রবিবার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৩:৩৮ অপরাহ্ন

বিজয়নগরে সবুজ মাল্টা, বাহিরে গাঢ় সবুজ ভেতরে সুমিষ্ট রসে স্বাদে ভরপুর

বিজয়নগর (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) প্রতিনিধি :
  • আপডেট সময় সোমবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২১

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলার কৃষকরা অন্যান্য ফলের আবাদের পাশাপাশি সবুজ মাল্টা চাষেও বেশ উদ্দীপ্ত হয়েছে। এ উপজেলা মাল্টার জন্য খুবই উজ্জল সম্ভাবনাময়ী, উপজেলার কৃষি কর্মকর্তার পরামর্শে ও উপসহকারি কৃষি কর্মকর্তাদের নিবিড় ত্বত্ত্বাবধানে উপজেলার কৃষকরা বেশী লাভের আশায় সবুজ মাল্টা চাষে ঝুকছে, আমাদের দেশে বর্তমানে অনেক জনপ্রিয় ফল মাল্টা. দামে সস্তা, পরিবারের শিশুরাও এটি খেতে বেশ পছন্দ করে, এতে রয়েছে প্রচুর ভিটামিন সি, তাই এর আবাদ ও বাড়ছে। সরেজমিনে সবুজ মাল্টা বাগান ঘুরে ও চাষীদের সাথে কথা বলে জানাযায়, ২০১৫ সালের নভেম্বর মাস থেকে এ উপজেলায় বাণিজ্যিক ভাবে মাল্টা চাষ শুরু হয় ভূমি :- পাহাড়ি উচু ভূমি ও লাল মাটি মাল্টা চাষের জন্য খুবই উপযোগী, গাছের গোড়ায় পানি জমে থাকলে গাছ মরে যায়, তাই মাল্টা চাষের জন্য উচু ভূমি একান্ত প্রয়োজন। প্রজাতি :- মাল্টা সাইট্রাস প্রজাতির, মাল্টার বিভিন্ন জাত রয়েছে তন্মধ্যে অধিকাংশই বারি মাল্টা-১ বা পয়সা মাল্টার আবাদ হচ্ছে, ফলের নীচের দিক পয়সা আকৃতির তাই একে পয়সা মাল্টাও বলা হয়ে থাকে, এটি অত্যন্ত সুস্বাদু ও সুমিষ্ট, তাই জাম্বুরা গাছের সাথে এর কলম করা হয়, এবং কলম করা চারা রোপনের ২ বছর পর থেকে মাল্টা ধরতে শুরু করে, একাধারে ৮/১০ বছর পর্যন্ত ফল দিয়ে থাকে,এর পর ধীরে ধীরে ফল আকারে ছোট ও ফলন কমতে শুরু করে।
স্থান:- উপজেলার ভারতীয় সীমান্তবর্তী বিষ্ণুপুর, পাহাড়পুর, সিঙ্গারবিল এ ৩ টি ইউনিয়নে মাল্টার আবাদ বেশী হয়, অন্যান্য ইউনিয়নে ও কম বেশী চাষ হয়ে থাকে, আবাদ:- এ বছর উপজেলায় মোট প্রায় ৬৫ হেক্টর ভূমিতে মাল্টার আবাদ হয়েছে, বিষ্ণুপুর ইউপিতে ১৫ হেক্টর, পাহাড়পুর ইউপিতে ৩০ হেক্টর, সিঙ্গারবিল ইউপিতে ১৫ হেক্টর, আন্যান্য ইউপিতে ৫ হেক্টও ভূমিতে এর আবাদ হয়েছে। ফুল ও ফল :- বছরের ফেব্রুয়ারীতে গাছে ফুল আসতে শুরু করে এবং ফল হয়ে নভেম্বরে তা শেষ হয়। একটি গাছ পরিপক্ক হতে ৪/৫ বছর সময় প্রয়োজন, পরিপক্ক প্রতিটি গাছে ২২০/২৩০ টি পযর্ন্ত ফল দিয়ে থাকে, ৫ টি মাল্টায় প্রায় ১ কেজি ওজন হয়ে থাকে, সে হিসেবে একটি পরিপক্ক গাছ হতে প্রায় ১ মণ মাল্টা হার্বেষ্ট করা সম্ভব, হার্বেষ্ট:- মাল্টা হার্বেষ্টের উত্তম সময় সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবরের মাঝা মাঝি পর্যন্ত, উপযুক্ত সময়ে মাল্টা হার্বেষ্ট হলে এর স্বাদ ও মিষ্টতার পরিমাণ ঠিক থাকে। আয় :- ধারণা করা হচ্ছে এবছর আবহাওয়া অনুকুলে থাকলে ১৩শ মে.টন মাল্টা উৎপাদন হবে, ১০০/১২০ টাকা কেজি বাজার দরে এর আনুমানিক বাজার মূল্য প্রায় ১০ কোটি টাকা। রোগ বালাই :- মাল্টা চাষে তেমন কোন রোগ বালাই নেই তবে একটি রোগই মারাত্মক এর নাম ’ গ্রিনিং রোগ ’ এ রোগের লক্ষণ, গাছের পাতা হলুদ হওয়া, এক গাছে এ রোগ দেখা দিলে কিছু দিনের মধ্যে সমস্ত বাগানে তা ছরিয়ে যায়, এ রোগের এখনো কোন ঔষধ আবিস্কৃত হয়নি, তাই এ রোগ যে গাছে পরিলক্ষিত হবে ঐ গাছ গোড়া থেকে কেটে ফেলাই ভাল। ভ্রমণ :- ভ্রমণ পিপাসুরা দৃষ্টিনন্দন ছায়াঘেরা আকাবাকা পথে পাহাড়ে গাঢ় সবুজ মাল্টা বাগান দেখতে ভির করছে, মাল্টা বাগানে মাল্টার ভারে গাছ নুয়ে পড়ছে, এ দেখতে আশেপাশের এলাকার লোকজন স্বপরিবারে ঘুরতে আসছে, নিজ হাতে গাছ হতে তরতাজা রসালো বিষ মুক্ত মাল্টা খাওয়ার মজাই আলাদা, বাড়ি ফেরার সময় ব্যাগ ভর্তি মাল্টা কিনে নিয়ে যাচ্ছেন তাহারা, শখের বশে অনেকে এখানকার বাজার থেকে মাল্টার চারা বাড়িতে রোপনের জন্য কিনে নিচ্ছেন, খাডিঙ্গা গ্রামের আনোয়ার হোসেন,ও সেজামুরা গ্রামের আলি আকবর সফল এ মাল্টা চাষী বলেন, সঠিকভাবে বাগান পরিচর্যা করায় চলতি মৌসুমে প্রতিটি সবুজ মাল্টা গাছ ফলে ফলে ভরে উঠেছে, ফল বিক্রিতে ও ঝামেলা নেই, ব্যবসায়ীরা সরাসরি বাগান থেকে ছোট বড় যানে ফল কিনে নিয়ে যায়। লাভজনক হওয়ায় ভবিষ্যতে বাগান আরো বড় করার পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানান তিনি, তিনি আরো জানান, আমাদেরকে দেখে এলাকার অনেকে সবুজ মাল্টা চাষে আগ্রহ প্রকাশ করছে। বিষ্ণুপুরের চাষী আনোয়ার হোসেন তিনি বলেন, আগে এসব জায়গায় দেশীয় জাতের আম গাছ ছিল, এতে আম আসতো তাতে পরিবারের লোকজনের চাহিদা মিটিয়ে সামান্য পরিমাণ আম বাজারে বিক্রি করা হতো। কৃষি অফিসারের পরামর্শে আমি সবুজ মাল্টা চাষ করে খুবই লাভবান, খরচ যা হতো তার থেকে অনেক বেশী আয়। উপসহকারি কৃষি কর্মকর্তার অক্লান্ত পরিশ্রম সে যেমন বলেছে তেমনই ফলন পেয়েছি, তার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। উদ্বুদ্ধ :- মাল্টা চাষীর আর্থিক এমন উন্নতি দেখে অন্যান্য কৃষকরা মাল্টা আবাদে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে, আর এ আগ্রহকে কাজে লাগাতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর আরো নুতন নুতন বাগান তৈরীতে কাজ করে যাচ্ছে, তাজা, বিষমুক্ত, সুমিষ্ট সবুজ মাল্টার কদর দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিদেশী হলুদ মাল্টার সাথে পাল্লা দিয়ে এর চাহিদা বাড়ছে, ক্রেতা-দোকানির কাছে আমদানি করা হলুদ রঙের চেয়ে সবুজ মাল্টার কদর কোন অংশেই কম নয়, এর ফলে মাল্টার জন্য আর বিদেশ নির্ভর হতে হবেনা। উপকারীতা :- ভিটামিন সি সমৃদ্ধ এই ফলের চাহিদাও ব্যাপক। মাল্টাতে আছে, ভিটামিন বি, ভিটামিন সি, ক্যালসিয়াম, পটাসিয়াম, ফসফরাস, এবং চর্বিমুক্ত ক্যালরি, এগুলো ছাড়াও মাল্টাতে আর অনেক পুষ্টিগুণ রয়েছে। মাল্টা ফলটি জাম্বুরা এবং কমলা এই দুই ফলের শংকরায়নের মাধ্যমে উদ্ভাবন করা হয়েছে। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা: মো: মাসুম জানান, মাল্টা ভিটামিন ‘সি’ সমৃদ্ধ ফল, মাল্টার এক গ্লাস জুসকে ভিটামিন সি এর সবচেয়ে কার্যকর উৎস বলে মনে করা হয়, বাচ্ছাদের স্কর্ভি রোগ, দাঁত, চুল, ত্বক, নখের পুষ্টি জোগায়, এটি এন্টি অক্সিডেন্টের উৎস, এটি ত্বকে সজীবতা বজায় রাখে এবং ত্বকের বলি রেখা প্রতিরোধ করে, ইনফেকশন প্রতিরোধে সহায়তা করে, প্রদাহ জনিত রোগ সারিয়ে তোলে,পাকস্থলীর আলসার ও কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে সুরক্ষা করে, শুধু তাই নয় শীতকালীন ঠোঁট ফাটা, পায়ের তালু ও হাতের তালু ফাটা রোগ রোধ কওে, মাল্টা সর্দি, জ¦র জ্বর ভাব, টনসিলের সমস্যা, গলাব্যথা, হাঁচি-কাশি, মাথাব্যথা, গর্ভবতী মায়ের ডেলিভারির পূর্বে ও পরে এর খুব প্রয়োজন, শুধু তাই নয় এটি আমাদের শরীরের কোলন ক্যান্সার ও ব্রেস্ট ক্যান্সারের অন্যতম প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে। উপসহকারি কৃষি কর্মকর্তা আশরাফুল আলম বলেন, মাল্টা চাষে কৃষককে উদ্বুদ্ধ করার লক্ষে কৃষকের বাড়ি বাড়ি গিয়েছেন, বুঝিয়েছেন, কৃষি কর্মকর্তার পরামর্শে সেমিনারের আয়োজন করেছেন, সরকারি খরচে প্রশিক্ষণের পাশাপাশি, বাগানের চারা, সার. কীটনাশক, ও সময়ে সময়ে পরামর্শ দিয়েছেন, তিনি বিদেশী ফলের উপর নির্ভর না করে ফরমালিন মুক্ত সুমিষ্ট রসালো দেশী সবুজ মাল্টা খাওয়ার আহ্বান জানান, উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাব্বির হোসেন জানান, এই অঞ্চলের মাটি ও আবহাওয়া মাল্টা চাষে খুবই উপযোগী, আবহাওয়ায় অনুকুলে থাকায় বেশী ফলনের পাশাপাশি উৎপাদিত মাল্টা খেতেও সুস্বাদু, এতে দামও ভালো পাচ্ছেন চাষীরা, সেই সঙ্গে দিন দিন বাড়ছে মাল্টা চাষীর সংখ্যা, আমরা কৃষি বিভাগ বিভিন্ন সহায়তা দিয়ে চাষীদের পাশে রয়েছি, আশা করি অদুর ভবিষ্যতে এই উপজেলায় মাল্টা চাষে বিপ্লব ঘটবে।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com