শনিবার, ১৯ অক্টোবর ২০২৪, ১২:৩৮ অপরাহ্ন

বিদায় হজের ভাষণ ও মর্মবাণী

প্রফেসর ড. ওবায়দুল ইসলাম:
  • আপডেট সময় বুধবার, ৩ নভেম্বর, ২০২১

বিদায় হজের ভাষণ দশম হিজরিতে অর্থাৎ ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে হজ পালনকালে আরাফাতের ময়দানে ইসলাম ধর্মের শেষ রাসূল মুহাম্মদ সা: কর্তৃক প্রদত্ত খুতবা বা ভাষণ। হজের দ্বিতীয় দিনে আরাফাতের মাঠে অবস্থানকালে উপস্থিত সমবেত মুসলমানদের উদ্দেশে তিনি এই ভাষণ দিয়েছিলেন। মুহাম্মদ সা: জীবিতকালে এটি শেষ ভাষণ ছিল, তাই সচরাচর এটিকে বিদায় খুতবা বলে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। ইসলামের প্রকৃত মূল্যবোধ অনুযায়ী মুসলমানদের করণীয় সম্পর্কে এই ভাষণে চূড়ান্ত দিকনির্দেশনা ছিল।
ইসলাম ধর্ম যে ধাপে ধাপে ও পর্যায়ক্রমে পূর্ণতা পেয়েছিল, তারই চূড়ান্ত ঘোষণা ছিল মুহাম্মদ সা:-এর এই ভাষণ। এ কারণে সে দিন ভাষণ প্রদানকালে কুরআনের সূরা মায়িদার ৩ নম্বর আয়াত অবতীর্ণ হয়েছিল- ‘আজ আমি তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম এবং আমার নিয়ামত তোমাদের জন্য পরিপূর্ণ করে দিলাম। ইসলামকে তোমাদের জন্য একমাত্র জীবনব্যবস্থা হিসেবে মনোনীত করলাম।
এই ভাষণে ইসলাম ধর্মের মর্মবাণী সংক্ষেপে বর্ণিত হয়েছিল। মুসলিম জাতির সাফল্যের ধারা বজায় রাখতে মুসলমানদের করণীয় সম্পর্কে মুহাম্মদ সা: চূড়ান্ত দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন। এই ঐতিহাসিক ভাষণ কেবল উপাসনামূলক অনুশাসন ছিল না, বরং মানবসমাজের জন্য করণীয় সম্পর্কে সুস্পষ্ট ভাষায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপদেশও এতে ছিল। আল্লাহর প্রতি আনুগত্য, তার সার্বভৌমত্বের সাক্ষ্য, মানবজাতির ঐক্য, আধ্যাত্মিক ভ্রাতৃত্ব, সামাজিক স্বাধীনতা এবং গণতান্ত্রিক সাম্য ইত্যাদি সমাজ বিনির্মাণের অন্যতম সব বিষয়ই ওই ভাষণের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই ভাষণে তাকওয়া বা দায়িত্ব নিষ্ঠতার কথা গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল এবং পাপাচারের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি দেয়া হয়েছিল। আল্লাহর প্রতি দায়িত্ব বা হক্কুল্লাহ ও মানব স¤প্রদায়ের প্রতি দায়িত্ব বা হক্কুল ইবাদের মধ্যে সীমারেখা টেনে দেয়া হয় এই ভাষণে। মুহাম্মদ সা: এই ভাষণে সমাজ ও রাষ্ট্রে অরাজকতা, বিদ্রোহ ও কুপরামর্শ প্রদানকারী শয়তানদের বিরুদ্ধে সতর্ক থাকতে বলেছেন। এই ভাষণে বিভিন্ন ধরনের সুদপ্রথা রহিত করে শোষণমুক্ত সমাজ গঠনের দিকনির্দেশনা দেয়া হয়েছিল। নারীর পূর্ণ নিরাপত্তা, সম্মান ও অধিকারকে নিশ্চিত করার জন্য মুসলমানদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল এই ভাষণে। মানুষে মানুষে আত্মীয়তার বন্ধন, বিশেষ করে রক্তের সম্পর্কের ওপর সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছিল। সামাজিক কুসংস্কার থেকে মানুষের মুক্তি লাভের ওপর জোর দেয়া হয়েছিল।
মুহাম্মদ সা:-এর এই ঐতিহাসিক ভাষণে স্বর্গ-মর্ত্যরে সব কিছুর ওপর আল্লাহর কর্তৃত্ব সুনিশ্চিত করা হয়েছিল এবং মানুষকে এসব কিছুর আমানতদার হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। আল্লাহর মালিকানায় সবার অধিকার স্বীকৃত বলে উত্তরাধিকার আইনের ওপর অত্যন্ত গুরুত্বারোপ করা হয়েছিল। আমানতের খেয়ানতকারীর প্রতি কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছিল। মানুষের জীবন, সম্পদ ও সম্ভ্রমের নিরাপত্তা বিধানের জন্য কাজ করার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছিল। এই ভাষণে সাম্য, স্বাধীনতা, ন্যায়পরায়ণতা, বদান্যতা ও মানবতার পরম ধর্ম হিসেবে ইসলামকে স্বীকৃতি দেয়া হয়।
তিনি ছিলেন ক্ষমা, উদারতা ও করুণার মূর্ত প্রতীক : এ ক্ষেত্রে পৃথিবীর সবচেয়ে সফল সুমহান ব্যক্তিত্ব; ক্ষমা, উদারতা ও করুণার মূর্ত প্রতীক ছিলেন তিনি। অন্যের দুঃখ-কষ্টে তাঁর হƒদয় কেঁদে উঠত, মানুষের বিপদ-আপদে তাঁর চিত্ত ব্যথিত হতো। সমাজে অভাবী, অনাহারী মানুষকে অকাতরে তিনি দান করে গেছেন সর্বস্ব। নিজে ক্ষুধিত হয়েও সমাজে ক্ষুধার্ত মুসাফির, এতিম, মিসকিনকে তিনি অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছেন নিজের অন্ন-বস্ত্র।
চলমান বিশ্বসমাজ সংসারে তাঁর ন্যায়নীতি, সুবিচার ও সুশাসন কায়েম হলে পরে পৃথিবীতে কোনো প্রকার সামাজিক অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা বিরাজমান থাকত না। প্রখ্যাত দার্শনিক জর্জ বার্নার্ড শ সমস্যা-জর্জরিত বর্তমান বিশ্বে সামাজিক শান্তি ও মুক্তির পথ খুঁজতে গিয়ে যথার্থই বলেছেন, ‘I believe that if a man like him were to assume the dictatorship of the modern world he would succed in solving its problems in a way that would bring it the much-needed peace and happiness.’ ‘মুহাম্মদ সা:-এর মতো কোনো ব্যক্তি যদি আধুনিক জগতের একনায়কত্ব গ্রহণ করতেন, তাহলে এমন এক উপায়ে তিনি এর সমস্যা সমাধানে সফলকাম হতেন, যা পৃথিবীতে নিয়ে আসত বহুল প্রত্যাশিত শান্তি ও সুখ।’
রাসূলুল্লাহ সা: সর্বপ্রথম বিশ্ববাসীকে সভ্যতাপূর্ণ ও সন্ত্রাসমুক্ত সমাজ উপহার দিয়ে ইসলামের সাম্য, মৈত্রী, ঐক্য, শান্তি-শৃঙ্খলা এবং নিরাপত্তার বাণী শুনিয়েছিলেন। তাঁর অনুপম জীবনচরিত ও সমাজ সংস্কারমূলক কর্মধারা সব মানুষের জন্য অনুসরণীয় ও অনুকরণীয় এক চিরন্তন আদর্শ। মানবজাতির মধ্যে ভ্রাতৃত্ব-সংহতি ও সৌহার্দ্য-স¤প্রীতি সুরক্ষা এবং সমাজ থেকে অন্যায়, অবিচার ও অসত্য দূরীভূত করে শান্তি প্রতিষ্ঠায় তাঁর আজীবন প্রয়াস বিশ্বমানবতার জন্য মহান অনুপ্রেরণার উৎস। মহান আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই রাসূলুল্লাহ সা:-এর জীবনে রয়েছে তোমাদের জন্য সর্বোত্তম আদর্শ।’ তাই, আমাদের সমাজ থেকে হিংসা-বিদ্বেষ, সন্ত্রাস, দুর্নীতি, শোষণ, বঞ্চনা, বৈষম্য ও বিভ্রান্তি দূরীভূত করে মানবসমাজে পরিপূর্ণ শান্তি ও স্থিতিশীলতা অর্জনের মাধ্যমে মহানবী সা: প্রদর্শিত সভ্যতাপূর্ণ সমাজ বিনির্মাণ করাই হোক আমাদের আজকের অঙ্গীকার। লেখক: প্রফেসর, আরবি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com