‘আমাদের গোটা তথ্য মিয়ানমারকে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। এমন তথ্য দিয়েছে যে, জন্মের পর থেকে মিয়ানমারও আমাদের কাছ থেকে এমন তথ্য নিতে পারেনি। আমাদের ভুল বুঝিয়ে জাতিসংঘ (ইউএনএইচসিআর) এসব তথ্য পাচার করেছে। আমরা শরণার্থী। কিছু বললে পদে পদে হুমকি পাই, ভয়ে থাকতে হয়। প্রতিবাদও করতে পারি না। আমাদের মিয়ানমারে পাঠাবে বলে তথ্য নিয়ে তাদের (মিয়ানমার) দিয়ে দিয়েছে। অধিকার প্রতিষ্ঠার নাম করে জাতিসংঘ আমাদের অধিকার হনন করেছে।’ সঙ্গে আলাপকালে এমন মন্তব্য করেন রোহিঙ্গা কমিউনিটি নিয়ে কাজ করা একটি সংগঠনের প্রধান হামিদুল্লাহ (ছদ্মনাম-১)। ফরমে যে তিনটি প্রশ্নের কথা বলা হয়েছে, সেটি তাদের পড়ে শোনানো হয়নি। শুধু বলা হয়েছে, খাবারের জন্য (ত্রাণ) এ ফরম পূরণ করতে হবে। তারা সরল বিশ্বাসে উত্তর দিয়েছেন
‘মিয়ানমারে ফিরতে সহজ হবে’— এমন আশ্বাস দিয়ে ২০১৯ সালে বাংলাদেশের ক্যাম্পে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে বেশকিছু তথ্য নেয় জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার- ইউএনএইচসিআর। তথ্য নেওয়ার সময় রোহিঙ্গাদের বলা হয়, এসব তথ্য দেওয়া হলে তারা দেশে ফিরতে পারবেন। এখন রোহিঙ্গারা বলছেন, এতে হিতে বিপরীত হয়েছে। তাদের (রোহিঙ্গা) অবগত না করেই তথ্য পাঠানো হয়েছে মিয়ানমারে। পাশাপাশি মিথ্যা তথ্য দিয়ে অবিবাহিত মুসলমান মেয়েদের ছবি নিয়ে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হেনেছে তারা (ইউএনএইচসিআর)।
রোহিঙ্গা ও জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট সংস্থা সূত্রে জানা যায়, তারা গণনাকারীর মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে কিছু মৌলিক তথ্য নিয়েছে। তথ্যগুলো একটি ফরম পূরণের মাধ্যমে সংগ্রহ করা হয়েছে।
সেই ফরমে রোহিঙ্গার নাম, বাংলাদেশে আসার তারিখ, রেজিস্ট্রেশনের তারিখ, জন্ম তারিখ, বয়স, জন্মস্থান (শহর ও দেশ), ধর্ম, লিঙ্গ, বাবা-মায়ের নাম, স্বামী-স্ত্রীর নাম, সন্তানের নাম, তাদের প্রত্যেকের মিয়ানমারের ঠিকানা (জেলা, শহর, এলাকা, গ্রামের নাম, ওয়ার্ড নম্বর)— এসব তথ্য উল্লেখ করতে বলা হয়েছিল। এছাড়া মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের পড়াশোনার বর্ণনা, পেশা (বাংলাদেশে বসবাসকালীন), দক্ষতার বর্ণনা, বিশেষ কোনো চাহিদা আছে কি না, শরীরে বা মুখে শনাক্তকরণ চিহ্ন (গালে বা মুখে তিল, স্থায়ী কোনো দাগ বা চিহ্ন), দুই হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলের ছাপ, পোর্ট্রেট ছবি ও পারিবারিক ছবি প্রভৃতি বিষয় ছিল। ওপরের বিষয়গুলো ছাড়াও ফরমে তিনটি প্রশ্ন ছিল। সেসব প্রশ্নে কেবল ‘হ্যাঁ’ ও ‘না’ সূচক উত্তর দেওয়ার সুযোগ ছিল। প্রশ্নগুলো হচ্ছে- ১. ইউএনএইচসিআর তথ্যগুলো তার পার্টনার সংস্থার সঙ্গে শেয়ার করতে পারবে? ২. ইউএনএইচসিআর তথ্যগুলো মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে শেয়ার করতে পারবে? ৩. আপনি যে তথ্যগুলো দিয়েছেন সেগুলো কি সত্যনিষ্ঠ ও পূর্ণাঙ্গ? ঢাকা পোস্টকে নয়াপাড়া- ১ নম্বর ক্যাম্পের ছয় রোহিঙ্গা জানিয়েছেন, ফরমটি ছিল ইংরেজিতে। তাদের (রোহিঙ্গা) অধিকাংশই ফরম পড়তে পারতেন না এবং জানতেন না এতে কী লেখা। এটি তারা পূরণ করেননি। ইউএনএইচসিআরের কর্মকর্তারা ফরম নিয়ে ক্যাম্পে আসেন। তাদের প্রশ্নগুলো করেন। রোহিঙ্গারা উত্তরও দেন। উত্তর শুনে ইউএনএইচসিআরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ফরম পূরণ করেন। রোহিঙ্গারা জানান, ফরমে যে তিনটি প্রশ্নের কথা বলা হয়েছে, সেটি তাদের পড়ে শোনানো হয়নি। শুধু বলা হয়েছে, খাবারের জন্য (ত্রাণ) এ ফরম পূরণ করতে হবে। তারা সরল বিশ্বাসে উত্তর দিয়েছেন।
আমাদের জিজ্ঞাসা করেই ওই তিনটি প্রশ্নের উত্তরে ‘হ্যাঁ’ সূচক বক্সে টিক চিহ্ন দিয়েছেন তথ্য সংগ্রহকারীরা। তারা আমাদের প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করার আগেই টিক দিয়েছেন
কুতুপালং ক্যাম্পের বাসিন্দা ও রোহিঙ্গাদের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত একটি সামাজিক সংগঠনের নেতা মো. ফোরকান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের জিজ্ঞাসা করেই ওই তিনটি প্রশ্নের উত্তরে ‘হ্যাঁ’ সূচক বক্সে টিক চিহ্ন দিয়েছেন তথ্য সংগ্রহকারীরা। তারা আমাদের প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করার আগেই টিক দিয়েছেন। এরপর আমাদের অন্যান্য প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেছেন। শুরুতেই আমাদের বলা হয়েছিল যে, মিয়ানমারে ফেরার জন্য আমাদের তথ্য নিচ্ছেন তারা। পরে আবার বল হয়, তথ্য না দিলে ত্রাণ পাওয়া যাবে না। এজন্য আমরা তথ্য দিয়েছি।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মাঝি নূর আলম (ছদ্মনাম- ২) ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা নিজ দেশে (মিয়ানমার) ফেরার জন্য তথ্য দিয়েছি। ক্যাম্পের অনেকে তথ্য দিতে ভয় পাচ্ছিলেন। আমরা তাদের আশ্বস্ত করেছি। তবে আমাদের মিথ্যাবাদী হিসেবে প্রমাণ করল ইউএনএইচসিআর।
রোহিঙ্গা ইয়ুথ অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা খিন মং ঢাকা পোস্টকে বলেন, ইউএনএইচসিআর তথ্য শেয়ার করে রোহিঙ্গাদের অধিকার ক্ষুণ্ন করেছে। এছাড়া তারা আমাদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হেনেছে। এটা সম্পূর্ণ আপত্তিকর এবং অগ্রহণযোগ্য। তারা আমাদের মুসলিম বোনদের লজ্জিত করেছে।
ইউএনএইচসিআর তথ্য শেয়ার করে রোহিঙ্গাদের অধিকার ক্ষুণ্ন করেছে। এছাড়া তারা আমাদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হেনেছে। এটা সম্পূর্ণ আপত্তিকর এবং অগ্রহণযোগ্য। তারা আমাদের মুসলিম বোনদের লজ্জিত করেছে খিন মং, রোহিঙ্গা ইয়ুথ অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি বলেন, তারা (ইউএনএইচসিআর) আমাদের প্রতিটি পরিবারের গ্রুপ ছবি নিয়েছে। আমাদের মুসলিম বোনদেরও ছবি নিয়েছে। আমাদের মেয়েরা বিয়ের আগে তাদের চেহারা অন্য কাউকে দেখান না। পর্দা মেনে চলেন। তারা ইউএনএইচসিআরের প্রস্তাবে সেসময় ছবি তুলতে রাজি ছিলেন না। কথা ছিল ইউএনএইচসিআর এসব ছবি গোপন রাখবে। কিন্তু তারা এগুলো প্রকাশ করে আমাদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হেনেছে। তারা (ইউএনএইচসিআর) গুরুতর অপরাধ করেছে। আমরা তাদের ওপর খুবই বিরক্ত।
সম্প্রতি বিষয়টি নজরে এসেছে নিউইয়র্কভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের। এ বিষয়ে তারা একটি জরিপও করেছে। তাদের জরিপেও ‘মিয়ানমারের কাছে রোহিঙ্গাদের তথ্য হস্তান্তরের ’ বিষয়টি উঠে এসেছে। বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহের পদ্ধতি জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা- ইউএনএইচসিআরের নিজস্ব নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক ছিল এবং তারা শরণার্থীদের আরও ঝুঁকির মুখোমুখি করেছে এ বিষয়ে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের সংকট ও সংঘাত বিষয়ক পরিচালক লামা ফাকিহ বলেন, বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহের পদ্ধতি জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা- ইউএনএইচসিআরের নিজস্ব নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক ছিল এবং তারা শরণার্থীদের আরও ঝুঁকির মুখোমুখি করেছে।
তিনি আরও বলেন, একজন শরণার্থী নিজের তথ্য সংরক্ষণের অধিকার রাখেন। ইউএনএইচসিআর কী উদ্দেশ্যে তথ্য নিচ্ছে, এটি রোহিঙ্গাদের স্পষ্টভাবে জানানোর প্রয়োজন ছিল। রোহিঙ্গাদের ফরম পূরণের সময় মিয়ানমারের সঙ্গে তথ্য শেয়ারের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছিল। যারা তথ্য শেয়ার করতে সম্মতি দেননি, তাদের তথ্য মিয়ানমারের সঙ্গে শেয়ার করা হয়নি
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইউএনএইচসিআর ঢাকা পোস্টকে জানায়, রোহিঙ্গাদের ফরম পূরণের সময় মিয়ানমারের সঙ্গে তথ্য শেয়ারের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছিল। যারা তথ্য শেয়ার করতে সম্মতি দেননি, তাদের তথ্য মিয়ানমারের সঙ্গে শেয়ার করা হয়নি।
ইউএনএইচসিআরের সরবরাহ করা নিবন্ধন ফরম: এক লিখিত বক্তব্যে ইউএনএইচসিআর আরও জানায়, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যেককে প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান, তাদের তথ্য-উপাত্ত সংরক্ষণ এবং সুরক্ষা নিশ্চিতে নিবন্ধন প্রক্রিয়াটি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এ নিবন্ধনের ফলে পরিবার থেকে পৃথক হওয়া সদস্যরা আবার একীভূত হওয়ার সুযোগ পাবেন।
ইউএনএইচসিআর ও বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক যৌথভাবে পরিচালিত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের এ নিবন্ধন প্রক্রিয়ার সময় প্রতিটি শরণার্থী পরিবারকে নিবন্ধনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবহিত করা হয়। নিবন্ধনটি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মিয়ানমারের আগের আবাসে ফিরে যাওয়া এবং অধিকার প্রতিষ্ঠায় ব্যবহৃত হয়। শরণার্থীদের আলাদাভাবে জিজ্ঞাসা করা হয় যে, তারা বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সরকারের সঙ্গে এসব তথ্য ভাগ করে নেওয়ার বিষয়ে সম্মতি দিয়েছেন কি না? এছাড়া নিবন্ধন প্রক্রিয়ার সময় তাদের নানা প্রশ্ন ও উদ্বেগের জবাব তাদের ভাষায় দেওয়া হয়— জানায় ইউএনএইচসিআর।