সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৪০ পূর্বাহ্ন

ধারের টাকায় মূল্যস্ফীতি যোগ করা যাবে কি ?

জামান শামস :
  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ২৪ আগস্ট, ২০২১

আবার এই বিতর্কটি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। আমি একটি উদ্ধৃতি এখানে তুলে ধরছি যেখানে বলা হচ্ছে- কাগজের টাকার নিজস্ব কোনো মূল্য নেই। টাকার নির্দিষ্ট সময়ের বাজারমূল্যই তার মূল্য। আমরা যখন কাউকে টাকা দেই তখন প্রকৃতপক্ষে ওই সময়ের বাজারমূল্যই পরিশোধ করি। তাই কর্জ দিলে সেটা ফেরত নেয়ার সময় একই বাজারমূল্য গ্রহণ করাই যোক্তিক ও ইনসাফের দাবি।
যুক্তি দেয়া হচ্ছে, যদিও কাগজের টাকায় লিখিত পরিমাণ কম বা বেশি করা কিছুতেই সুদ হতে পারে না। যারা এটাকে সুদ বলেন তারা মূলত ন্যায় ইনসাফের খেলাপ বলেন। তারা ইসলামকে আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করতে চান, মর্মকে গ্রহণ করতে আগ্রহী নন। তারা এমন একটা সময়ের অর্থব্যবস্থার সাথে এটা তুলনা করেন যখনকার অর্থব্যবস্থা এমন কিছুর বিনিময়ে হতো (দিনার, দিরহাম এবং অন্যান্য) যার নিজস্ব মূল্য ছিল এবং তারা প্রাকৃতিক ও স্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়া মূল্যের হ্রাস-বৃদ্ধির সাথে বর্তমান কাগুজে মুদ্রার তুলনা করেন।
উপরের বক্তব্যটি মূলত একটি ভুল পারসেপশন থেকে উদ্ভূত। টাকা নিজে কোনো পণ্য নয় বরং যেকোনো পণ্যের বিনিময় মাধ্যম। এটি বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে, অর্থাৎ যেকোনো লেনদেন করার জন্য মুদ্রা ব্যবহার করা যায়। মুদ্রার এটাই সবচেয়ে প্রধান কাজ। আবার টাকা মূল্যের পরিমাপক হিসেবে কাজ করে, অর্থাৎ যেকোনো অর্থনৈতিক পণ্য বা সেবার মূল্য কত এটা নির্ধারণ করা টাকার একটি কাজ। টাকার অস্তিত্ব আছে বলেই আমরা খুব সহজে একজন শ্রমিকের দৈনিক মজুরি ১০০ টাকা নির্ধারণ করতে পারি, একটা বইয়ের মূল্য ২০০ টাকা নির্ধারণ করতে পারি, এক কেজি চালের মূল্য ২৫ টাকা নির্ধারণ করতে পারি। এতে করে অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপ সহজসাধ্য হয়ে যায়। এটি বাটখারা মাত্র। সমস্যা হচ্ছে, সুদি ব্যবস্থা বাটখারাকে তার জায়গায় না রেখে এটাকেই খোদ পণ্য বিবেচনা করতে শিখিয়েছে এবং পণ্যেমূল্যের স্ফীতিকে মুদ্রা বা টাকার উপর আরোপ করে দিয়েছে। অথচ দু’টি সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়।
মূল্যস্ফীতি বলতে সাধারণত একটি নির্দিষ্ট সময়ে কোনো দেশের দ্রব্য বা সেবার মূল্যের স্থায়ী একটা র্ঊর্ধ্বগতি বোঝায়। সাধারণভাবেই মানুষ নিত্যদিন যে দ্রব্যের প্রয়োজন বোধ করে তার দাম নিয়েই তার চিন্তা থাকে। আর তাই মূল্যস্ফীতি মানে অর্থনীতির সব দ্রব্যের দামের পরিবর্তনকেই বোঝায় না বরং জনগণের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের একটি ‘বাস্কেট’ বা গুচ্ছের (বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২৬৪টির মতো পণ্যের একটি বাস্কেট আছে) গড় দাম একটি নির্দিষ্ট সময়ে কতটুকু পরিবর্তিত হলো তাই নির্দেশ করে।
মুদ্রাস্ফীতি বলতে অর্থনীতিতে মুদ্রার সরবরাহ বৃদ্ধিকেই বোঝানো হয়। অর্থনীতিতে মুদ্রার সরবরাহ বেড়ে গেলে এবং পণ্য ও সেবার সরবরাহ অপরিবর্তিত থাকলে মূল্যস্ফীতি ঘটে। তার মানে পণ্যের মূল্য বাড়ে। কারণ তখন অনেক বেশি টাকা সীমিত পণ্য ও সেবার পেছনে ধাওয়া করে। এতে চাহিদা ও মূল্যস্তরÑ দু’টিই বেড়ে যায়। শাস্ত্রীয় ও আভিধানিক অর্থেও মুদ্রাস্ফীতির অর্থ সব ধরনের পণ্য ও সেবামূল্যের ক্রমাগত বৃদ্ধি, যা সাধারণত ঘটে অতিরিক্ত মুদ্রা সরবরাহের কারণে, যাতে অর্থের মূল্য হ্রাস পায়।
কাগজের টাকার নিজস্ব কোনো মূল্য নেই, সুন্দর মুখরোচক কথার মাধ্যমে তাদের যুক্তি হলো, ‘১০ বছর আগে আমি একজন থেকে ৫০ হাজার টাকা ধার নিয়েছিলাম। এখন আমি আজকে যদি ১০ বছর আগের সেই লোককে শুধু ৫০ হাজার টাকা পরিশোধ করে দিই এটা কি ইনসাফ হবে? আমার তো মনে হয় ইনসাফ হবে না। ঋণদাতা যদি মুদ্রাস্ফীতিসহ তার টাকা দাবি করে তখন সে দাবিকে কিভাবে নাকচ করা সম্ভব! এটা তো ইনসাফের দাবি।’ চমৎকার যুক্তিসঙ্গত কথাই বটে।
এখানে শব্দটি মুদ্রাস্ফীতি নয়, হবে মূল্যস্ফীতি। অর্থাৎ তিনি বুঝাতে চেয়েছেন যে কাজের জন্য, সেটা পণ্য বা সেবা, ১০ বছর আগে ৫০ হাজার টাকা কর্জ নেয়া হলে এখন কেন ওই পরিমাণই পাবে? কারণ ওই ৫০ হাজার টাকায় কেনা পণ্য বা সেবার মূল্য তো ইতোমধ্যে বহুগুণ হয়েছে। কিন্তু একজন মুসলমান হিসেবে কয়েকটি পয়েন্ট একটু ভাবুনÑ
১. আপনি আপনার কোনো ভাইকে বিপদের সময় কর্জ দিয়েছেন। হতে পারে তার কোনো রোগীর চিকিৎসা খরচ মিটাতে, কোনো বালেগা মেয়ের বিয়ে দিতে কিংবা কোনো ছাত্রের টিউশনের টাকা দিতে। এর কোনোটাই বাণিজ্যিক নয়, পরন্তু প্রত্যেকটিই কোনো না কোনো জরুরত মেটাতে। আপনি যে ইনসাফের দোহাই দিলেন, সেই ইনসাফ কি বলে যে, একজন দুর্দশাগ্রস্ত ব্যক্তিকে কর্জ দিয়ে তার থেকে অতিরিক্ত অর্থ দাবি করা?
২. ইসলাম সব ধরনের কর্জকে কর্জে হাসানা বলে সাব্যস্ত করেছে। মনে রাখতে হবে, কর্জে হাসানা আর ঋণ এক কথা নয়। কর্জে হাসানার ক্ষেত্রে অতিরিক্ত দাবি তো পরে, কর্জ গ্রহীতা বিপদগ্রস্ত হলে এবং কর্জ পরিশোধে অপারগ হলে আসল টাকাও আপনি মাফ করে দেবেন, এটাই কুরআন ও হাদিসের নির্দেশ। বিপদগ্রস্ত মানুষকে উপকার করতে গিয়ে আরো বিপদগ্রস্ত করা কি তবে ইনসাফ?
৩. ‘মুনাফা বা অতিরিক্ত পাওয়া হলো অর্থের নিজস্ব গুণ’ এই পারসেপশানটিও ইসলামের দৃষ্টিতে গলদ। ভাবতে পারেন, যেঅর্থ আপনি আরেকজনকে কর্জ দিয়েছেন তা দিয়ে সে তো কোনো ফায়দা পেয়েছে। কাজেই সেখানে আপনারও হিস্যা রয়েছে। নিশ্চয়ই। তবে এটাও মানতে হবে যে, কর্জ দেয়ার সময় কি আপনার এমন নিয়ত ছিল? থাকলে আপনি একটি হারাম নিয়ত করেছিলেন। ইসলামে, অর্থ নিজে কোনো উৎপাদন, বণ্টন, বাজারজাতকরণ বা পরিচালনের কাজ এককভাবে করতে পারে কি যদি না কিছু মানুষের শ্রম তাতে যুক্ত হয়।
৪. সাহস করে যে কথাটি আপনি বলতে পারেননি তা হলোÑ কর্জ না দিয়ে যদি সুদে খাটাতেন তাহলে তো বছর বছর বিনিময় পেতেন। ভাই, হারাম জিনিসের কোনো বিকল্প তালাশ করাও হারাম। মাথায় মূল্যস্ফীতি, মুদ্রাস্ফীতির মতো গতানুগতিক ও সুদভিত্তিক সমাজ কাঠামোর চিন্তা থাকলে এমন সমান্তরাল বিকল্পের স্বপ্ন দেখবেনই। ভাগ্য ভালো যে, ব্যাংকিং অপারেশান নিয়ে এমন কথা মিসরের আল আজহারের মতো আপনি বলেননি। (জেনে নিন, সত্তরের দশকে তারা প্রচলিত ব্যাংকের সুদকে হালাল ফতোয়া দিয়েছিল)।
সর্বশেষে বলব, ইসলামী অর্থব্যবস্থায় পণ্য কেনাবেচার মাধ্যম হিসেবে মুদ্রা বা টাকার উপস্থিতি অস্বীকার করেনি, কিন্ত কোনো অবস্থাতেই মাধ্যমকে খোদ পণ্য বিবেচনায় নিতে নিষেধ করেছে। তদুপরি যুক্তি দিয়ে তো ইসলামের বিধান পরিপালন করা যায় না। এখানে বিশ্বাস, ভালোবাসা এবং কল্যাণচিন্তা মুখ্য। ইসলাম ব্যক্তিগত স্বার্থ লাভের চেয়ে মানুষের কল্যাণকে গুরুত্ব দিয়েছে। মানবিক বিষয় উপেক্ষিত হলে ইসলামের দ্বীন হিসেবে বরং শ্রেষ্ঠত্বের অসম্মানই হয় বৈকি।
আল্লাহ আমাদের সহিহ বুঝ দিন। আমিন। সাবেক অতিরিক্ত এমডি, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com