাকেন ১০ থেকে ১২ জন। প্রতি কেজি কাঁচা চা-পাতা তোলার বিনিময়ে বাগান-মালিকরা শ্রমিকদের মজুরি দেন তিন টাকা করে। একজন রাতের শ্রমিক প্রতিদিন পাতা তুলতে পারেন ২০০ থেকে ২৫০ কেজির মতো। সেই হিসাবে তাদের আয় এখন ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা পর্যন্ত।
চা বোর্ডের তথ্যমতে, জেলায় ১৬ হাজার একর জমি চা চাষের জন্য উপযোগী রয়েছে। জেলায় ৮ হাজার ৬৪২ একর জমিতে চাষ সম্প্রসারণ হয়েছে। বর্তমানে জেলায় ১৭টি চা কারখানা গড়ে উঠেছে। এসব কারখানা গত বছরে তৈরি চা উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল এক কোটি কেজি। কিন্তু উৎপাদন হয়েছে প্রায় ১ কোটি ৩ লাখ কেজি। জেলায় বর্তমানে ৯টি নিবন্ধিত চা বাগান (টি এস্টেট), ১৬টি অনিবন্ধিত চা-বাগান, ৯৯৮টি নিবন্ধিত ক্ষুদ্রায়তন চা-বাগান এবং ৫ হাজার ৫০০ অনিবন্ধিত ক্ষুদ্রায়তন চা-বাগান রয়েছে।
সমাজসেবা অধিদফতর থেকে যে বছর চা-শ্রমিকদের ৫ হাজার টাকা করে অনুদান দেওয়া হয়, তা সব শ্রমিক পান না। তাই সবাই যেন সেই অনুদান পান, সে জন্য সরকারের কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন জেলার ৫ উপজেলার চা-শ্রমিকরা। চা-শ্রমিকদের চা-পাতার তোলার বিষয়ে আগে তেমন কোনো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা না থাকলেও এক বছর ধরে চা বোর্ডের উদ্যোগে চা-চাষি ও শ্রমিকদের দক্ষ হিসেবে গড়ে তুলতে খোলা আকাশের নিচে ‘ক্যামেলিয়া খোলা আকাশ স্কুল’-এর মাধ্যমে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করছে। আর এতে উপকৃত হচ্ছেন চাষি ও শ্রমিকরা।
শ্রমিকরা জানান, রাত ৯টা থেকে ১০টার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েন তারা। আর উঠে পড়েন রাত ২টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে। তারপর হাতে চাকু আর মাথায় টর্চলাইট আর কেউ কেউ মোবাইলের লাইট বেঁধে নেমে পড়েন চা-বাগানে। রাতের শান্ত-স্নিগ্ধ পরিবেশে চলতে থাকে তাদের চা-পাতা তোলার কাজ। সকাল ১০টা মধ্যেই পাতা তোলার পর কারখানায় পাঠিয়ে তারপর বাড়ি ফেরেন তারা। দিনের বেলা আবার কৃষিসহ বিভিন্ন কাজ করেন।
এভাবে দ্বৈত আয়ে সুন্দরভাবে চলছে তাদের সংসার। অর্থকষ্টে থাকা এসব শ্রমিকের সংসারে এখন এসেছে সচ্ছলতা। বদলে যাচ্ছে জীবনগতি। শ্রমিকরা জানান, শুরুতে রাতে আঁধারে বিভিন্ন এলাকায় বাগানে চা-পাতা তুলতে পোকামাকড়ের ভয় থাকলেও দল বেঁধে পাতা তোলায় কোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতি শিকার হতে হয়নি। এ ছাড়া রাতে চা-পাতা তোলায় একদিকে যেমন তাদের কমেছে দুর্ভোগ, অন্যদিকে আয় বেড়েছে দ্বিগুণ। আর এ আয়ে দিয়ে তারা তাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে সুখেই দিন কাটাচ্ছেন।
সদর উপজেলার রাতের চা-পাতা শ্রমিক বেলাল হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি দুই বছর ধরে রাতের বেলায় চা-পাতা তোলার কাজ করি। প্রতিদিন রাত ২টা থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত পাতা তোলার কাজ করি। দিনে অন্য কাজ করি। দুই আয় দিয়ে আমার সংসার ভালোই চলছে।
চা-শ্রমিক আবদুর রহমান বলেন, দিনের বেলা রোদের কারণে বেশি পাতা তুলতে না পারলেও রাতের বেলায় পারি। আমরা বিভিন্ন দিন বিভিন্ন এলাকায় এভাবে রাতের বেলায় চা-পাতা তোলার কাজ করি। আর দিনে কৃষিকাজসহ বিভিন্ন কাজ করি। দুই আয় দিয়ে আমরা পরিবার নিয়ে সুখেই দিন পার করতেছি। চাষিরা বছরের প্রায় ৯ মাস চা পাতা তোলার কাজ করে এবং শীতের কারণে ডিসেম্বর -ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত চা-পাতা তোলা বন্ধ থাকে বাগানগুলোয়। সে সময়টায় চাষিরা তাদের বাগানের পরিচর্যার কাজ করেন।
উপজেলার আজিজনগর এলাকার চা-চাষি তাজুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, রাতে বাগান থেকে চা-পাতা তোলায় শ্রমিকদের যেমন কষ্ট কম হয়, তেমনি আমাদের পাতাও সতেজ থাকে। আমরা সকালের মধ্যে কারখানায় সতেজ পাতা বিক্রি করতে পারি। এতে শ্রমিকরা যেমন লাভবান হচ্ছেন, আমরারাও বেশ লাভবান হচ্ছি। অমরখানা ইউনিয়নর চা-চাষি শাহরিয়ার হোসেন শুভ বলেন, চা-শ্রমিকরা দিনের বেলায় চা-পাতা তোলার কাজ করলে সময় বেশি লাগে এবং বাগান শেষ করতে পারে না কিন্তু রাতে তারা চা-পাতা বেশি তুলতে পারে। আর বাগানে রাতে চা-পাতা তোলার কাজ করে তারা ভালোই আয় করছে। বাংলাদেশ চা বোর্ড পঞ্চগড় আঞ্চলিক অফিসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ড. মোহাম্মদ শামীম আল মামুন ঢাকা পোস্টকে বলেন, পঞ্চগড়ের চা-শিল্পে চাষিদের পাশাপাশি ২০ থেকে ২৫ হাজার শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়েছে। তারা আগে অলস সময় পার করতেন। তেমন কোনো কাজ পেতেন না। এখন তারা চা-বাগানে কাজ করতে পেরে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন।