শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৮:৩১ অপরাহ্ন

কাঁদো বাঙালি কাঁদো

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ৫ আগস্ট, ২০২১

অন্যান্য দিনের মতোই রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালের ১৪ই অগাস্ট রাত ৮ টা নাগাদ ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িতে ফেরেন। খাওয়া-দাওয়া শেষে রাত ১২টার মধ্যেই সে বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে যায়। তখন সে বাড়ির নিচ তলায় একটি কক্ষে কর্মরত ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহকারী এ এফ এম মুহিতুল ইসলাম। রাত তিনটা নাগাদ ঘুমাতে যান তিনি। এর কিছুক্ষণ পরেই সে বাড়িতে টেলিফোনের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তি মুহিতুলকে ঘুম থেকে ডেকে তোলেন। কারণ রাষ্ট্রপতি তার সাথে কথা বলতে চেয়েছেন। মুহিতুল ইসলাম ২০১৬ সালে মারা যান। ১৯৯৬ সালে মুহিতুল ইসলাম শেখ মুজিব হত্যা মামলার বাদী হয়েছিলেন। ২০১০ সালে এক সাক্ষাতকারে মুহিতুল ইসলাম বলেন, ‘ বঙ্গবন্ধু আমাকে বললেন, সেরনিয়াবাত সাহেবের বাসায় আক্রমণ করছে। ওই অবস্থায় আমি পুলিশকে টেলিফোনের চেষ্টা করছিলাম। তারপরে বঙ্গবন্ধু উপর থেকে নিচে নেমে এলেন। গেঞ্জি গায়ে লুঙ্গি পরা। তখন উনি আমাকে বললেন যে ‘আমার কাছে দে’। ‘আমার কাছ থেকে তিনি রিসিভারটা নিলেন। নিয়ে বললেন যে , ‘হ্যালো আমি প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিব বলছি’। উনি একথা বলার সাথে সাথেই বৃষ্টির মতো গুলি আসা শুরু হলো। উনি গাড়ি-বারান্দায় এসে দাঁডিয়েছেন। বললেন ‘পুলিশ সেন্ট্রি,আর্মি সেন্ট্রি – এতো গুলি চলছে তোমরা কী করো’? আমিও ওনার পিছনে এসে দাড়ালাম। উনি একথা বলেই উপরে উঠে চলে গেলেন’। এ গোলাগুলির সময় রাষ্ট্রপতিসহ তাঁর বাড়ির কেউ ঘটনা সম্পর্কে আঁচ করতে পারেন নি।
শেখ মুজিবুর রহমানের ছেলে শেখ কামালকে যখন বাড়ির নিচতলায় গুলি করে হত্যা করা হয় তখন ঘটনা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাচ্ছিল, বলছিলেন মুহিতুল ইসলাম। ধানমন্ডির সে বাড়িতে সশস্ত্র হত্যাকারীরা প্রথমে হত্যা করে শেখ কামালকে। গোলাগুলির আওয়াজ শোনার পর ঘটনা সম্পর্কে জানতে বাড়ির নিচ তলায় নেমে আসেন শেখ কামাল। বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ ছেলে শেখ কামাল তিন তলা থেকে দ্রুত নিচে নেমে ‘পুলিশ ভাই, আর্মি ভাই-কিসের গোলাগুলি’ উচ্চারণ করে যখন রিসিপশনের বাইরের দরজায়, তখন মেজর নূর ও ক্যাপ্টেন বজলু এবং পেছনে সৈন্যদল উপস্থিত। মুহিতুল ইসলাম বলেন ‘পাঁচ-ছয় জন আর্মি, কেউ কালো পোশাকধারী কেউ খাকি পোশাকধারী – শেখ কামালের সামনে এসে বললো ‘হ্যান্ডস আপ’। কামাল ভাই বলছে, ‘আমি প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবের ছেলে শেখ কামাল। তখনই সাথে-সাথে ব্রাশ ফায়ার’। কোনো সুযোগ না দিয়েই ক্যাপ্টেন বজলু শেখ কামালকে গুলি করে। তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। গুলি খেয়ে শেখ কামাল যখন আর্তনাদ করে উঠেছিল তখন বঙ্গবন্ধু দোতলায় সেনাপ্রধানের সঙ্গেই ফোনে কথা বলছিলেন। ইতিমধ্যে গুলির আঘাতে একজন সেনা ও পুলিশ সদস্য মারা পড়েছে। মেজর নূর ও ক্যাপ্টেন বজলু যখন এই বাড়ির নিচতলা নিয়ন্ত্রণে ব্যস্ত, তখন ল্যান্সার মহিউদ্দিনের গ্রুপ পশ্চিম দিক থেকে এবং ট্যাংক নিয়ে মেজর ফারুক ৬৭৭ নম্বর বাড়ির সামনে পৌঁছে গেছে। মেজর ফারুক চিৎকার করে বলতে থাকেন ‘কিল অ্যান্ড ক্রাশ এভরি বডি।’
মুহিতুল ইসলাম বলছিলেন, একজন রাষ্ট্রপতির বাড়িতে যে ধরণের নিরাপত্তা থাকা দরকার সেটি ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে ছিল না। তাছাড়া রাষ্ট্রপতির বাড়িতে আক্রমণের পরেও কোন তরফ থেকে কোন ধরনের সহায়তা আসেনি।
প্রথম পর্যায়ের গোলাগুলি বন্ধ হলে আতংকিত মেজ ছেলে জামাল ও তার স্ত্রী রোজি, শেখ কামালের স্ত্রী সুলতানা ও বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ নাসের বঙ্গবন্ধুর কক্ষে এসে জড়ো হয়েছেন। সেখানে উপস্থিত হয় কিছুক্ষণ আগে শেখ মনি দম্পতিকে খুন করে আসা মেজর আজিজ পাশা, রিসালদার মোসলেম উদ্দিনের দল। প্রথমে বেগম মুজিব, পরে শেখ জামাল, নববধূ রোজি, সুলতানাকে হত্যা করে। নিচে শেখ নাসেরকে গুলি করলে তিনি পানির জন্য আর্তনাদ করছিলেন। নরপিশাচের দল পানির বদলে উপর্যুপরি গুলি দিয়ে তার মৃত্যু নিশ্চিত করে। মেজর ফারুকের নির্দেশমতো মেজর মহিউদ্দিন ল্যান্সার ও কয়েকজন সৈনিক দৌঁড়ে সিঁড়ি বেয়ে যখন দোতলায় পৌঁছে, তখনি বঙ্গবন্ধু কক্ষ থেকে বাইরে বেরিয়ে আসছিলেন। যুদ্ধাংদেহি এই সেনাদলকে দেখে তিনি উচ্চকণ্ঠে উচ্চারণ করেন ‘তোরা কী চাস, আমাকে কোথায় নিয়ে যাবি?’ এরই মধ্যে তারা বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে ধরে এবং নিচে নামিয়ে আনতে উদ্যত হয়। এক পর্যায়ে এভারেস্টের মত মাথা উঁচু করা বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে উচ্চারিত হয় ‘তোরা বেয়াদবি করিস না’। এই সময়ে নিচ থেকে মেজর নূর ও ক্যাপ্টেন বজলু ওপরে উঠছিল। বঙ্গবন্ধুর চিৎকারের সঙ্গে সঙ্গে মেজর নূর বঙ্গবন্ধুর পাশ থেকে সবাইকে সরে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। মুহূর্তেই সবাই সরে গেলে মেজর নূর তার হাতের এসএমজি থেকে বঙ্গবন্ধুর বুক লক্ষ্য করে গুলি চালায়। যে মানুষটির বুকে ছিল বাংলাদেশের মানচিত্র, বাংলাদেশ যার সৃষ্টি, ১৮টি গুলিতে সেই মানুষটি সিঁড়িতেই প্রাণ হারান। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর খুনি নূর-বজলুরা নিচে নেমে যায়।
মুহিতুল ইসলামের বর্ণনা অনুযায়ী ধানমন্ডির সে বাড়িটিতে সর্বশেষ হত্যা করা হয় বঙ্গবন্ধুর ছোট ছেলে শেখ রাসেলকে। তখন তার বয়স মাত্র দশ বছর। এ হত্যাকান্ডটি হয়েছিল মুহিতুল ইসলামের সামনে।
‘রাসেল দৌড়ে এসে আমাকে জাপটে ধরে। আমাকে বললো, ‘ভাইয়া আমাকে মারবে না তো ? ওর সে কণ্ঠ শুনে আমার চোখ ফেটে পানি এসেছিল। এক ঘাতক এসে আমাকে রাইফেলের বাট দিয়ে ভীষণ মারলো। আমাকে মারতে দেখে রাসেল আমাকে ছেড়ে দিল। ও (শেখ রাসেল) কান্নাকাটি করে বলছিল ‘আমি মায়ের কাছে যাব, আমি মায়ের কাছে যাব’। এক ঘাতক এসে ওকে বললো, ‘চল তোর মায়ের কাছে দিয়ে আসি’। বিশ্বাস করতে পারিনি যে ঘাতকরা এতো নির্মমভাবে ছোট্ট সে শিশুটাকেও হত্যা করবে। রাসেলকে ভিতরে নিয়ে গেল এবং ‘তারপর ব্রাশ ফায়ার’।
রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারের সব সদস্যকে হত্যার পর ঘাতকরা একে অপরকে বলছিল, ‘অল আর ফিনিশড (সবাই শেষ)’।
সপরিবারে শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার সাথে জড়িত ছিল সেনাবাহিনীর কিছু কর্মকর্তা। সে সময় ঢাকা সেনানিবাসে লেফট্যানেন্ট কর্নেল হিসেবে কর্মরত ছিলেন আমিন আহমেদ চৌধুরী, যিনি পরে মেজর জেনারেল হয়েছিলেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোর পাঁচটার দিকে হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত একজন সেনা কর্মকর্তা মেজর রশিদের নেতৃত্বে একদল সেনা তার বাড়ি ঘিরে ফেলে। আমিন আহমেদ চৌধুরী তখনো জানতেন না যে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে। মেজর রশিদের নেতৃত্বে সৈন্যরা আমিন আহমেদ চৌধুরী এবং তৎকালীন কর্নেল শাফায়াত জামিলকে নিয়ে যায় মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের বাড়িতে। জেনারেল জিয়া তখন সেনাবাহিনীর উপ-প্রধান। জেনালের জিয়াউর রহমানের বাড়িতে ঢোকার সময় রেডিওর মাধ্যমে আমিন আহমেদ চৌধুরী জানতে পারেন যে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়েছে।
‘জেনারেল জিয়া একদিকে শেভ করছেন একদিকে শেভ করে নাই। স্লিপিং স্যুটে দৌড়ে আসলেন। শাফায়াতকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘শাফায়াত কী হয়েছে’? শাফায়াত বললেন, ‘অ্যাপারেন্টলি দুই ব্যাটালিয়ন স্টেজড্ এ ক্যু। বাইরে কী হয়েছে এখনো আমরা কিছু জানি না। রেডিওতে অ্যানাউন্সমেন্ট শুনতেছি প্রেসিডেন্ট মারা গেছেন। তখন জেনারেল জিয়া বললেন, ‘সো হোয়াট? লেট ভাইস প্রেসিডেন্ট টেক ওভার। উই হ্যাভ নাথিং টু ডু উইথ পলিটিক্স’।
সেনানিবাসের দুটি ব্যাটালিয়ন এ অভ্যুত্থানের সাথে জড়িত থাকলেও পুরো সেনাবাহিনী এর পক্ষে ছিল না বলে উল্লেখ করেন আমিন আহমেদ চৌধুরী ‘ঢাকা সেনানিবাসে যখন এ অভ্যুত্থানের খবর ছড়িয়েছে তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে’। এ অভ্যুত্থান পরিকল্পনার খবর কেন আগে জানা সম্ভব হয়নি এবং কেন সেনাবাহিনীর অন্য কোন ইউনিট এগিয়ে আসেনি সেটি আজও এক বিরাট প্রশ্ন।
আমিন আহমদ চৌধুরীর বর্ণনা ছিল এ রকম, ‘আর্টিলারি রেজিমেন্টের কিছু সৈন্য ছিল সেখানে। মেজর হুদা ছিলেন। আমি যেহেতু হুদাকে চিনতাম, তাকে বলার পর সে আমাকে ঢুকতে দেয়। আমি দোতলার সিঁড়িতে উঠতেই বঙ্গবন্ধুর লাশটা দেখি। তার চশমা ও পাইপটাও পড়ে ছিল। দূর থেকে ভেতরে দেখলাম বেগম মুজিব পড়ে আছেন। যে লোকটার অঙ্গুলি হেলনে পঁচাত্তর মিলিয়ন লোক উঠছে-বসছে, সে লোকটাকে তার সৃষ্ট আর্মি মেরে ফেললো। এটা কী করে সম্ভব ? পাকিস্তানিদের কাছে মারা যান নাই, মারা গেল শেষ পর্যন্ত বাঙালির কাছে’।
অভ্যুত্থানের পর অনেকে তাকিয়ে ছিলেন তৎকালীন রক্ষীবাহিনীর প্রতিক্রিয়ার দিকে। সেনাবাহিনীর সাথে রক্ষীবাহিনীর কোন সংঘাত তৈরি হয় কী- না সেটি নিয়েও অনেকে উদ্বিগ্ন ছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে ধরণের কিছু ঘটেনি। রক্ষীবাহিনীর দিক থেকে কোন প্রতিক্রিয়া না হওয়ায় অনেকে অবাক হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর উল্টো রক্ষীবাহিনী আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল বলে জানান আমিন আহমেদ চৌধুরী। ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ি থেকে আমিন আহমেদ চৌধুরী দুপুর নাগাদ পৌঁছেন সাভারে অবস্থিত রক্ষীবাহিনীর সদর দপ্তরে। আমিন চৌধুরীর দায়িত্ব ছিল রক্ষীবাহিনী যাতে আতঙ্কগ্রস্থ না হয় সে বার্তা তাদের কাছে পৌঁছে দেয়া।
‘আমি সেখানে গিয়ে বলি যে, সেনাবাহিনীর কিছু লোক এটার (হত্যাকান্ড) সাথে জড়িত থাকলেও পুরো সেনাবাহিনী এর সাথে জড়িত নয়। সে হিসেবে সেনা প্রধানের বাণী নিয়ে আমি এখানে আসছি’। হত্যাকান্ডের পর তৎকালীন আওয়ামী লীগের একজন সিনিয়র নেতা এবং মন্ত্রী পরিষদের সদস্য খন্দকার মোশতাক আহমেদ রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন। অভ্যুত্থানের খবর জানাজানি হবার পরে সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যেই এক ধরনের অবিশ্বাস তৈরি হয়েছিল বলে উল্লেখ করেন আমিন আহমেদ চৌধুরী। তিনি জানান, ঘটনার আকস্মিকতায় অনেকে হতবিহ্বল হয়ে পড়েছিলেন। কী করতে হবে তারা ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলেন না।
মি: চৌধুরীর বর্ণনায়, ‘যখন সকাল হয়ে গেছে তখন দেখা যাচ্ছে কোন পলিটিকাল ডিরেকশন আসতেছে না। বঙ্গবন্ধু মারা গেছে, এখন আমরা কী করবো? কার পেছনে দাঁড়াবো ? তারা তো খন্দকার মোশতাককে বসিয়ে দিয়েছে। এখন আমরা তাকে ডিসলজ (ক্ষমতাচ্যুত) করবো ? এর বিরুদ্ধে গেলে পুরোপুরি যুদ্ধ করতে হবে। কারণ ওরা ট্যাংক বের করে অলরেডি বঙ্গভবনে বসে গেছে, ফার্মগেটের সামনে বসে গেছে, জাহাঙ্গীর গেটের ভেতরে অলরেডি মুভ করছে। পরিস্থিতি অ্যাসেস করতে হচ্ছে। আমরা কি পারবো? আমাকে তো জানতে হবে আমার কাছে কত সৈন্য আছে এবং কত অ্যামুনিশন আছে। কনফিউশনটা খুব বেশি ছিল’। খন্দকার মোশতাক আহমেদ রাষ্ট্রপতি হলেও ক্ষমতার কেন্দ্রে ছিলেন অভ্যুত্থানের সাথে জড়িত ঘাতক জুনিয়র সেনা কর্মকর্তারা।
সে থেকে পরবর্তী প্রায় ১৫ বছর বাংলাদেশের ইতিহাস সেনাবাহিনীর ভেতরে অভ্যুত্থান, পাল্টা অভ্যুত্থান এবং সামরিক শাসনের ইতিহাস।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com