আসামের নির্যাতিতদের আর্তনাদ
আসামে দরং জেলার প্রত্যন্ত ধলপুর গ্রামটার ছবি প্রথম দেখেছিলাম সাত থেকে আট দিন আগে গণমাধ্যম আর সোশ্যাল মিডিয়ায়। ওই গ্রামের যুবক মইনুল হকের ওপরে বর্বরতার ছবি আর তার মৃত্যুর ভিডিওটিও দেখেছিলাম তখনই। আসাম সরকার দফায় দফায় উচ্ছেদ অভিযান চালিয়েছে গত কয়েকমাসে। প্রথম দিকে বলা হচ্ছিল, একটি প্রাচীন শিবমন্দিরকে অনেক বড় আকারে গড়ে তোলার লক্ষ্যে মন্দির সংলগ্ন জমি থেকে উচ্ছেদ অভিযান চালানো হচ্ছে। এ ধরনেরই একটি উচ্ছেদ অভিযানের সময়ে ২৩ সেপ্টেম্বর আশ্রয়চ্যুতদের বিক্ষোভে পুলিশ গুলি চালায়। স্থানীয় সাংবাদিকরা পুলিশের গুলিতে অন্তত দুজনের মৃত্যু ও আরো বেশ কয়েকজনের আহত হওয়ার খবর জানান। পরে জানা যায়, সেখানে আসাম সরকার একটি কৃষি খামার গড়ে তোলার জন্য তাদের ভাষায়, জমি দখলমুক্ত করতে তারা অভিযান চালিয়েছে। উচ্ছেদের ফলে ভিটে মাটি হারিয়েছেন স্থানীয় বহু বাসিন্দা।
সেখানে মানুষ কিভাবে দিন কাটাচ্ছেন তা দেখতে দিন কয়েক আগে নৌকায় চেপে দু’দুটো ছোট খাল পেরিয়ে হাজির হয়েছিলাম ধলপুরে। প্রথমেই চোখে পড়ল ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা তিনকোণা ঢেউ টিনের সারি। কাছে এগিয়ে যেতেই বুঝলাম যে এগুলো আসলে কোনো বাড়ির টিনের ছাদ ছিল। যখন উচ্ছেদ অভিযান চলেছে এই গ্রামগুলোতে, যখন ভাঙা পড়েছে বসতবাড়ি, এই ঢেউ টিনের ছাদগুলোকেই মানুষ সরিয়ে নিয়ে এসেছেন। তার তলাতেই কোনোমতে মাথা গুঁজে থাকা। কয়েকটা থালা বাসন, একপাশে জড়ো করে রাখা কয়েকটা বালতি, বিছানা-তোষক। টিনের চালগুলোর বাইরে পড়ে আছে ভাঙা, পোড়া আলমারি ও টিনের ট্রাঙ্ক। ধলপুরের মানুষের সংসার বলতে আপাতত এইটুকুই। সব কিছুই রাখা রয়েছে ভেজা মাটিতে। আগের রাতে মুষলধারে ঝড় বৃষ্টি হয়েছে। গ্রামের বাসিন্দা জ্যোৎস্না বানু বলছিলেন, ‘কাল রাতে খুব ভয় লাগছিল। খুব ঝড় বৃষ্টি হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল টিনের চালটা বোধহয় উড়েই যাবে। বাইরেও বের হওয়ার উপায় নেই। পানির মধ্যেই মা-বাবা ও বোনেদের সাথে দাঁড়িয়ে ছিলাম সারারাত।
জ্যোৎস্নারা যেখানে আশ্রয় নিয়েছে, তার আশপাশে আরো অনেকগুলো টিনের চালের আস্তানা। একটার ভেতরে দেখলাম খাট পেতে মশারি টাঙিয়ে এক সদ্যজাত শিশুকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে।
চারিদিকে উচ্ছেদের ধ্বংসলীলা: তাদের ওই টিনের চালের নিচে জ্যোৎস্নার মা আনোয়ারা বেগম একটা অ্যালমুনিয়ামের কানা উঁচু থালা থেকে কয়েক মুঠো ভাত চারটে থালায় বেড়ে দিচ্ছিলেন।
আনোয়ারা বলেন, দেখেন- এই কয় মুঠ ভাত। শুধুই শুকনা ভাত। লবণ, তেল কিছুই নেই। সরকার তো খ্যাদায় দিল, কিন্তু কোনো সাহায্য আর করল না। ওনাকে আর বললাম না যে খাল পেরনোর সময়ে দেখেছি বেশ কয়েক বস্তা চাল আলু, লবণের প্যাকেট এসব আসছে তাদের গ্রামে। কোনো স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ত্রাণ পাঠাচ্ছে। গ্রামে একটা মেডিক্যাল বসেছে। কয়েকজন তরুণ ডাক্তার নারী-পুরুষ-শিশুদের কিছু ওষুধ দিচ্ছিলেন। যেদিকেই চোখ যায়, সেদিকেই শুধু ভাঙা টিন, আলমারি, বাক্স আর বাঁশ পড়ে আছে। যেন একটা ধ্বংসস্তূপ। এর মধ্যেই আবার অনেকে গর্ত করে বাঁশ পুঁতছেন, টিনের চালা বানাচ্ছেন। তার পাশেই একটা বড় সড় জটলা। নানা বয়সের পুরুষ মানুষদের ভিড়। একজনকে কাছে পেয়ে জানতে চেয়েছিলাম, কী এমন হয়েছিল যে পুলিশ একেবারে গুলি চালিয়ে দুজনকে মেরে দিল?
তার কথায়, ‘প্রথম দুদিন তো কোনো সমস্যা হয়নি। সরকার বলেছিল, আমাদের থাকার জায়গা দেবে, আমরা নিজেরাই সরে এসেছিলাম। সেদিন একটা ধর্নায় বসেছিলাম আমরা। বাইরের কেউ ছিল না কিন্তু। সেখানে ছিলেন জেলার এসপিও। ধলপুরের ওই বাসিন্দা বলেন, ‘শান্তি মতোই আলোচনা হলো। তিনি বললেন, তোমরা ঘরে চলে যাও। কজনকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিও, আমি কথা বলে নেব। সেই মতো সবাই চলেও গিয়েছিলাম। হঠাৎ পূব দিক থেকে গুলির আওয়াজ পাই। সেই দিকে যেয়ে দেখি এক গর্ভবতী নারীর হাতে গুলি লেগেছে। সেই শুরু।
মন্দিরের জমি দখল নিয়ে বিতর্ক: শুধু যে গুলি চলার দিন সকালে আলোচনা হয়েছিল সরকার আর গ্রামবাসীদের মধ্যে, তা নয়। বেশ কয়েক মাস ধরেই আলোচনা হচ্ছিল এই উচ্ছেদ আর তার পরের পুনর্বাসন নিয়ে। সরকারের দাবি, এই জমি তাদের। গ্রামবাসীরা দখলকারী। তাই তাদের সরে যেতে হবে। আজিরুন্নেসা নামের এক নারী বলছিলেন, ‘কেন এটা সরকারি জমি হবে? আমাদের পূর্বপুরুষরা উচিত দাম দিয়ে এই জমি কিনেছিল। সেই দলিলও আমাদের কাছে আছে। তাকে বলেছিলাম, ‘সরকার যে বলছে এক প্রাচীন শিবমন্দিরের জমিও আপনারা দখল করে রেখেছিলেন?’
আজিরুন্নেসা জবাব দিলেন, ‘ওই শিবমন্দির থেকে আমাদের গ্রাম পাঁচ থেকে ছয় কিলোমিটার দূরে। আমরা ওদিকে যাইও না। আর যদি মন্দিরের জমি খালি করতে হতো, তাহলে আমাদের ঘর ভাঙল কেন সরকার?’ গ্রামে ঘুরে এও জানতে পারলাম যে ওই মন্দিরের জমি দখল নিয়ে যে বিতর্ক ছিল, তা মিটে গেছে অন্তত চার মাস আগে। গ্রামবাসীরা জানালেন, মন্দিরটির জমি যে ১০ থেকে ১২টি পরিবার বেআইনিভাবে দখল করেছিল, তারা সরে গেছে মন্দির এলাকার বাইরে আর এখন মন্দিরের জমি পাঁচিল দিয়ে ঘিরে দেয়া হয়েছে। বোঝাই গেল যে মন্দিরের জমি বেআইনি দখলমুক্ত করার সাথে ধলপুরের উচ্ছেদের কোনো সম্পর্কই নেই।
গ্রামের মানুষ আরো বললেন, শুধু যে জমির মালিকানার দলিল তাদের কাছে আছে, তাই নয়। তারা নিয়মিত খাজনাও দিয়ে এসেছেন ২০১৫ সাল পর্যন্ত। তারপরেই এটা সরকারি জমি না ব্যক্তিগত, তা নিয়ে বিতর্ক বাঁধায় আর খাজনা দেন না তারা। তবুও গ্রামবাসীরা সরে যেতে রাজি ছিলেন পুনর্বাসন পেলে।
‘উচ্ছেদ শুধু মুসলামান এলাকায়’ গুয়াহাটির কলামিস্ট বৈকুণ্ঠ গোস্বামী বলছিলেন, ‘ওখানে একটা বড় কৃষি ফার্ম করবে সরকার। ভালো কথা। কিন্তু এতগুলো মানুষকে উচ্ছেদ করছে, এই মানুষগুলো যে কোথায় যাবে, তার কোনো পরিকল্পনা নেই সরকারের। আর এই বিষয়টাও ভাবার মতো, শুধু কিন্তু মুসলমান এলাকাগুলোতেই উচ্ছেদ করা হচ্ছে। কিন্তু সেই উচ্ছেদ অভিযানে ঠিক কেন গুলি চলল, কেন দুজন গ্রামবাসী নিহত হলেন, তা স্পষ্ট নয়।’ সরকার বলছে, তারা বিচারবিভাগীয় তদন্ত শুরু করেছে।
আবার একই সাথে ক্ষমতাসীন দল এটাও বলছে, ‘১০ হাজারের মতো লোক জড়ো করে দাসহ দেশীয় অস্ত্র নিয়ে পুলিশকে আক্রমণ করলে কি তারা চুপ করে থাকবে?’ ধলপুর থেকে ফিরে এসে গুয়াহাটিতে যখন দেখা করলাম বিজেপির সিনিয়র নেতা প্রমোদ স্বামীর সাথে, তিনি বললেন ওই কথাগুলো।
জানতে চেয়েছিলাম তার কাছে, ‘দশ হাজার মানুষের জড়ো হওয়ার, অস্ত্র নিয়ে পুলিশের ওপর হামলা করার কোনো প্রমাণ কি আছে?’ তিনি বলেন, ‘সরকারের কাছে নিশ্চয়ই প্রমাণ আছে। তদন্ত হলেই সত্যটা বেরিয়ে আসবে।’ তাকে আমি প্রশ্ন করেছিলাম, ‘কিন্তু সেদিন শুধুমাত্র লাঠি হাতে পুলিশের দিকে ধেয়ে আসা এক ব্যক্তিকে গুলি করে মারা হচ্ছে, তার বুকে গুলির চিহ্ন দেখা যাচ্ছে, সেই ভিডিও তো সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে। অন্তত ২৫ জন পুলিশ ছিলেন সেখানে। ওই ব্যক্তিকে গুলি করতে হল কেন? আটক করা যেত না? আবার সরাসরি বুকে গুলি? এটার কী যুক্তি দেবেন?’ এর জবাবে প্রমোদ স্বামী বারবার ফিরে যাচ্ছিলেন সেই ‘দশ হাজার মানুষের অস্ত্র নিয়ে পুলিশের ওপর হামলা’র তত্ত্বে।
যে ভিডিওটি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে, সেই ঘটনা খুব কাছ থেকে দেখেছেন ধলপুরের বাসিন্দা সামাদ আলি। তিনি বলেন, ‘ওই যে মারা গেছে, মইনুল। ওর হাতে একটা লাঠি ছিল। পুলিশ ওর সামনেই ওর এক ভাতিজাকে মারছিল। যেকোনো মানুষেরই মাথা গরম হবে এতে। সে ওই কজন পুলিশকে ধাওয়া করেছিল লাঠি নিয়ে। আমরা চেষ্টা করেছিলাম ওকে আটকাতে। কিন্তু পুলিশ যদি গুলি করে দেয়, সেই ভয়ে আর এগোইনি। তারপরেই তো পুলিশ ওকে ঘিরে নিলো। আর চুল দাড়িওয়ালা একজন মানুষ ওর ওপরে ঝাঁপিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছিল, লাথি মারছিল। শেষে তো ওকে বুকে গুলি করল।’ স্বামীর বুকে আর পায়ে সেই গুলির চিহ্ন সেদিন রাতে দেখতে পেয়েছিলেন মইনুল হকের স্ত্রী মমতাজ বেগম।
ধলপুরের উচ্ছেদ হওয়া মানুষরা সুতা নদীর অন্যপাড়ে যেখানে আশ্রয় নিয়েছেন, সেখানে তাদের ভিটে বাড়ির টিনের চালের নিচে, তারই একেবারে শেষ প্রান্তে গিয়েছিলাম মইনুল হকের পরিবারের সাথে দেখা করতে। ভেতর থেকে একটানা বিলাপ করে কান্নার শব্দ আসছিল। ছেলে হারানো মা আর স্বামী হারা মমতাজ বেগমকে সান্ত¡না দিচ্ছিলেন আত্মীয় পরিজন ও প্রতিবেশীরা। মইনুলের মা বিশেষ কথাই বলতে পারলেন না। একটু ধাতস্থ হয়ে মমতাজ বেগম বললেন, ‘সেদিন বেলা ১১টার দিকে শেষবার দেখেছিলাম স্বামীকে। তারপর তো রাতে আবার দেখলাম।’ এইটুকু বলেই আবার ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন তিনি। কিছুক্ষণ পর বললেন, ‘ওর বুকে গুলি লেগেছিল, আর পায়ে। ওর ওপরে যেভাবে একটা লোক ঝাঁপিয়েছে, লাথি মেরেছে, ওর শরীরটা নীল হয়ে গিয়েছিল।’ আবারো কেঁদে ফেললেন তিনি।
বিশালাকার কৃষি খামার প্রকল্প বেলা গড়িয়ে আসছিল, এবার আমার ফেরার পালা। সুতা নদীর ধার দিয়ে যখন ফিরছি, তখন প্রায় বেলা চারটা। তখন সবে খোলা আকাশের নিচে গর্ত খুঁড়ে বানানো চুলায় হাঁড়ি চড়ছে। ভাত ফুটতে শুরু করেছে। তবে রোশনারা খাতুনের চাল শেষ। ভাত রান্নার উপায় নেই।
ধরা গলায় বলছিলেন, ‘দিন হাজিরা করে খাই। চাল নেই ঘরে। বাচ্চাগুলো না খেয়ে থাকছে। আবার তো শুনছি এখান থেকেও নাকি উচ্ছেদ করবে।’ খেয়াঘাটের দিকে আরো কিছুটা চলে আসার পরে নদীর অন্য পাড়ে, যেখানে এই মানুষদের বাস ছিল, সেখান থেকে ট্রাক্টরের আওয়াজ পেলাম। নদীর তীরে শরৎকালের পরিচিত চিহ্ন কাশফুল ফুটে আছে অনেকগুলো। এক নারী তাকিয়ে ছিলেন যেদিক থেকে ট্রাক্টরের আওয়াজ আসছে, সেইদিকে। তাদের ফেলে আসা ভিটা মাটি এখন ট্র্যাক্টর দিয়ে চষে ফেলা হচ্ছে – সেখানে গড়ে উঠবে গরুখুঁটি প্রকল্প। এক বিশালাকার কৃষি খামার হবে এই গরুখুঁটিতে।
কৃষি কাজ শেখার জন্য স্থানীয় আধিবাসীদের নিয়োগও করা হয়েছে। আসাম সরকারের উদ্দেশ্যে গুয়াহাটির প্রবীণ আইনজীবী ও আসাম সিভিল সোসাইটির কার্যকরী সভাপতি হাফিজ রশিদ চৌধুরি বলেন, ‘ওখানে থাকতো মুসলমানরা। তাদের উচ্ছেদ করে দিলো। সেখানে যদি কোনো উন্নয়নমূলক প্রকল্প নিতো, আপত্তি ছিল না। কিন্তু মুসলমানদের উচ্ছেদ করে যদি আধিবাসীদের সেখানে বসাও, তাহলেই বুঝতে হবে তোমার উদ্দেশ্যটা ভালো না।’ গরুখুঁটি প্রকল্পটিকে বলা হচ্ছে পাইলট প্রজেক্ট।
বিজেপি নেতা প্রমোদ স্বামী বলেন, ‘এই প্রকল্প যদি সফল হয়, তাহলে আরো নানা জায়গায় এ ধরনের কৃষি খামার গড়ার পরিকল্পনা নিশ্চয়ই করবে সরকার।’ প্রথম যে ছাত্রীটির সাথে কথা হয়েছিল, ফেরার সময় দেখা হলো তার বাবা মজিদ আলির সাথে। আমাকে দেখানোর জন্য তিনি নিয়ে এসেছিলেন এনআরসিতে যে তার নাম আছে, সেই কম্পিউটার প্রিন্ট আউট। তিনি বলেন, ‘দেখুন তালিকায় প্রথম নামটাই আমার। আমি বা আমরা এখানকার বাসিন্দা। কেউ বাংলাদেশী নই, কেউই বহিরাগত নই। তবুও সেসবই বলা হচ্ছে আমাদের নামে। আসলে আমাদের দোষ একটাই, এটা আমরা খুব ভালো করে বুঝে গেছি। আমরা মুসলমান। আমাদের দোষ এটাই।’ সূত্র : বিবিসি