রবিবার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:৪০ অপরাহ্ন

বাংলাদেশ নিয়ে চীন এবং ভারতের ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব বসে নেই যুক্তরাষ্ট্রও

বিশেষ প্রতিনিধি:
  • আপডেট সময় সোমবার, ২৫ অক্টোবর, ২০২১
ছবি: আমেরিকা থেকে প্রকাশিত ঠিকানার সৌজন্যে

এশিয়ার সবচেয়ে বড় দুই শক্তি চীন এবং ভারত সা¤প্রতিক সময়ে যেভাবে বাংলাদেশে প্রভাব বিস্তারে ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছে, বাংলাদেশের গত ৪৭ বছরের ইতিহাসে তার নজির সম্ভবত নেই। এই দ্বন্দ্ব সা¤প্রতিক বছরগুলোতে এত তীব্র রূপ নিয়েছে যে দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতির গতি-প্রকৃতি নিয়ে যারা গবেষণা করেন, এ বিষয়ে তাদের মধ্যেও ক্রমবর্ধমান আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। কেবল এ সপ্তাহেই যুক্তরাষ্ট্র এবং অস্ট্রেলিয়া ভিত্তিক দুটি প্রতিষ্ঠান এ এনিয়ে দুটি লেখা প্রকাশ করেছে। অস্ট্রেলিয়ার একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘ইস্ট এশিয়া ফোরামে’র প্রকাশিত নিবন্ধটির শিরোণাম, “চায়না এন্ড ইন্ডিয়া’স জিওপলিটিক্যাল টাগ অব ওয়ার ফর বাংলাদেশ”। অর্থাৎ বাংলাদেশ নিয়ে চীন এবং ভারতের ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব যুদ্ধ। দক্ষিণ এশিয়ার চার দেশঃ বাংলাদেশ, নেপাল, মালদ্বীপ এবং শ্রীলঙ্কা চীন-ভারত প্রতিযোগিতার দ্বন্দ্বে ক্রমবর্ধমানভাবে জড়িয়ে পড়ছে। এই চার দেশকে যুক্তরাষ্ট্র চীন থেকে দূরে সরিয়ে নিতে চাইতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের থিংক ট্যাংক উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক বিশেষজ্ঞ মাইকেল কুগেলম্যান এক টুইটবার্তায় এমন মন্তব্য করেছেন। সম্প্রতি এক টুইটে কুগেলম্যান লিখেনঃ “বাংলাদেশ, নেপাল, মালদ্বীপ এবং শ্রীলঙ্কা চীন-ভারত প্রতিযোগিতার দ্বন্দ্বে ক্রমবর্ধমানভাবে জড়িয়ে পড়ছে। এই দেশগুলোকে যুক্তরাষ্ট্র চীন থেকে দূরে সরিয়ে নিতে চাইতে পারে। পাকিস্তানের বিষয়টি ভিন্ন। দেশটি ঘনিষ্ঠভাবে চীনের সাথে জোটবদ্ধ। যুক্তরাষ্ট্র ব্যাপারটা না চাইলেও স্বীকার করে / গ্রহণ করে।”
একদিকে,বাংলাদেশ, মিয়ানমার, পাকিস্তান, শ্রীলংকাসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর উন্নয়ন সহযোগিতার বড় অংশ আসে বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি হিসেবে বিবেচিত চীন থেকে। আফগানিস্তানকেও বড় সহযোগিতার প্রস্তাব দিয়ে রেখেছে দেশটি। বিশেষ করে অবকাঠামো উন্নয়নে দেশটির আগ্রাসী নীতি পেছনে ফেলে দিচ্ছে অন্যদের। এতে কপালে চিন্তার ভাঁজ দেখা যাচ্ছে চীনের প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর রাষ্ট্রপ্রধানসহ সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদের, যা প্রভাব ফেলছে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রেও। চীনকে ঠেকানোর চেষ্টায় যেমন মরিয়া যুক্তরাষ্ট্র, তেমনি আঞ্চলিক কর্তৃত্ব নিয়ে শঙ্কায় রয়েছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ ভারতও। গত শনিবার ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় গুয়াহাটিতে আসাম পুলিশ আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে ভারতের চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ জেনারেল বিপিন রাওয়াত বলেন, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারে চীনের উপস্থিতি ভারতের স্বার্থের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। প্রতিবেশী এ দুটি দেশকে সবচেয়ে বেশি সামরিক সহায়তা দেয় চীন। দেশটি পা রাখার কৌশলগত জায়গা পেতে শ্রীলংকা, নেপাল ও মালদ্বীপেও বিনিয়োগ করছে। ভারতীয় সংবাদ সংস্থা প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়ার (পিটিআই) প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, গুয়াহাটির অনুষ্ঠানে বিপিন রাওয়াত বলেন, ইদানীং ভূ-কৌশলগত প্রতিযোগিতা ও এ এলাকায় চীনের যথাযথ নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য ব্যাপক বিনিয়োগ দেখতে পাচ্ছি। চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ বিপিন রাওয়াত চীনকে লক্ষ করে বলেন, কৌশলগত অস্থিতিশীলতার সর্বব্যাপী বিপদ রয়েছে, যা ভারতের আঞ্চলিক অখ-তা ও কৌশলগত গুরুত্বের ক্ষেত্রে হুমকি তৈরি করবে।
পিটিআইয়ের খবরে বলা হয়, চীনের প্রভাব কমাতে ভারতকে অবশ্যই প্রতিবেশীদের সঙ্গে আরো সম্পর্ক বাড়াতে হবে বলে মনে করেন জেনারেল বিপিন রাওয়াত। সাবেক এ সেনাপ্রধান পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ছায়াযুদ্ধেরও অভিযোগ আনেন। তিনি বলেন, জম্মু ও কাশ্মীরে যখন শান্তি ও স্থিতিশীলতা বিরাজ করছে, তখন পশ্চিমা শত্রু পাকিস্তান ভয়ের পরিস্থিতি তৈরি করছে কিছু স¤প্রদায়ের মানুষ খুন করে। এ মাসে জম্মু ও কাশ্মীরে অভিবাসী শ্রমিকসহ ১২ বেসামরিক ব্যক্তি খুন হয়েছেন। এজন্য কাশ্মীরে গোয়েন্দা তৎপরতা আরো শক্তিশালী করার কথা বলেন বিপিন রাওয়াত।
জেনারেল বিপিন রাওয়াত মনে করেন, আফগানিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতির প্রভাব পড়তে পারে জম্মু ও কাশ্মীরেও। তিনি বলেন, আফগানিস্তানে যা ঘটছে, তার প্রভাব জম্মু ও কাশ্মীরেও পড়তে পারে, এজন্য আমাদের যথাযথ প্রস্তুতি রাখতে হবে। এক্ষেত্রে কড়া নজরদারি ও সীমান্তগুলো সিল করা খুব গুরুত্বপূর্ণ। জম্মু ও কাশ্মীর প্রসঙ্গে চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ বিপিন রাওয়াতের বক্তব্যের সমালোচনা করেছেন প্রদেশটির সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতি। ভারত ও চীনের মধ্যকার বিরাজমান উত্তেজনার পরিস্থিতির বিষয়ে বিপিন রাওয়াত বলেন, ভারত ও চীনের মধ্যে সন্দেহ ছিল। উত্তেজনা নিরসনে সময় লাগবে। সশস্ত্র বাহিনী এবং বাহিনীর ব্যবস্থাপনার ওপর জনগণের বিশ্বাস ও আস্থা রাখতে হবে। গত বছরের জুনে লাদাখের পূর্বাঞ্চলের গালওয়ান উপত্যকায় চীন ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর সদস্যদের সংঘর্ষের পর থেকে দুই দেশের মাঝে উত্তেজনা চলছে। লাদাখের ওই সংঘাতে ভারতের ২০ সৈন্য নিহত হয়। চীন বলছে, গালওয়ানের সেই সংঘাতে তাদের চারজন সৈন্যের প্রাণহানি ঘটেছে।
চীন-ভারত দ্বন্দ্বে কী হবে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা? এ প্রসঙ্গে আমেরিকা থেকে প্রকাশিত ঠিকানা লিখেছে, মার্কিন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও জানিয়েছেন, চীনকে নিয়ে উদ্বিগ্ন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী তার সেনাদের অবস্থান পুনরায় পরিবর্তন করতে চলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগের কারণ হিসেবে পম্পেও ভারত, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইনের ওপর ক্রমবর্ধমান চীনা হুমকির কথা জানান। ২৫ জুন বৃহস্পতিবার ব্রাসেলসে একটি সম্মেলনে প্রথমবারের মতো চীন-ভারত সীমান্ত সংঘর্ষ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান প্রকাশ্যে আনেন পম্পেও। এতে তিনি লাদাখে ভারতীয় সেনা হত্যার কথা উল্লেখ করে বলেন, চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি তার প্রতিবেশী দেশকে যুদ্ধের উসকানি দিয়ে যাচ্ছে। একই সঙ্গে দক্ষিণ চীন সাগরেও চীন আগ্রাসন চালাচ্ছে বলে অভিযোগ করেন পম্পেও।
এখন চীনকে থামাতে ভারতের বড় ভরসার জায়গায় পরিণত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। চীনের সঙ্গে যদি ভারতের বড় ধরনের কোনো সংঘর্ষ হয় এবং যুক্তরাষ্ট্র যদি তাতে ভারতের পক্ষে থাকে, তাহলে তা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকেও মোড় নিতে পারে। কারণ, এ অঞ্চলে জাপান ও অস্ট্রেলিয়াও তখন চীনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রকে সমর্থন দেবে। আবার পাকিস্তান ও উত্তর কোরিয়ার সমর্থন পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে চীনেরও। কিন্তু প্রতিবেশী ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইনের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক ভালো নয়। পম্পেও তার বক্তব্যে এসব দেশের কথাও উল্লেখ করেছেন। তাই এসব দেশে মার্কিন সেনা বৃদ্ধি হতে পারে চীনকে ঘিরে ধরতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম পদক্ষেপ। তাইওয়ানের সঙ্গেও ভালো সামরিক সম্পর্ক রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। উত্তেজনার পরিপ্রেক্ষিতে সেখানেও সেনা পাঠাতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। কারণ তাইওয়ানের জন্যও বড় হুমকি হয়ে উঠেছে চীন।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com