কেউ এনেছেন আমরুল, তেলাকচুঁ। কেউ এনেছেন ঘ্যাটকল, কাটানটি, কলমি বা হেলেঞ্চা আবার কেউবা এসেছেন থানকুনি, বউটুনি, ব্রাহ্মি, আতাড়ি-পাতাড়ি, বেত, তিত বেগুন, কাটাকচুঁ, বনকচু, ডুমুর, কলার মোঁচা, বাঁশের কেরুল, পান সহ নানা রকমের শাক ও সবজি। বৃহস্পতিবার বিকেলে সীমান্তবর্তী তিনআলী বাজারে আদিবাসী মহিলাদের হাটে গিয়ে এমনটাই দেখা গেছে।দাহাপাড়া, ভবানীপুর, গোপালপুর গ্রামের আদিবাসী মহিলারা এমন নানা রকমের কুড়িয়ে পাওয়া শাক-সবজি নিয়ে বিক্রি করতে আসেন ওই এলাকার বাজার গুলোতে। পাহাড়ী অঞ্চলের অচাষকৃত উদ্ভিদ-বৈচিত্র্য শনাক্তকরণ, শ্রেণিকরণ, সম্প্রসারণ ও ব্যবহার নিয়ে তাদের কোন ধারণা না থাকলেও দুর্গাপুর শহরের অনেকেই গ্রামের ওই বাজার থেকে শাখ-সব্জি গুলো কিনে নেন একটু বেশি দামে। ওই গ্রামের অর্ধশতাধিক আদিবাসী মহিলারা কুড়িয়ে পাওয়া শতাধিক প্রজাতির শাক-সবজি সংগ্রহ করতে চষে বেড়ান এ পাহাড় থেকে ও পাহাড়। কুড়িয়ে পাওয়া নানা প্রজাতির শাক-সবজি সংগ্রহ করতে আদিবাসীদের পাশাপাশি এখন বাঙ্গালীরাও যোগ দিয়েছেন সমান তালে। উত্তর গোপালপুর গ্রামের আদিবাসী মহিলা নিয়তি ¤্রং বলেন, সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত পাহাড়ে ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন রকমের সব্জি সংগ্রহ করে থাকি। তবে অন্যান্য সব্জির মধ্যে পাহাড়ি কচুর লতির চাহিদা রয়েছে বেশ। আমরা অন্যান্য সব্জির চেয়ে এগুলো একটু বেশি দামে বিক্রি করে থাকি। এনিয়ে উপজেলা কৃষি অফিসার মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, সার ও কীটনাশক দিয়ে চাষ করা শাখ সব্জির চেয়ে অ-চাষকৃত সব্জিতে রয়েছে অনেক পুষ্টিগুন। এগুলোতে রাসায়নিক সার বা কীটনাশক ব্যবহার হয়না বিধায় অন্যান্য সব্জির চেয়ে এর চাহিদা এবং দামও একটু বেশি। এনিয়ে কৃষি বিভাগ থেকে আলাদা একটা প্রকল্প করার পরিকল্পনা রয়েছে আমাদের। এ বিষয়ে সরকারি বরাদ্দ পেলেই তা বাস্তবায়ন করা হবে।
ক্ষুদ্র-নৃ-গোষ্ঠির অচাষকৃত শাকসবজির উৎস
অচাষকৃত শাকসব্জির প্রদর্শনীতে শাকসব্জি ছাড়াও প্রদর্শীত হয়েছে ১৮ জাতের বনজ ঔষধি। একেকটা গাছের একেকটা গুণের কথা জানান ওই এলাকার বাসিন্দা কণিকা দ্রং। এই ১৮ জাতের বনজ ঔষধির সবগুলোর নাম কনিকা দ্রং বলতে না পারলেও এর কার্যকারিতা সম্পর্কে ভালো জানেন বলে জানান। তিনি কোন ঔষধি গাছের কি গুণাবলি আছে তা সবার মাঝে তুলে ধরেন। পাশাপাশি সংরক্ষণের কথাও বলেন। তিনি এও জানান যে, এখন আর আগের মত এই সব ঔষধি গাছগুলো পাহাড়ে সহজে পাওয়া যাচ্ছে না। আগে ঔষধ বানাতে গেলে তেমন খোঁজাখুঁজি করতে হতো না কিন্তু এখন অনেক খুঁজতে হয় বলে তিনি জানান। তাঁর ভাষ্যমতে, কিছু কিছু গাছগাছালি আছে যেগুলো আর খুঁজেও পাওয়া যায় না। হারিয়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে তিনি পাহাড়ে বিভিন্ন দেশি বিদেশী গাছ গাছালির বাগান করাকে দায়ি করেন। শাকসব্জিগুলির নাম ও খাওয়ার পদ্ধতি সম্পর্কে ভালো জানেন জরিনা রিছিল ও কোহিনূর নকরেক। এই দু’জন আদিবাসী নারী একে একে সবগুলো সব্জির নাম, স্বাদ, রান্না পদ্ধতি ও কার্যকারিতা সম্পর্কে নতুন প্রজন্মের মাঝে তুলে ধরেন। এই ৫০টি জাতের শাকসব্জির মধ্যে অধিকাংশই পাহাড়ি শাকসব্জি। যা সমতলে পাওয়া যায় না। অচাষকৃত বা কুড়িয়ে পাওয়া শাকসব্জির এক বিশাল ভান্ডার থাকার জন্যই এখানকার আদিবাসীরা নিজেরা তেমন সব্জি চাষ করেন না এমনটিও শোনা গেছে। এই গ্রামের অনেকেই এই অচাষকৃত সব্জির উপর নির্ভরশীল। অচাষকৃত সব্জির গুণের কথা বলতে গিয়ে জরিনা রিছিল বলেন, “আমরা বাজার থেকে যেসব সব্জি কিনে খায় সেগুলো সার বিষ দিয়ে ফলানো হয়। কিন্ত আমরা যে শাকসব্জিগুলো পাহাড় থেকে কুড়িয়ে খায় সেখানে কেউ কোনদিন কোন প্রকার সার, বিষ দেয়নি। যার কারণে অচাষকৃত সব্জির যেটুকু ভিটামিন থাকার কথা তাই আমরা পাচ্ছি।” অচাষকৃত শাকসব্জির যেমন সুবিধা বা ভালো দিক আছে তেমনি আবার অসুবিধাও আছে। কারণ এগুলো কোন নির্দিষ্ট স্থানে থাকে না। এগুলো সংগ্রহ করতে হয় বিভিন্ন স্থান থেকে। তারপর সব সময় পাহাড়ে যাওয়াও সম্ভব হয়ে ওঠে না। এখন পাহাড়ে বিভিন্ন প্রকার কাঠের ও ফলের বাগান করা হচ্ছে। যার জন্যই এগুলোকে অপ্রয়োজনীয় আগাছা ভেবে কেটে ফেলা হচ্ছে। আবার অনেকে এই অচাষকৃত সবজির গুরুত্ব বা ব্যবহার না জানায় এগুলোর সংরক্ষণে আগ্রহী হয় না। পাহাড়ে এসব অচাষকৃত শাকসব্জির স্বল্পতার কারণে এখন অনেক গারো আদিবাসী সবজির জন্য বাজারের ওপর নির্ভর করতে হয়। আবার অনেকে নিজে শাকসব্জি চাষ করার চেষ্টা করছেন। এছাড়াও এই সব কুড়িয়ে পাওয়া শাকসব্জি ও বনজ ঔষধি সম্পর্কে নতুন প্রজন্মদের কোন ধারণা নেই বিধায় এগুলো সংরক্ষণের প্রয়োজন মনে করছেন না। পাহাড় কেটে বসতভিটা তৈরি, বিভিন্ন ফল ও কাঠের বৃক্ষ রোপণ, সংগ্রহ ও সংরক্ষণে অসচেতন এমন বহুবিধ কারণে এই অচাষকৃত সবজিগুলো কালাপানিসহ অন্যান্য গ্রামেও দিনে দিনে হ্রাস পাচ্ছে। অচাষকৃত শাকসব্জি হলো নিরাপদ খাদ্যভান্ডার অথচ এগুলো ধ্বংস করে দিনদিন মানুষ বাজারনির্ভর হয়ে যাচ্ছে। বাজারের যে সব্জি রাসায়নিকের মাধ্যমে উৎপাদন করা হয় সেগুলোর প্রতি আমরা আকৃষ্ট হচ্ছি। তবে নিরাপদ খাদ্য প্রাপ্তির ক্ষেত্রে আমাদের জৈব পদ্ধতিতে শাকসব্জি উৎপাদন যেমন করতে হবে তেমনিভাবে অচাষকৃত এসব শাকসব্জিগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগ নিতে হবে।