বর্ষায় প্রমত্তা যমুনা,ধলেশ্বরী ও ঝিনাই নদীতে ব্যাপক ভাঙন শুরু হয়েছে। টাঙ্গাইলের ৫ উপজেলায় ৫ শতাধিক বাড়িঘর, রাস্তা, হাট, তাঁত ফ্যাক্টরি, স’মিল ও ফসলি জমি গিলে ফেলেছে নদীগুলো। ভাঙন রোধে পানি উন্নয়ন বোর্ডের জরুরি ভাবে ফেলা জিওব্যাগও যমুনার করাল থাবা থামাতে ব্যর্থ হচ্ছে। যমুনার প্রলয়ঙ্করি ঘূর্ণিতে এক রাতেই শতাধিক স্থাপনা বিলীন হয়ে গেছে। জানা গেছে, টাঙ্গাইল সদর উপজেলা, কালিহাতী, নাগরপুর, বাসাইল ও ভূঞাপুর উপজেলায় বর্ষার শুরুতেই যমুনা,ধলেশ্বরী ও ঝিনাই নদীতে ভাঙন শুরু হয়েছে। সদর উপজেলার কাকুয়া ইউনিয়নের তিনটি ওয়ার্ডের শতাধিক বাড়িঘর, তাঁত ফ্যাক্টরি, স’মিল ও হাট, যমুনার গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ইউনিয়ন পরিষদের সাথে বঙ্গবন্ধু সেতুর যোগাযোগের সংযোগের অসমাপ্ত শেখ হাসিনা সড়কের একাংশ যমুনার পেটে চলে গেছে। এছাড়ার মাহমুদ নগর ইউনিয়নের মাকরকোল, কেশবমাইঝাইল, তিতুলিয়া, নয়াপাড়া, কুকুরিয়া, বারবাড়িয়া, কাতুলী ইউনিয়নের দেওরগাছা, রশিদপুর, ইছাপাশা, খোশালিয়া, চানপাশা ও নন্দপাশা, হুগড়া ইউনিয়নের মসপুর, বারবেলা, চকগোপাল ও কচুয়া নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। সদর উপজেলার কাকুয়া ইউনিয়নের উত্তর চরপৌলী, দশখাদা, হাটখোলা, পানিকোড়া এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, চরপৌলী হাটখোলা সম্পূর্ণ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড হাটখোলাটি রক্ষার জন্য জরুরী ব্যবস্থা হিসেবে ৩০০মিটার এলাকায় জিওব্যাগ ফেলে। জিওব্যাগগুলোও যমুনার তীব্র ¯্রােতে তলিয়ে গেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড বার বার জিওব্যাগ ফেলে ভাঙন ঠেকানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। টাঙ্গাইল সদর ও কালিহাতী উপজেলার সীমান্ত এলাকা উত্তর চরপৌলী ও আলীপুর গ্রামের অংশে অসমাপ্ত শেখ হাসিনা সড়ক (নর্দান প্রজেক্ট) রক্ষার জন্য ১০০ মিটার এলাকায় ফেলা জিওব্যাগ তলিয়ে গিয়ে ভাঙনে সড়কটির ৫০০-৬০০মিটার নদীগর্ভে চলে গেছে। কাকুয়া ইউপি চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বলেন, ভাঙনের শিকার হয়ে তার ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রাম ইতোমধ্যে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড ভাঙনরোধে জিওব্যাগ ফেললেও তা কোনো কাজে আসছে না। তারা সদর উপজেলার মাহমুদ নগর ইউনিয়নের গোলচত্তর থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু পর্যন্ত স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের দাবি জানান। টাঙ্গাইলের বাসাইলে গত এক সপ্তাহে ঝিনাই নদীর প্রায় ২০ কিলোমিটার এলাকায় হঠাৎ তীব্র নদী ভাঙন দেখা দিয়েছে। ইতিমধ্যে প্রায় ১০-১৫টি ভিটাবাড়ি ও ফসলি জমিসহ বিস্তীর্ণ এলাকা বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙনের ফলে অনেকেই বাড়ি-ঘর ভেঙে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিচ্ছে। অনেকেই আবার শেষ সম্বল বসতভিটে হারিয়ে হয়েছেন আশ্রয়হীন। এছাড়াও ঐ এলাকার প্রায় ৫ শতাধিক পরিবারের ভাঙন আতঙ্কে কাটাচ্ছেন নির্ঘুম রাত। বাসাইল উপজেলার নদী তীরবর্তী ফুলকি, কাশিল, কাঞ্চনপুর ও হাবলা ইউনিয়নের প্রায় ২০ কিলোমিটার এলাকার অন্তত ১৫টি গ্রামে ইতোমধ্যে ভাঙন দেখা দিয়েছে। ভাঙনকবলিত গ্রামগুলো হল- ফুলকি ইউনিয়নের দোহার, হাকিমপুর, জশিহাটি ও একঢালা। কাশিল ইউনিয়নের দাপনাজোর, দেউলী, কামুটিয়া, নর্থখোলা, কাশিল, থুপিয়া, নাকাছিম ও বিয়ালা। কাঞ্চনপুর ইউনিয়নের কাজিরাপাড়া, বিলপাড়া, মানিকচর ও আদাজান। ভাঙনের হুমকিতে রয়েছে পাকা সড়ক, খেলার মাঠ, হাট-বাজার, ধর্মীয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন স্থাপনা। এখনই ব্যবস্থা না নিলে নদীগর্ভে বিলীন হবে বসতবাড়িসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা।
ছিন্নমূলের তালিকায় যোগ হবে এলাকার কয়েক হাজার মানুষ। স্থানীয়দের অভিযোগ, সারা বছরই ঝিনাই নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে ড্রেজার ও বেকু দিয়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের মহোৎসব চলে। প্রভাবশালীদের বালু উত্তোলনের ফলে ঝিনাই নদীর ভাঙনের তীব্রতা দিন দিন বাড়ছে। ফুলকি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাহিদুল ইসলাম বাবুল বলেন, ফুলকি ইউনিয়নের ঝিনাই নদী তীরবর্তী দোহার দক্ষিণ পাড়া ও একঢালা গোয়াল পাড়া মসজিদের পানি উন্নয়ন বোর্ড কাজ করেছে। ইতোমধ্যে অনেক কৃষকের আবাদী জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নের ভৈরববাড়ি গ্রামে যমুনা ভাঙনে ৯২টি পরিবার গৃৃহহীন হয়ে পড়েছে। এতে শতাধিক মানুষ অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছেন। এছাড়াও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মসজিদ ও শতাধিক ঘর বাড়ি হুমকির মুখের রয়েছে। বিষয়টি দুর্গাপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান এস এম আনোয়ার হোসেন নিশ্চিত করেছেন। পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, যমুনার পানি কমতে থাকায় শুক্রবার রাতে ও শনিবার দুপুর পর্যন্ত ভাঙন দেখা দেয় গ্রামটিতে। শুক্রবার রাতে ১৪টি বাড়ি নদী গর্ভে পুরোপুরি বিলিন হয়ে গেছে। ভাঙন শুরু হওয়ার পর প্রায় ১০০টি ঘরবাড়ি ভেঙে শনিবার ও রবিবারে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। হঠাৎ করে একদিনে একটি গ্রামের এতগুলো পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়ায় হাহাকার শুরু হয়েছে গ্রামটিতে। এ দিকে গত শনিবার দুপুরে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে চাল ও আর্থিক সহায়তা দেয়া হয়েছে। কালিহাতির ভৈরববাড়িতে ভাঙনের শিকার পরিবারগুলো বাড়িঘরের জিনিসপত্র নিয়ে রাস্তায় জমা করে রেখেছে। কেউ কেউ নিরাপদ স্থানে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। গ্রামটিতে যাওয়ার পথে দেখা যায় বেশ কিছু অংশ গাইড বাঁধ দেয়া আছে। পার্শ্ববর্তী বেলটিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মসজিদ ও শতাধিক ঘর বাড়ি হুমকির মুখে রয়েছে। গাইড বাঁধের পর আরো কিছু অংশ জিও ব্যাগ ফেলা হয়েছে ভাঙন প্রতিরোধে। এ বছর বর্ষা মৌসুমের শুরুতে এ জিও ব্যাগগুলো ফেলা হয়েছে বলে পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানিয়েছে। দুর্গাপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান এস এম আনোয়ার হোসেন জানান, ৯২টি ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। জেলা প্রশাসক ড. মো. আতাউল গনি শনিবার সকালে ভাঙন কবলিত ওই গ্রাম পরিদর্শন করেছেন। নদীতে ঘরবাড়িসহ সবকিছু বিলিন হয়ে যাওয়া পরিবারকে তিনি পাঁচ হাজার টাকা করে অর্থ সহায়তা করেছেন। এছাড়া ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারগুলোকে খাদ্য সহায়তা দেয়া হয়েছে। এদিকে টাঙ্গাইলের নাগরপুর উপজেলার সলিমাবাদ ইউনিয়নের পাইকশা মাইঝাইল, খাষ ঘুণি পাড়া, খাষ তেবাড়িয়া, চর সলিমাবাদ, ভূতের মোড়, ভারড়া ইউনিয়নের শাহজানি, মারমা, পাঁচতারা, আগদিঘলীয়া, উলাডাবের রাস্তা, বাজারঘাট ও ঘর বাড়ি যমুনার ও ধলেশ্বরীর ভাঙনের কবলে পড়েছে। খাষ তেবাড়িয়া গ্রামের কৃষক মো. দানেজ শেখ জানান, দুই বছরে তিনি ছয় বার ঘর সরিয়ে নিয়েছেন। এখন তার আর যাবার কোনো জায়গা নেই। তেবাড়িয়া ৫ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মো. রাজা মিয়া জানান, যমুনার ভাঙনের কারণে ঘরবাড়ি নিয়ে তারা একটু আশ্রয়ের জন্য বিভিন্ন এলাকায় চলে যাচ্ছেন। তিনি জনপ্রতিনিধি হিসেবে সরকারের কাছে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের দাবি জানান। ভূঞাপুর উপজেলায় যমুনা তীরবর্তী গোবিন্দাসী ইউনিয়নের ভালকুটিয়া এলাকায় ভাঙনের তীব্রতা চড়ম আকার ধারন করছে। এ বিষয়ে টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সিরাজুল ইসলাম বলেন, যমুনা, ধলেশ্বরী ও ঝিনাই নদীর ভাঙন রোধে বিভিন্ন পয়েন্টে কাজ অব্যাহত আছে। নতুন করে ভাঙন কবলিত পয়েন্টগুলোতে জরুরি ব্যবস্থা হিসেবে জিওব্যাগ ফেলে ভাঙন ঠেকানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। প্রতি বছর অস্থায়ী ভাঙনরোধে শুধু টাকাই অপচয় হচ্ছে। নদীর এই ভাঙনরোধে স্থায়ী পরিকল্পনা নেয়া জরুরি। ভাঙনরোধে তিন বছর আগে একটি স্থায়ী বাঁধের প্রকল্প মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। দীর্ঘ তিন বছরেও প্রকল্পটি আলোর মুখ দেখেনি ফলে কাজ করা সম্ভব হচ্ছে না।