বুধবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ০২:৩০ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম ::
ব্যবসায়ীদের সরকারের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার আহ্বান অধ্যাপক ইউনূসের রাষ্ট্রপতির কাছে সুপ্রিম কোর্টের বার্ষিক প্রতিবেদন পেশ প্রধান বিচারপতির দেশমাতৃকার বিরুদ্ধে দেশী-বিদেশী চক্রান্ত থেমে নেই: তারেক রহমান তুর্কি রাষ্ট্রদূতের সাথে জামায়াতের সৌজন্য সাক্ষাৎ চিন্ময় সমর্থক জঙ্গীদের হামলায় আইনজীবী সাইফুল ইসলাম নিহত অভ্যন্তরীণ বিষয় হস্তক্ষেপ: চিন্ময় ইস্যুতে ভারতের উদ্যোগ শাপলা চত্বরে গণহত্যায় হাসিনাসহ ৫০ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আমরা চাই না ছাত্র ভাইদের কঠোর হয়ে দমন করতে : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা রাষ্ট্রদ্রোহের ঘটনায় যুক্ত থাকলে ছাড় দেয়া হবে না : আসিফ মাহমুদ মানুষ কেন তাদের ওপর বিক্ষুব্ধ, গণমাধ্যমের তা স্পষ্ট করা উচিত : নাহিদ ইসলাম

ইসলামে মানবসম্পদ উন্নয়ন

ড. ইকবাল কবীর মোহন:
  • আপডেট সময় শনিবার, ২০ নভেম্বর, ২০২১

‘কুনতুম খাইরা উম্মাতিন উখরিজাত লিননাস’- তোমরা শ্রেষ্ঠ জাতি, মানুষের কল্যাণের জন্য তোমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে। মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত। সৃষ্টির সেরা জীব। দুনিয়ার সব সম্পদ ও প্রাকৃতিক অবদান আল্লাহ মানুষের অধীন করে দিয়েছেন। মানুষ এই সম্পদের সুন্দর ব্যবস্থাপনা করবে। সততা, বিশ^স্ততা ও দক্ষতার সাথে মানুষ আল্লাহর সম্পদের সদ্ব্যবহার করবে। মানবগোষ্ঠীর সুন্দর পথচলা এবং সুষ্ঠু পরিচালনার ওপরই উন্নত পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের কাঠামো নির্ভর করে। মানবসম্পদের সঠিক ব্যবস্থাপনা তাই অত্যন্ত জরুরি। এই দুনিয়া ও আখিরাতে সফলতা বিধান মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার অন্যতম উদ্দেশ্য। সর্বাধিক কাজ সম্পাদন, পেশাগত উন্নয়ন, দক্ষতা বৃদ্ধি, কর্ম উদ্দীপনা সৃষ্টি, ভালো কাজে পুরস্কার প্রদান, অপরাধের জন্য শাস্তি প্রদান ইত্যাদি কাজ মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার অন্তর্ভুক্ত। মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে ইসলাম একগুচ্ছ নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। এসব নীতিমালা মানুষের মধ্যে উত্তম মানসিকতা, নৈতিক গুণাবলি, আত্মবিশ^াস, কর্মোদ্দীপনা, ভালো কাজ করার স্পৃহা সৃষ্টি করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। নিচে মানবসম্পদ উন্নয়নে ইসলামের নীতিমালাগুলো সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো-
১. ভ্রাতৃত্ববোধ: মানবসম্পদ ব্যবস্থানার ক্ষেত্রে ভ্রাতৃত্ববোধ খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ভ্রাতৃত্ববোধ মানবজাতির ঐক্যের মূল ভিত্তি। ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে ভ্রাতৃত্ববোধ একটি মৌলিক নীতি। সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ বিদ্যমান থাকলে জনবলের ভেতর সৌহার্দ্য, স¤প্রীতি ও মমত্ববোধ বৃদ্ধি পায়। কুরআন মাজিদে ভ্রাতৃত্ববোধ নিয়ে আল্লাহ বলেন, ‘প্রত্যেক মুসলিম ভাই ভাই’ (সূরা হুজুরাত : ১০)। এ প্রসঙ্গে রাসূল সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো সঙ্কটাপন্ন ব্যক্তির সঙ্কট নিরসন করবে, আল্লাহ দুনিয়া ও আখিরাতে তার যাবতীয় সঙ্কট নিরসন করে দেবেন।’
২. কল্যাণ কামনা: মানুষের জন্য ভালো কিছু করা সমাজব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য। ইসলামের প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে জনগণের কল্যাণ করা। মানব কল্যাণ ও স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবন নিশ্চিত করা ইসলামী জীবন ব্যবস্থার অন্যতম মৌলিক বৈশিষ্ট্য। সুতরাং একে অন্যের জন্য কল্যাণ কামনা করা, স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবনযাপনে সহযোগিতা, দয়া ও ইহসান, সহানুভূতি সৃষ্টি করে। কুরআন মাজিদে ইরশাদ হয়েছে, ‘এবং মা-বাবা, আত্মীয়স্বজন, ইয়াতিম, অভাবগ্রস্ত, নিকট প্রতিবেশী, দূর প্রতিবেশী, সঙ্গী সাথী, মুসাফিরদের প্রতি সদ্ব্যবহার করবে এবং তোমাদের অধিকারভুক্ত দাস-দাসীদের প্রতিও ইহসান করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ অহঙ্কারী দাম্ভিকদের পছন্দ করেন না’ ( সূরা নিসা : ৩৬)। মহানবী সা: বলেছেন, ‘তোমরা জমিনের অধিবাসীদের প্রতি দয়া করবে, তাহলে আসমানের অধিপতি আল্লাহও তোমাদের প্রতি দয়া করবেন।’
৩. সুবিচার: মানবসমাজ থেকে জুলুমের অবসান করা ইসলামী জীবনব্যবস্থার আরেকটি উদ্দেশ্য। এ বিষয়ে ইসলামের আহ্বান দ্ব্যর্থহীন ও স্পষ্ট। আল্লাহ তায়ালা সুবিচার করার আহ্বান জানিয়েছেন। সুবিচারের অনুপস্থিতিকে অন্ধকারের সাথে তুলনা করা হয়েছে। ব্যবস্থাপনায় সুবিচার সবার হক প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করে। এর দ্বারা পারস্পরিক সম্পর্ক বৃদ্ধি পায়। কুরআন কারিমে বর্ণিত হয়েছে, ‘তোমরা সুবিচার করবে; তা তাকওয়ার নিকটতর’ (সূরা মায়েদা : ৮)। রাসূলুল্লাহ সা: ইরশাদ করেছেন, ‘কিয়ামতে মানুষের মধ্যে পরাক্রমশালী মহান আল্লাহ সবচেয়ে প্রিয় ও নিকটবর্তী আসনে আসীন হবেন ন্যায়পরায়ণ শাসক।’
৪. অন্যের অধিকার সংরক্ষণ: জনবল ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে এটিও উল্লেখযোগ্য নীতি। মনে রাখুন, ইসলামের দৃষ্টিতে অধিকার কারোর দয়া-দাক্ষিণ্যের বিষয় নয় অথবা মানবীয় চিন্তা-চেতনার ফসলও নয়। মানুষের মৌলিক অধিকারগুলো মহান আল্লাহ তায়ালা মঞ্জুর করেছেন। তাই প্রত্যেককে সব সৃষ্টির বৈধ ও ন্যায়সঙ্গত অধিকার পূরণ করতে হবে। অধিকারগুলো রক্ষা করা ও হিফাজত করা সৎকর্মের অর্ন্তর্ভুক্ত। কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘অতএব তোমরা ভালো কাজে প্রতিযোগিতা করো’ (সূরা বাকারা : ১৪৮)। আল্লাহর রাসূল সা: অধিকার প্রদানের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘কাজেই প্রত্যেক হকদারকে তার ন্যায্য অধিকার দিয়ে দাও’ (বুখারি)।
৪. তাকওয়া: মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে এটি একটি অন্যতম নীতি। বিশেষ করে নিয়োগকারী ও নিয়োজিতÑ উভয় পক্ষের আস্থা থাকতে হবে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের ওপর। এ ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে আমানত ও ইখলাসের সাথে দায়িত্ব পালন করতে হবে এবং নিয়োগকারী ও নিয়োজিতদের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে। কুরআন মাজিদে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমাদের মাঝে সেই ব্যক্তি আল্লাহর কাছে বেশি সম্মানিত, যে তোমাদের মধ্যে অধিক মুত্তাকি’ (সূরা হুজরাত : ১৩)। রাসূল সা: দুনিয়ার যাবতীয় বিষয়ে তাকওয়া অবলম্বনের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘দুনিয়া সুমিষ্ট ও সুদর্শনীয়। কাজেই দুনিয়া ও নারীর ব্যাপারে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করবে।’ মহানবী সা: বলেছেন. ‘সত্যবাদিতা পুণ্যের দিকে নিয়ে যায়, আর পুণ্য জান্নাতের দিকে নেয়। … পক্ষান্তরে মিথ্যাচারিতা পাপের দিকে ঠেলে দেয়, পাপ জাহান্নামে নিয়ে পৌঁছায়।’
৫. সদাচরণ: মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার জন্য সদাচরণ অত্যাবশ্যক। আখলাকে হাসানা অর্জন জরুরি। ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে একদিকে যেমন শৃঙ্খলা রক্ষার কৌশল প্রয়োগ প্রয়োজনীয় হয়ে উঠতে পারে, তেমনি অপরদিকে উত্তম চারিত্রিক গুণাবলির প্রতিফলন দরকার। সদাচরণের মাধ্যমে সহজে মানুষকে আকৃষ্ট করা যায়, মানুষের মন জয় করা যায় সহজে। মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে এটি একটি অন্যতম নীতি হিসেবে বিবেচিত। আল্লাহ তায়ালা এ সম্পর্কে ইরশাদ করেন, ‘আপনি অবশ্যই মহান চরিত্রে অধিষ্ঠিত’ (সূরা আল কলম : ৪)। মহানবী সা: আরো বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই উত্তম, যার চরিত্র বা আখলাক সর্বোৎকৃষ্ট।’
৬. প্রেষণা: মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনায় প্রেষণার ভূমিকা অত্যন্ত ইতিবাচক। মানুষকে যদি উদ্বুদ্ধ করা না যায়, তা হলে কোনো ব্যবস্থা বা কর্মকৌশল পুরোপুরি কাজে লাগে না। মানুষের কাছে তার সর্বোচ্চ কর্মক্ষমতা অনুযায়ী কাজ বা সেবা পেতে হলে তাকে উদ্বুদ্ধ ও উজ্জীবিত করতে হবে। ব্যক্তি-মানুষকে কর্মক্ষম, সুশৃঙ্খল ও সচেতন করার জন্য প্রেষণা অতীব প্রয়োজনীয়।
৭. চুক্তি পালন: মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে এটি অত্যাবশ্যকীয় একটি বিষয়। কোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানে জনবল নিয়োগ হলে প্রকৃতপক্ষে নিয়োজিতরা ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের সাথে চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। চুক্তি কখনো লিখিত হতে পারে অথবা অলিখিত হতে পারে। চুক্তি বাস্তবায়নে কর্তৃপক্ষকে সচেষ্ট থাকতে হবে। কুরআন কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা প্রতিশ্রুতি পালন করবে’ (সূরা ইসরা : ৩৪)। রাসূল সা: বলেন, ‘যে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে না; দ্বীন ইসলামে তার কোনো অংশ নেই।’
৮. নিরাপত্তা: প্রত্যেকেরই সম্মানজনক ও মানবিক মানের জীবনযাপনের অধিকার রয়েছে। যাদের ন্যূনতম মৌলিক চাহিদা পূরণের সামর্থ্য নেই তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণের দায়িত্ব সম্মিলিত সমাজের অথবা রাষ্ট্রের ওপর বর্তায়। ইসলাম অপারগ, নিঃস্ব, অসহায়, অসুস্থ এবং বৃদ্ধদের সামাজিক নিরাপত্তা দেয়ার নিশ্চয়তা প্রদান করে। কেউ সম্পদহীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করলে মৃত্যুর পর তার পরিবারের হিফাজত ও নিরাপত্তার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে, ‘যে সম্পদ রেখে মারা যাবে, তা তার উত্তরাধিকারীদের জন্য, আর হারিয়ে যেতে উদ্যত অথবা বোঝা রেখে যাবে, তারা যেন আমার কাছে আসে। কেননা, আমিই তার অভিভাবক।’
ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে ভ্রাতৃত্ববোধ, ন্যায়পরায়ণতা, কল্যাণকামিতা, বিশ^াস, পারস্পরিক সহযোগিতা, ব্যক্তির অধিকার ক্ষতিপূরণ, চুক্তি বাস্তবায়ন, প্রেষণা দান ইত্যাদি বিষয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে এগুলো নৈতিক নীতিমালা হিসেবে বিবেচিত হয়।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com