প্রতি বছর ডিসেম্বর আর জানুয়ারিতে শীতে যখন জবুথবু দেশের নানাপ্রান্ত তখনও ঢাকায় শীত খুঁজে পাওয়া কষ্ট। আকস্মিক শৈত্যপ্রবাহে দু-একদিন সূর্যের দেখা না মিললে শীত কিছুটা অনুভব করে শহরবাসী। এর বাইরে ঢাকায় রাত-দিনে শীত খুঁজে পাওয়াই কঠিন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর প্রধান কারণ ঢাকার জনসংখ্যার ঘনত্ব। অনেক অল্প জায়গাতে বেশি মানুষ বাস করাতে অর্থনৈতিক কর্মকা- অনেক বেশি হয়। যেমন গাড়ি চলে, শিল্পকারখানা চলে। ফলে যে তাপের সৃষ্টি হয়, শীত যেন তার কাছে পাত্তাই পায় না।
জলবায়ু বিশেষজ্ঞ আইনুন নিশাত বলেন, মূল কারণ ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা । যে শহরে জনসংখ্যা বেশি সে শহরে তাপ বা জ্বালানির ব্যবহারও বেশি । শিল্প কারখানার সংখ্যা বেশি। এমন শহরগুলোকে সাধারণত ‘হিট আইল্যান্ড’ বলা হয়। বাংলাদেশের শুধু ঢাকা নয়, অন্য বড় শহর যেমন চট্টগ্রামের তাপমাত্রা খুব একটা কমে না একই কারণে। ঢাকা এরমধ্যে সবচেয়ে বড় হিট আইল্যান্ড। তিনি বলেন, ঢাকার এই তাপমাত্রা কমার কোনও সম্ভাবনাই নেই। কারণ এই শহরের জনসংখ্যা তো কমানো সম্ভব নয়। বরং দিন দিন তাপমাত্রা আরও বেড়ে যাবে সেটাই স্বাভাবিক। বাস্তবতা বলছে, সারাদেশে নভেম্বর থেকে শীত শুরু হলেও ঢাকায় ঠান্ডা অনুভূত হয় ডিসেম্বরের শেষদিকে এসে। আর জানুয়ারিতেও যখন দেশের অন্য এলাকায় শীতের দাপট থাকে তখন ডিসেম্বরের শেষেই ঢাকার তাপমাত্রা বাড়তে শুরু করে।
গত পাঁচ বছরের ডিসেম্বর জুড়ে ঢাকার তাপমাত্রার যে হিসেব তাতে দেখা যায় দিনের তাপমাত্রা ২৯ ডিগ্রি থেকে ২০ ডিগ্রির মধ্যে ওঠানামা করছে। আর রাতে ১১ থেকে ১৯ এর মধ্যে উঠানামা করেছে। অনাকাঙ্খিতভাবে এই তাপমাত্রা উত্তরের মতো খুব বেশি নেমে যেতে দেখা যায়নি।
হিসেব বলছে, ডিসেম্বরের শুরুতে গত পাঁচ বছর প্রায় একইরকম তাপমাত্রা ছিল ঢাকায়। মাঝে এবং শেষেও খুব বেশি হেরফের দেখা যায়নি। প্রায় সবসময়ই দেশের সর্বনি¤œ তাপমাত্রার সঙ্গে ঢাকার তাপমাত্রার পার্থক্য থাকে ৬ থেকে ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
ধরা যাক, গত ২২ ডিসেম্বরের কথা। এদিন তেতুলিয়াতে দেশের সর্বনি¤œ তাপমাত্রা ছিল ৮ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। একইদিন ঢাকায় সর্বনি¤œ তাপমাত্রা ছিল ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তবে শীতে ঢাকার তাপমাত্রা সবসময় দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রার কাছাকাছি থাকে। ২২ ডিসেম্বরের তাপমাত্রার দিকে তাকালে দেখা যাবে এদিন দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল শ্রীমঙ্গলে ২৬ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এদিন ঢাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ২৪ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অর্থাৎ ঢাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রার কাছাকাছি থাকে। আবার সর্বনি¤œ তাপমাত্রা থেকে ঢাকার তাপমাত্রা সব সময়ই ৬ থেকে ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি থাকে। ফলে ঢাকার শীতে হাড়ে কাঁপুনি ধরে না।
আবহাওয়া অধিদফতরের জ্যৈষ্ঠ আবহাওয়াবিদ আব্দুল মান্নান বলেন, ‘মূলত তিন কারণে ঢাকায় শীত পড়ে না। এগুলো হলোÍহিউম্যান এক্টিভিটি বেশি, উন্নয়ন কাজ বেশি এবং যানবাহনের সংখ্যা বেশি। তিনি বলেন, হিউম্যান এক্টিভিটি বলতে আমরা উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি, কোনও শহরে যদি মানুষ বেশি থাকে সেখানে চুলার আগুন বেশি জ্বলবে, এসি বেশি চলবে। ফলে তাপ তো পরিবেশে বেশি ছড়াবে। অন্যদিকে উন্নয়ন কাজ বিশেষ করে মেট্রোরেলসহ বড় কাজগুলোর কারণে ধুলোবালির পরিমাণ বেশি। ফলে শীতে যে বাতাস তা ঢাকায় ঢোকার ক্ষেত্রেই বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। এ কারণেই উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলে যে পরিমাণ শীত পড়ে ঢাকায় তার তুলনায় কম। তিনি বলেন, এদিকে ঢাকায় যে পরিমাণ যানবাহন চলে তাতে করে তাদের জ্বালানি পোড়ানোর ফলেও একটি তাপ তৈরি হচ্ছে। এছাড়া পুরো শহর এখন প্রায় কংক্রিটে মোড়া। ফলে মাটিতে তাপ পড়ে যে সেটি কমে যাবে সেই সুযোগও নেই বললেই চলে। এসব কারণেই ঢাকাকে হিট আইল্যান্ড হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। গত পাঁচ বছরের সঙ্গে এ বছরের তাপমাত্রার পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে এ বছরও গত পাঁচ বছরের মতোই ঢাকার তাপমাত্রা রয়েছে।-বাংলাট্রিবিউন