সোমবার, ০১ জুলাই ২০২৪, ০৪:০৭ অপরাহ্ন

সদকা নিভিয়ে দেয় পাপ

সাবরিনা ওবায়েদ আনিকা:
  • আপডেট সময় রবিবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২১

‘সদকাহ’ শব্দটি আরবি মূল শব্দ ‘সিদক’ থেকে এসেছে, যার অর্থ আন্তরিকতা; এটি আন্তরিক বিশ্বাসের চিহ্ন হিসেবে বিবেচিত হয়। ‘সদকা’-এর আক্ষরিক অর্থ ‘ন্যায়পরায়ণতা’ এবং এটি দান বা স্বেচ্ছাসেবী দানকে বোঝায়। তবে ইসলামী পরিভাষায়; সদকাকে ‘বিনিময়ে কোনো কিছু না চেয়ে একমাত্র আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার অভিপ্রায়ে কাউকে কিছু দেয়া’ বোঝানো হয়েছে। এ ছাড়াও, আর-রাগিব আল-আসফাহানির মতে, ‘সদকা হলো জাকাতের মতো, আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়ার আশায়, ব্যক্তির যা কিছু আছে তা থেকে দেয়াকে সদকা বলে।’
কুরআন অনুসারে, এই শব্দের অর্থ স্বেচ্ছাসেবী নৈবেদ্য। জাকাতের মতো সদকা বাধ্যতামূলক নয়। জাকাত প্রদানের বাইরে ধর্মীয় দায়িত্ব হিসেবে সদকা প্রদান করা হয়। অভাব দূর করা ও লজ্জাস্থান আবৃত রাখা সদকার বিধান জারি করার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। শরিয়তের দৃষ্টিতে উত্তম যেকোনো কাজে সদকার অর্থ ব্যয় করা যায়। ইমাম জুরজানি বলেন, ‘এমন দানকে সদকা বলে যার মাধ্যমে আল্লাহর নিকট সওয়াব আশা করা হয়।’ ইবনে মানজুর বলেছেন, ‘মহান আল্লাহর নিমিত্তে গরিব মিসকিনদের জন্য দান করাকে সদকা বলা হয়।’
গোপন-প্রকাশ্যে যেকোনোভাবে দান করা যায়। সব দানেই সওয়াব রয়েছে। দানের মাধ্যমে মহান আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীর মানুষের মাঝে রিজিকের ভারসাম্যতা রক্ষা করেন। বিনিময়ে প্রতিদানও দিয়ে থাকেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যদি তোমরা প্রকাশ্যে দান-সদকা করো, তবে তা কতই না উত্তম। আর যদি গোপনে ফকির-মিসকিনকে দান করে দাও, তবে আরো বেশি উত্তম। এর মাধ্যমে আল্লাহ তোমাদের মন্দগুলো মোচন করে দেবেন। তোমরা যা করো আল্লাহ তা অবগত আছেন।’ (সূরা বাকারা, আয়াত-২৭১)
দান করে খোটা দিতে নেই। এতে দানের ফজিলত বিনষ্ট হয়। আল্লাহ বলেন, ‘সদ্ব্যবহার, সুন্দর কথা ওই দান অপেক্ষা উত্তম, যার পেছনে আসে যন্ত্রণা। আল্লাহ তায়ালা ঐশ্বর্যশালী ও পরম সহিষ্ণু। হে মুমিনগণ! তোমরা খোঁটা দিয়ে ও কষ্ট দিয়ে তোমাদের দানকে বাতিল করো না। তাদের মতো যারা তাদের সম্পদ ব্যয় করে লোকদেখানোর জন্য এবং তারা আল্লাহ ও পরকাল বিশ্বাস করে না।’ (সূরা বাকারা, আয়াত : ২৬৩-২৬৪)। নবীজী সা: বলেন, ‘খোটাদানকারী বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবে না’। (তিরমিজি)
পবিত্র কুরআন-হাদিসে অত্যাবশ্যক এবং ঐচ্ছিক এ উভয় প্রকার দানকেই সদকা বলা হয়েছে। তবে প্রচলিত অর্থে শুধু ঐচ্ছিক নফল দানকেই সদকা বলা হয়ে থাকে।
সদকার প্রকার : সদকা দুই প্রকার- ১. সাধারণ সদকা; ২. সদকায়ে জারিয়া। গরিব দুঃখীকে টাকা পয়সা দান করা, ভালো ব্যবহার করা সাধারণ সদকার অন্তর্ভুুক্ত। আর সদকায়ে জারিয়া বলা হয় ওই সব সৎকর্ম যেগুলোর কল্যাণকারিতা স্থায়ী হয়। এর মধ্যে সর্বাগ্রে হচ্ছে দ্বীনি এলেম শিক্ষা দান, দ্বীনি বই-পুস্তক রচনা ও প্রকাশ করে সর্বসাধারণের মধ্যে এলেম পৌঁছানো। কারণ, দুনিয়া ও আখিরাতের জীবনে মানবসন্তানের জন্য সর্বাধিক কল্যাণকর বিষয় হচ্ছে আল্লাহর সাথে, তাঁর বিধিবিধানের সাথে এবং রাসূল সা:-এর সাথে পরিচিতি লাভ। তার পরের স্থান মাসজিদ, এতিমখানা, মাদরাসা, রাস্তাঘাট, সেতু-পুকুর প্রভৃৃতি জনকল্যাণমূলক খাতে দান করা। এসবের দ্বারা অনেক বেশি লোক উপকৃত হন এবং উপকারটুকু দীর্ঘদিন স্থায়ী হয়। হজরত আবু হুরায়রা রা: বর্ণিত হাদিসে এসেছে, রাসূল সা: বলেন, ‘যখন কোনো ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করে, তার সব আমল বন্ধ হয়ে যায়, তিনটি ব্যতীত- সদকায়ে জারিয়া, উপকারী জ্ঞান অথবা সৎকর্মশীল সন্তান যে তার জন্য দোয়া করে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস-১৬৩১)। ইমাম আন-নববী রহ: এই হাদিসটির ওপর মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন, ‘সদকায়ে জারিয়া হলো ওয়াকফ।’ (শরহে মুসলিম-১১/৮৫)
পবিত্র কুরআনে দান-সদকার কথা : অসংখ্য আয়াতে দান-সদকার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। মহান আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘তারা আপনার কাছে জিজ্ঞেস করে, তারা কী ব্যয় করবে? (আল্লাহ বলেন) জানিয়ে দিন, যা তোমাদের প্রয়োজনাতিরিক্ত।’ (সূরা বাকারা, আয়াত-২১৯) মহান আল্লাহ তায়ালা অপর আয়াতে বলেন, ‘যারা আল্লাহর রাস্তায় স্বীয় ধন-সম্পদ ব্যয় করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে এবং নিজের মনকে সুদৃঢ় করার জন্য, তাদের উদাহরণ টিলায় অবস্থিত বাগানের মতো, যাতে প্রবল বৃষ্টিপাত হয়; অতঃপর দ্বিগুণ ফসল দান করে। যদি এমন প্রবল বৃষ্টিপাত না-ও হয়, তবে হালকা বর্ষণই যথেষ্ট। আল্লাহ তোমাদের কাজকর্ম যথার্থই প্রত্যক্ষ করেন।’ (সূরা বাকারা, আয়াত-২৬৫)
হাদিসে দান-সদকার কথা : অসংখ্য হাদিসেও দান-সদকার ফজিলত তুলে ধরা হয়েছে। গোপনে দান করার ব্যাপারে হাদিসে অধিক ফজিলতের কথা বর্ণিত হয়েছে। গোপনে দানকারী কিয়ামতের দিন মহান আল্লাহর আরশের নিচে ছায়া লাভ করবে, নবী সা: বলেন, ‘কিয়ামত দিবসে সাত শ্রেণীর মানুষ আরশের নিচে ছায়া লাভ করবে। তাদের মধ্যে এক শ্রেণী হচ্ছে, ‘এক ব্যক্তি এত গোপনে দান করে যে, তার ডান হাত কি দান করে বাম হাত জানতেই পারে না।’ (বুখারি ও মুসলিম) দান-সদকা গুনাহ মাফ করে ও জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচায়। নবী সা: বলেন, ‘হে কাব বিন উজরা! সালাত (আল্লাহর) নৈকট্য দানকারী, সিয়াম ঢালস্বরূপ এবং দান-সদকা গুনাহ মিটিয়ে ফেলে, যেমন পানি আগুনকে নিভিয়ে ফেলে।’ (আবু ইয়ালা, সনদ সহিহ)
লোক দেখানো দান-সদকার শাস্তি : যারা মানুষের প্রশংসা নেয়ার উদ্দেশে দান করবে, তাদের দ্বারাই জাহান্নামের আগুনকে সর্বপ্রথম প্রজ্জ্বলিত করা হবে। রাসূল সা: বলেন, ‘সর্বপ্রথম তিন ব্যক্তিকে দিয়ে জাহান্নামের আগুনকে প্রজ্জ্বলিত করা হবে।… তাদের মধ্যে (সর্বপ্রথম বিচার করা হবে) সেই ব্যক্তির, আল্লাহ যাকে প্রশস্ততা দান করেছিলেন, দান করেছিলেন বিভিন্ন ধরনের অর্থসম্পদ। তাকে সামনে নিয়ে আসা হবে। অতঃপর (আল্লাহ) তাকে প্রদত্ত নিয়ামত পরিচয় করাবেন। সে তা চিনতে পারবে। তখন তিনি প্রশ্ন করবেন, কী কাজ করেছ এই নিয়ামতসমূহ দিয়ে? সে জবাব দেবে, যে পথে অর্থ ব্যয় করলে আপনি খুশি হবেন এ ধরনের সব পথে আপনার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে অর্থসম্পদ ব্যয় করেছি। তিনি বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছ। বরং তুমি এরূপ করেছ এই উদ্দেশ্যে যে, তোমাকে বলা হবে, সে দানবীর। আর তা তো বলাই হয়েছে। অতঃপর তার ব্যাপারে নির্দেশ দেয়া হবে। তখন তাকে মুখের ওপর উপুড় করে টেনে-হিঁচড়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।’ (মুসলিম)




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com