ধামরাই একটা সময় সরিষা থেকে তৈল তৈরি করার জন্য এক মাত্র ভরসা ছিলো গরুর ঘানি। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে আধুনিক নিত্যনতুন যন্ত্রপাতি আবিস্কার হওয়ায় মানুষ এসব সহজতর যন্ত্রপাতিই বেছে নিয়েছে। আর এসব যন্ত্রপাতির ভিড়ে হাড়িয়ে যাচ্ছে দেশের অনেক নাম করা পুরনো শিল্প। তেমনই একটি ঘানি শিল্প। যা আধুনিক যুগে মূল্য হীন হয়ে পরেছে। গরুর ঘানি বাদ দিয়ে বিদ্যুৎ চালিত আধুনিক যন্ত্র ব্যবহার করে অল্প খরচ ও অল্প সময়ের মধ্যেই অধিক তৈল উৎপাদন করা হচ্ছে। যার কারণে কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য ঘানি শিল্প। ঘানি শিল্প আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে। যার কারণে এই পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় ঝুঁকে পড়েছেন অনেকে। আবার পূর্বপুরুষদের পেশা হিসেবে ধরে রেখেছেন কয়েকজন। এত সব আধুনিক যন্ত্রপাতির ভিড়ে ধামরাইয়ের কুল্লা ইউনিয়নের ফুটনগর এলাকায় রাস্তার সাথেই রয়েছে রহিম এন্টারপ্রাইজ নামের একটি দোকান। যেখানে গরুর ঘানিতে সরিষার তৈল তৈরি করা হয়। একটি গরুর চোখ বেঁধে কাঁধে লাগিয়ে দেয়া হয় জোয়াল। গরুটি চরকির মতো ঘুরতে থাকে আর ঘানির নল দিয়ে টিপটিপ করে বের হয় সরিষার তৈল। প্রতি ৪০ মিনিট পর গরু পরিবর্তন করে দেয়া হয়। দোকানের মালিক সেই তৈল পাত্র থেকে তুলে কেজি প্রতি বিক্রি করেন ২৬০ টাকা করে। এর জন্য বেশ স্বাস্থ্য দেখে গরু ক্রয় করা হয়ে থাকে। গরু ক্রয়ের পরে ১৫ থেকে ২০ দিন গরুটিকে প্রশিক্ষণ দিয়ে ঘানিতে লাগানো হয। রহিম এন্টারপ্রাইজের মোঃ আব্দুর রহিম বলেন, আমাদের তিন পুরুষদের ব্যবসা এই ঘানি শিল্প। আমার দাদা মৃত হোসেন বেপারী এই ব্যবসা করতেন। তার পর আমার বাব মৃত মুগবুল হোসেন করেছেন। এখন আমি করছি। আমার মোট আটটি ঘানি রয়েছে।
এর মধ্যে সাভারে রয়েছে ৫টি এবং ধামরাইয়ের ফুটনগরে আছে ৩টি। এর চাহিদা রয়েছে অনেক। কিন্তু আধুনিক যন্ত্রপাতি বের হওয়ার কারণে আমারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। তিনি আরো বলেন, যান্ত্রিক মেশিন দিয়ে খুব কম সময়ে ও অল্প খরচে অধিক তৈল উৎপাদন করা যায়। তাই তারা বিক্রও করে অল্প টাকায়। কিন্তু ঘানি দিয়ে সময় লাগে বেশি খরচও হয় বেশি। তাই আমাদেরও বিক্রি করতে হয় বেশি টাকায়। দাম বেশি হওয়ার কারণে ইচ্ছা থাকলেও অনেকে ঘানির তৈল নেয় না। কিছু করারও নেই বাব-দাদার ব্যবসা ধরে রাখতে হবে। তাই এবাবেই কোন রকম চালিয়ে যাচ্ছি। ফুটনগর এলাকার ৮০ বছরের বৃদ্ধ ফজল উদ্দিন জানান, আমরা আগে সবসময় সরিষার তৈল দিয়েই সব ধরণের খাবার খেতাম এমন কি গোছলের পর এই তৈল শরীরেও দিতাম। শরিরে কোন ব্যাথাও হতো না আমাদের। তখন সরিষার তৈল তৈরি করা হতো একমাত্র গরুর ঘানিতে। কিন্তু এখন তো আর সেই ঘানি নেই তেমন। সব মেশিন দিয়ে ভাঙ্গানো হয়। মেশিনের তৈল তো আর ঘানির মত খাঁটি হয় না। আগে বাড়িতে ঘানির তৈরি সরিষার তৈল না আনলে গৃহিণীরা রান্নাঘরেই ঢুকতো না। বাড়িতে রান্না বন্ধ থাকতো। নিজেদের জন্য ছাড়াও বাড়ির গরুর খাবারে, পুকুরে মাছের খাবারে, পানের বরজ ও বিভিন্ন ফসলের জমিতে ব্যবহার করতাম সরিষার খৈল। কিন্তু এখন এসব কিছুই নেই। আয়ূর্বেদিক চিকিৎসক লুৎফর রহমান জানান, সরিষার তৈলে রয়েছে প্রোটিন, ভিটামিন ই, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন বি কমপ্লেক্স, ওমেগা, ফ্যাটি অ্যাসিড, ভিটামিন এসহ নানা উপাদান। সরিষার তেল ত্বক ভালো রাখে। ত্বকের ব্রণ হোক বা ট্যান পড়া, সব ক্ষেত্রেই সরিষার তেল কাজে দেয়। সরিষা তেলের পুষ্টি উপাদান, ভিটামিন ও মিনারেল চুলের অকালপক্বতা রোধ করে। প্রতিদিন রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে সরিষার তেল দিলে চুল পাকা রোধ করে। লুৎফর রহমান আরো জানান, সরিষার তেল আমাদের শরীরের রক্ত সঞ্চালনের প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে এবং যাতে বাধাপ্রাপ্ত না হয়, তার দিকে নজর রাখে। ফলে শরীর ঠিক থাকে এবং আমাদের শরীরের সারা দিনের ক্লান্তি ভরা পেশিগুলোকে উজ্জীবিত এবং সবল রাখে।এছাড়াও খাঁটি সরিষার তৈলে রয়েছে আরো অনেক উপাদান যা আমাদের শরিরের নানা ধরনের উপকার করে।