সন্তানের জন্য মা-বাবা হলেন বটবৃক্ষের ছায়ার ন্যায় । এ পৃথিবীতে প্রতিটি মানুষের কাছেই সবচেয়ে প্রিয় হলেন তার মা এবং বাবা। যে বাবা আমাকে জন্ম দিয়েছেন, আমাকে মানুষ করতে রাতদিন পরিশ্রম করেছেন,যে মা আমাকে বুকের দুধ পান করিয়েছেন , আমার মলমূত্র জড়ানো কাপড়-চোপড় ধৌত করেছেন, ভীষণ কষ্টে থেকেও অতি আদরে আমায় লালন পালন করেছেন, সে বাবা-মা-কে কখনও ভুলে থাকা চলে না। কেউ ভুলে থাকতে পারেও না। বিবেক-শূণ্য ব্যক্তির বিবেকও মাকে ভুলে থাকতে দেবে না । কিন্তু এতো সুন্দর “মুসলিম সমাজ ব্যবস্হা ” কি এখন আছে ? নেই।
সমাজের লোকেরা শুধু নামাজ রোজা হজ্ব নিয়ে ব্যস্ত, ভুলে গেছে কোরআনের দিক-নির্দেশনা। দূরে ছুড়ে ফেলেছে হেদায়েতের কিতাবখানা।সালাত শেষে বাসায় এসে অবর্ণনীয় আচরণ মা-বাবার সাথে! রোজা রেখেও যে ব্যক্তি বৃদ্ধ মা-বাবাকে কষ্ট দেওয়া ছাড়লো না , তার নামায রোযার মূল্য আল্লাহর দরবারে কতটুকু?
প্রিয় পাঠক, মুসলিম সমাজে পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের আচার-আচরণ মন-মানস কত মমতাময় হবে, কেমন সুন্দর হবে কোরআনের এই আয়াত থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় ।
পবিত্র কোরআনের আল্লাহ বলেন,- “আর আপনার প্রতিপালক সিদ্ধান্ত দিয়েছেন যে,তোমরা তাকে ছাড়া আর কারও ইবাদত করবে না, আর পিতা-মাতার সঙ্গে সদাচার করবে । যদি তোমার কাছে তাদের একজন , বা উভয়ে বার্ধক্যে উপনীত হয় তাহলে তাদের উদ্দেশ্যে “উফ” পর্যন্ত বলো না। আর তাদেরকে ধমকিও না। বরং তাদের সঙ্গে সম্মানজনক কথা বলো । আর দয়াবশত তাদের জন্য বিনয়ের ডানা মেলে দাও(বিনয়ের আচরণ করো।) আর বলো,হে প্রতিপালক, আপনি তাদের প্রতি দয়া করুন, যেমন তারা আমাকে প্রতিপালন করেছেন শৈশবে।” (সূরা বনি ইসরাইল ,আয়াত নং ২৩-২৪)
পিতা-মাতা কত মর্যাদাবান! বান্দাকে তার স্রষ্টা যেখানে আপন বন্দেগীর আদেশ করেছেন সেখানে একই সঙ্গে মা-বাবার প্রতি সদ্ব্যবহারেরও নির্দেশ দিয়েছেন । জীবন-নদীতে কখনো জোয়ার কখনো ভাটা থাকে । কখনো বা পর্বতসম ঢেউ ওঠে । জোয়ার, ভাটা ,ঢেউ যাই আসুক না কেনো জীবনে , যে পরিস্থিতিতেই আমি থাকি না কেনো, সন্তান হয়ে কষ্টের প্রকাশরূপেও মা-বাবার সামনে “উফ” শব্দটি উচ্চারণ করার অধিকার আমার নেই। আল্লাহ বান্দার প্রতি দয়াবান হয়ে কত সুন্দর দোয়া বান্দাকে শিক্ষা দিয়েছেন। সুসন্তান হওয়ার জন্য আল্লাহর শেখানো দোয়া আমার জানা থাকা কতই না প্রয়োজন ! শৈশবে যে মা-বাবা আমাকে প্রতিপালন করেছেন তাদের জন্য জীবন দিলেও তো তাদের ঋণ কখনো শোধ করতে পারব না । তাই রব্বে কারীমের মহান দরবারে ফরিয়াদ করে বলতে পারি , “হে প্রভু! আপনি তাদের প্রতি দয়া করুন , যেমন তারা শৈশবে আমাকে লালন-পালন করেছেন।” ভিন্ন এক আয়াতে আল্লাহ তা’আলা বলেছেন- “আর আমি কঠোর আদেশ করেছি মানুষকে তার মা-বাবার সঙ্গে সদাচার করার।(কারণ) তার মা তাকে (গর্ভে) ধারণ করেছে অতিকষ্টে, এবং তাকে প্রসব করেছে অতিকষ্টে । তাকে ধারণ করা ও দুগ্ধদান করা দীর্ঘ ত্রিশটি মাসের বিষয়।”(সূরা আহকাফ, আয়াত নং- ৪৬।)
সন্তানের কাছে মা-বাবার এই যে সদাচারের প্রাপ্যতা, এটা শুধু মা-বাবা হওয়ার কারণেই। সুতরাং মা-বাবা যদি কাফের মুশরিকও হন,তবু সন্তানের কাছে তারা সদাচারের হকদার। কোরআনের বক্তব্য –
“আর যদি তারা তোমাকে বাধ্য করে আমার সঙ্গে এমন কিছুকে শরীক করতে যে বিষয়ে তোমার কোন জ্ঞান নেই , তবে তুমি তাদের আনুগত্য করো না,তবে দুনিয়াতে তাদের সঙ্গ দাও সদাচারের সাথে ।”( সূরা লোকমান, আয়াত নং -১৫ ) মা-বাবা নিজেরা মুশরিক হয়ে সন্তানকেও যদি বাধ্য করে রবের সঙ্গে শিরক করতে, তবুও আল্লাহর নির্দেশ হলো , তোমার মা-বাবা আল্লাহর হক চূড়ান্তভাবে লঙ্ঘন করেছেন। তারপরও তুমি তোমার ওপর তাদের প্রাপ্য হকের কথা ভুলে যেও না। শিরকের পথে তো তাদের আনুগত্য কিছুতেই করবে না । তবে যতদিন তারা দুনিয়াতে বেঁচে থাকবেন তাদের প্রতি তোমার আচার-আচরণ হবে আদবের,মহব্বত ও সদাচারের।
মা-বাবার সঙ্গে অসদাচরণ সম্পর্কে বিভিন্ন হাদিসে কঠিন সতর্কবাণী উচ্চারিত হয়েছে। হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু হতে বর্ণিত , নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন , তার নাক ধূলি মিশ্রিত হোক , আবার তার নাকি ধূলি মিশ্রিত হোক , আবার তার নাক ধূলি মিশ্রিত হোক। জিজ্ঞাসা করা হল, কে ইয়া রাসূলাল্লাহ? তিনি বললেন ,যে তার মা-বাবাকে বার্ধক্যের অবস্থায় পেয়েছে কিংবা তাদের একজনকে ,আর তিনি তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাননি।(আল হাদীস) অর্থাৎ, বৃদ্ধ পিতা মাতাকে পেয়েও তাদের সেবা করার মাধ্যমে জান্নাত লাভ করতে পারলো না, সে তো ধ্বংসই হয়ে গেলো। প্রিয় পাঠক ,যে সন্তান তার পিতা-মাতাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠায়, সে সন্তান কী করে জান্নাতের অন্তহীন সুখ লাভ করবে ? বৃদ্ধাশ্রমে পিতা-মাতার সামনে যদি রকমারি খাবারও পেশ করা হয় আর তাদের হৃদয় ক্ষতবিক্ষত হতে থাকে সন্তান থেকে দূরে থাকার কারনে, তবে কি সেই সন্তানের ভাগ্যে জান্নাতের নেয়ামতরাজি জুটবে?
সবশেষে আলোচনার সমাপ্তি টানছি বিশুদ্ধতম হাদিস গ্রন্থপ্রণেতা আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে ইসমাঈল আল বুখারী (যিনি ইমাম বুখারী নামেই প্রসি ) রহমাতুল্লাহি আলাইহি এর বর্ণনাকৃত একটি বাণীর মাধ্যমে। ইমাম বুখারী রহমাতুল্লাহি আলাইহি তার “আদাবুল মুফরাদ” কিতাবে বর্ণনা করেন, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু বলেছেন ,”আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য মায়ের সাথে নম্র আচরণের চেয়ে বড় কোনো আমল আছে বলে আমার জানা নেই।” লেখক: মাওলানা সাঈদুর রহমান বিন দুদুমিঁয়া ,নড়িয়া, শরীয়তপুর।