বরিশালে হতদরিদ্রদের প্রাকৃতিক দুর্যোগ সহনীয় মুজিব বর্ষের উপহারের ঘরের দুর্নীতি সকলের সামনে তুলে ধরলো প্রাকৃতিক দুর্যোগ-ই। পানি উঠে সরে যাবার পরপরই ধসে পড়লো ঘরগুলো। এতে ঘর নির্মাণে পদে পদে মিলেছে দুর্নীতির প্রমাণ। সীমাহীন দুর্নীতি প্রকাশ পাওয়ার পর ক্ষুব্ধ ঘর পাওয়া ব্যক্তি থেকে শুরু করে স্থানীয়রা। এখানেই শেষ নয়, ঘর বিতরণে হয়েছে মহাদুর্নীতি। এমনকি মুজিববর্ষের ঘর ব্যক্তির বাড়িতেও তুলে দেয়া হয়েছে। গত শনিবার দুপুর আড়াইটায় সার্কিট হাউসে সংবাদ সম্মেলন করে প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর ভেঙ্গে যাওয়াসহ সার্বিক বিষয় তদন্তে পৃথক ৩টি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। ঘর নির্মাণে গাফেলতিতে দায়ী ব্যক্তিদের শনাক্ত করে দ্রুত সময়ের মধ্যে রিপোর্ট দেয়ার বিষয়টি অবহিত করা হয়। সম্প্রতি বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জের শ্রীপুর ইউনিয়নের বাহেরচর এলাকায় নবনির্মিত ১৬টি ঘরে পানি ওঠে। পানি নেমে যাওয়ার পরপরই ঘরের এক কক্ষ এবং বেশীরভাগ ঘরের দেয়াল থেকে শুরু করে পিলার ধসে পড়ে। বেরিয়ে আসে দুর্নীতির মহাচিত্র। মাত্র একফুট মাটির নীচ থেকেই গড়ে তোলা হয় দেয়াল। আর দেয়ালে ব্যবহার করা হয়েছে নিম্নমানের ইট ও গাতনীতে সিমেন্ট ছিল না বললেই চলে। লিনটেন হয়েছে মাত্র ২টি রডের উপর। বালুর উপর পলিথিন বিছিয়ে হাফ ইঞ্চিরও কম ঢালাইতে নির্মিত হয়েছে ফ্লোর। টিনের ছাউনীতে ব্যবহার করা হয়েছে নামমাত্র কাঠ। সেই ছাউনী ধরে রাখতে কাঠ দিয়ে দেয়া হয় টানা। প্রায় একই চিত্র বরিশাল জেলায় মুজিববর্ষের উপহারের ঘরগুলোর। দেয়াল ধসে পড়ে টিনের ছাউনী ঝুলে থাকা ঘর পাওয়া মো. তৌহিদ বলেন, আমরা নদী ভাঙনি লোক। আজ এখানে তো কাল অন্য জায়গায়। এভাবে চলছিল আমাদের জীবন। অনেক কষ্ট করে মুজিববর্ষের এ ঘর পেয়েছিলাম। কিন্তু তাও বেশী দিন কপালে জুটলো না। পানির তোরে ঘরের সকল দেয়াল ধসে পড়ায় পরিবার নিয়ে আরেক জায়গা এক হাজার টাকায় ঘর ভাড়া নিয়েছি। এ ঘর আবার কবে ঠিক হবে, কবে ঘরে উঠবো তা কেবল আল্লাহই ভালো বলতে পারবেন। একই স্থানে থাকা মরজিনা বলেন, পানির তোড়ে তার ঘরের সামনের বারান্দা সম্পূর্ণ ধসে পড়েছে। ঘরের ফ্লোর ফেটে গেছে। এখন এ ঘরে থাকতে ভয় লাগে। কোন সময় যদি বাতাসে ঘর পড়ে যায় তাহলে মরণ ছাড়া আর কোন উপায় নেই। বাহেরচরের স্থানীয় বাসন্দিা নিজাম মাঝি অভিযোগ করেন, ঘর বানাইছে ঠিকই, কিন্তু এতে বালি দেয় নাই, সিমেন্ট দেয় নাই। এমনকি ইট দিলেও তা সবচেয়ে খারাপ মানের দেয়া হয়েছে। এ কারনে পানির চাপে ঘরগুলো ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। ১৬টি ঘরের মধ্যে ৫টি ঘরের কক্ষই ধসে পড়েছে। বাকীগুলোর পিলার থেকে শুরু করে দেয়াল ধসে পড়ে। সিমেন্ট দেয়া হলে একটি ইট আরেকটি ইটকে ধরে রাখতে পারতো। কিন্তু সিমেন্ট না দেয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তিনি আরো বলেন, কাজ খারাপ করেছে তার প্রমাণ ধসে পড়ার পর মিললো। এছাড়া বড় খারাপ কাজ করেছে ঘর বিতরণে। এ ঘর দিতে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা পর্যন্ত নিয়েছেন চেয়ারম্যান হারুন অর রশিদ। তার কাছে থেকেও ৩০ হাজার টাকা নিয়েছেন। কিন্তু তাকে ঘর দেননি বলে অভিযোগ করেন নিজাম। নিম্নমানের ঘর নির্মাণের চেয়েও এ এলাকায় বড় দুর্নীতি হয়েছে বাড়ির মধ্যে মুজিববর্ষের ঘর নির্মাণ করা নিয়ে। ৩টি বাড়িতে তিনটি মুজিব বর্ষের ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। সেখানকার হোটেল ব্যবসায়ী মো. অহিদ তার বাড়িতে মুজিববর্ষের ঘর পেয়েছেন। সে ঘরে তিনি হোটেলের জন্য জ্বালানি কাঠ দিয়ে ভরে রেখেছেন। বর্তমানে ঘরটি জ্বালানি কাঠের ঘর হিসেবেই ব্যবহার হচ্ছে। এর কিছুদিন দূরে মো. রফিকের বাড়িতেও একইভাবে মুজিববর্ষের ঘর নির্মিত হয়েছে। তবে ওই ঘরের নির্মাণ কাজ ধসে পড়া ঘরের চেয়ে অনেক ভালো হয়েছে। একইভাবে আলহাজ্জ্ব মেম্বরের বাড়িতেও দেয়া হয়েছে মুজিববর্ষের ঘর। ঘর বিতরণের টাকা লেনদেনের বিষয়টি অস্বীকার করে শ্রীপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হারুন অর রশিদ বলেন, নিজাম তার প্রতিপক্ষ চেয়ারম্যান প্রার্থীর লোক। এছাড়া যেখানে মুজিববর্ষের ঘর উত্তোলন করা হয়েছে তা পূর্বে নিজামসহ তার লোকজনের জিম্মায় ছিল। সেই জায়গায় ঘর উত্তোলন করায় সে ক্ষুব্ধ হয়ে আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে। ঘর পড়ে যাওয়ার পূর্বে নিজাম মাঝি ধাক্কা দিয়ে কিছু দেয়াল ফেলে দেয় বলে অভিযোগ করেন চেয়ারম্যান। ঘর দিতে কারো কাছ থেকে কোন ধরনের টাকা নেয়া হয়নি বলেও জানান চেয়ারম্যান। বিভিন্ন বাড়িতে মুজিববর্ষের ঘর উত্তোলনের বিষয়ে বলেন, ওই সকল বাড়ি এলাকায় খাস জমি রয়েছে। সেখানেই ঘর উত্তোলন করা হয়েছে। তার দাবি কোন ব্যক্তির বাড়িতে ঘর দেয়া হয়নি। তবে সরেজমিনে দেখা গেছে ব্যক্তির বাড়িতেই দেয়া হয়েছে মজিববর্ষের ঘর। এদিকে বরিশাল সদর উপজেলা চরকাউয়ার হিরন কলোনীতে নির্মিত হয়েছে মুজিববর্ষের ঘর। কীর্তনখোলা নদী সংলগ্ন এলাকায় ঘরগুলো নির্মিত হওয়ায় তা ভাঙ্গনের মুখে পড়েছে। ইতিমধ্যে জেলা প্রশাসন থেকে বালুর বস্তা ফেলে ভাঙ্গন প্রতিরোধে চেষ্টা চালানো হয়েছে। সেখানকার স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, সামান্য বাতাসে ওই ঘরের চালা উড়ে যায়। এরপর সংশ্লিষ্টরা এসে ওই চালা লাগিয়ে এরপর কাঠে লোহার পেরেক দিয়ে চালা টানা দেন। যাতে করে পরবর্তীতে টিনের চালা আর উড়ে যেতে না পারে। সেখানে ফ্লোরের ঢালাই উঠে গেছে। হাত দিয়েই তুলে আনা যায় গাথনীর ইট। ফ্লোরে ঢালাই সরে মাটি বের হয়ে এসেছে। টিনের চালায় ব্যবহৃত কাঠ যে কোন সময় ঘুনে ধরবে। আর দরজা ও জানালায় এমন সিট ব্যবহার করা হয়েছে তা ব্যবহারের পূর্বেই খুলে পড়তে শুরু করেছে। এ কলোনীতে ঘর রয়েছে ১১টি। এখানকার বাসিন্দারা বলেন, নদীর পানি বৃদ্ধি পেলেই ঘরের ফ্লোর তলিয়ে যায়। এখনো এখানে পানি ও বিদ্যুতের কোন ব্যবস্থা করা হয়নি। ১১টি ঘরের মধ্যে বেশীরভাগ ঘর তালা মারা রয়েছে। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, ওই সকল ঘর ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকায় বিক্রি করা হয়েছে। যারা ঘর নিয়েছে তাদের ঘর থাকায় তারা সেখানে আসেনি। পরবর্তীতে ওই ঘর ভাড়া দেবে। একইভাবে কীর্তনখোলা নদীর চরমোনাইতেও মুজিব বর্ষের ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। তাও ভাঙনের মুখে পড়ায় বালুর বস্তা ফেলা হয়েছে। এদিকে বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলার চাখার ইউনিয়নের সাকরাল গ্রামে দেড় একর খাস জমিতে নির্মিয়মান হতদরিদ্র পরিবারের জন্য ৭০টি ঘর বাবদ দেয়া হয়েছে ১ কোটি ২২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। যে টাকার বড় একটি অংশ লুটপাটের অভিযোগ রয়েছে। ঘর নির্মাণকালীন সময় দেখা গেছে পিলার হচ্ছে ঘরের মূলভিত্তি সেই পিলারই দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না। সামান্য ধাক্কায় তা পড়ে যাচ্ছে। ঘর নির্মাণ শুরুর পর থেকে এভাবে বহু পিলার পড়ে গিয়েছে। ওই পিলার আবার দাঁড় করিয়ে জোড়াতালি দেয়া হয়। এতো গেলো পিলারের কেচ্ছা। আর যে দেয়াল দাঁড় করানো হয়েছে তাতে সিমেন্টের অস্তিত্ব খুঁজে পাননি গ্রামবাসী। এ ব্যাপারে কৃষক ফেডারেশনের সভাপতি হারুন ভান্ডারী বলেন, সরকার থেকে ঘর বরাদ্দের মাত্র ৫০ হাজার টাকা খরচ নির্মাণ করায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তাছাড়া ঘরগুলো ৪০ থেকে ২০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে। আর এর সাথে জড়িত স্থানীয় চেয়ারম্যান-মেম্বর থেকে শুরু করে সরকারী কর্মকর্তারা। তিনি আরো বলেন, বরিশাল বিভাগে কমপক্ষে ৫০ হাজার ভূমিহীন রয়েছে, যারা একটিও ঘর পায়নি। এবিষয়ে বরিশাল বিভাগীয় কমিশনার সাইফুল হাসান বাদল বলেন, প্রথম পর্যায়ে বরিশাল বিভাগে ৬ হাজার ৮৮টি এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে ৪ হাজার ৪শ’ ৫৭টি ঘর এবং জমি দেয়া হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর তরফ থেকে। এছাড়া আরও ২ হাজার ৬৯০টি নির্মাণাধীন রয়েছে। এর মধ্যে বরিশাল জেলার মেহেন্দিগঞ্জে ১৪টি এবং ভোলার দৌলতখানে ১২টি ঘর সাম্প্রতিক ইয়াসের পানির প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। ঘরগুলো নির্মাণে কোন ত্রুটি হয়েছে কি না এবং ত্রুটি হয়ে থাকলে কে বা কারা দায়িত্বে অবহেলা করেছে সেগুলো অনুসন্ধান করার জন্য বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয় থেকে ১টি এবং বরিশাল জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে পৃথক ২টি কমিটি গঠিত হয়েছে। মেহেন্দিগঞ্জে ঘর ভেঙ্গে যাওয়ার ঘটনা তদন্তে অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনারকে প্রধান করে ৭ জুলাই তদন্ত কমিটি করা হয়। এছাড়া বরিশাল জেলার ঘর নির্মাণসহ সার্বিক বিষয় তদন্তে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকদের প্রধান করে শনিবার ১০ উপজেলার প্রতিটিতে একটি করে কমিটি করা হয়েছে। নির্মাণ ত্রুটি কিংবা অনিয়ম-দুর্নীতি তদন্তে একই দিন জেলায় ৩ সদস্যের একটি টেকনিক্যাল কমিটি করা হয়েছে। গঠিত এসব কমিটিকে ৭ কার্য দিবসের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলেন বিভাগীয় কমিশনার। উল্লেখ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে আশ্রায়ন-২ প্রকল্পের আওতায় ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারের জন্য বাসগৃহ নির্মাণ প্রকল্পে বরিশাল জেলার ১০ উপজেলার প্রায় দেড় হাজার হতদরিদ্র পরিবারের জন্য ১ হাজার ৪৫৬টি আধাপাকা ঘরের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ২৪ কোটি ৮৯ লাখ ৭৬ হাজার টাকা।