বাংলাদেশের সড়ক পথে মোটরযানে যত জ্বালানি ব্যবহৃত হয়, সেসব জ্বালানির মূল্য থেকে সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ তহবিল বাবদ প্রতি লিটার বা ইউনিটে এক টাকা করে আদায় করার প্রস্তাব করেছে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়। সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ তহবিল বোর্ড বিধিমালার যে খসড়া তৈরি করেছে, সেখানে এই প্রস্তাব রয়েছে। খসড়াটি এখন ভেটিং-এর জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর কার্যক্রম চলছে। এই বছরের শেষ নাগাদ নতুন এই বিধিমালা কার্যকর করতে চায় বাংলাদেশের সরকার। সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মোঃ আবদুল মালেক বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, ”খসড়া প্রস্তাবটি আলোচনার পর চূড়ান্ত করা হয়েছে। খুব তাড়াতাড়ি সেটি ভেটিংয়ের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।” এটি অনুমোদিত হলে বাংলাদেশের সড়ক ও মহাসড়ক রক্ষণাবেক্ষণ এই তহবিলের আওতায় করা হবে। যে বিধিমালাটি প্রস্তাব করা হয়েছে, সেখানে সড়ক রক্ষণাবেক্ষণের খরচ সড়ক ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে আদায় করা কর, জরিমানা, টোল এবং দপ্তরের সম্পদ ব্যবহারের বিনিময় থেকে সংগ্রহ করার ওপর জোর দেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং পরিবহন বিশেষজ্ঞ মোঃ শামসুল হক বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ”উন্নয়নের একটা অংশ হলো সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ। আমাদের দেশে উন্নয়নের অংশ হিসাবে অনেক রাস্তাঘাট তৈরি হচ্ছে, হয়েছে। কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে কিছুদিন পরেই সেগুলো নষ্ট হয়ে যায়।” ”রক্ষণাবেক্ষণ করতে যদি দেরি হয়ে যায়, তাহলে ভোগান্তির পাশাপাশি সেটা ঠিক করতে খরচ অনেক বেশি হয়ে যায়। আমাদের দেশে এটা একটা সমস্যা, কারণ অনেক সড়ক ঠিক সময়ে মেরামত করা যায় না। হয়তো রাস্তা তৈরির তহবিল আছে, মেরামতের তহবিল নেই। ফলে এরকম একটি তহবিল অনেক আগে থেকেই দরকার ছিল,” বলছেন ড. হক। তিনি জানান, ২০০২ সালে প্রথম এই ধরনের তহবিল গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু কোন মন্ত্রণালয়ের আওতায় বোর্ড থাকবে, এ নিয়ে দ্বন্দ্বের কারণে শেষ পর্যন্ত কার্যকর হয়নি ২০১৩ সালে সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ তহবিল বোর্ড আইন গঠন করা হয়। সেই আইনের আওতায় এখন বিধি তৈরি করা হচ্ছে।
মোটরযানের জ্বালানি থেকে এক টাকা করে আদায়: সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ তহবিল বিধিমালা ২০২১ এর আয়ের উৎস হিসাবে এক নম্বরে রয়েছে মোটরযানে ব্যবহৃত জ্বালানী থেকে আদায় করা অর্থ। যেমন মোটরযানে পেট্রোল, অকটেন, ডিজেল, সিএনজি, এলএনজি বা অন্যান্য জ্বালানি ব্যবহার করা হলে, সেই প্রতি লিটার বা ঘনমিটারে এক টাকা করে আদায়ের প্রস্তাব করা হয়েছে। কিন্তু এই টাকা কি জ্বালানি তেলের বর্তমান মূলের সঙ্গে যোগ হয়ে বাড়বে নাকি, বর্তমান মূল্য থেকেই সমন্বয় করা হবে, তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। অতিরিক্ত সচিব মোঃ আবদুল মালেক বলছেন, ”ক্যাবিনেট মিটিং পর্যায়ে হয়তো এই প্রস্তাবটি গ্রহণ করা হতে পারে, আবার নাও করা হতে পারে। যদি গ্রহণ করা হয়, তখন ঠিক করা হবে, এই টাকাটা কীভাবে কাটা হবে।” ২০২০-২০২১ অর্থবছরে বাংলাদেশের সড়ক ও মহাসড়ক রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের জন্য বরাদ্দ রয়েছে ২ হাজার ৬৮৭ কোটি টাকা। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুসারে, দেশটিতে মোট তালিকাভুক্ত মোটরযান রয়েছে ৪৭ লাখ ৮০ হাজার। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এসব যানে প্রতিদিন ৫২ লাখ লিটারের বেশি জ্বালানি তেল আর ১৩ কোটি ৯০ লাখ ঘনমিটার সিএনজি ব্যবহৃত হয়। লিটার বা ইউনিট প্রতি এক টাকা হিসাবে প্রতিদিন আয় হবে প্রায় সাড়ে ১৪ কোটি টাকা, বছরে প্রায় পাঁচ হাজার ২৬৩ কোটি টাকা।
কর্মকর্তারা জানাচ্ছেন, বিশ্বের অনেক দেশে সড়ক বা মহাসড়ক রক্ষণাবেক্ষণে এভাবে জ্বালানির মূল্য থেকে খরচ সংগ্রহ করা হয়। সেসব উদাহরণ দেখেই কর্মকর্তারা বাংলাদেশে এইরকম একটি ব্যবস্থা চালুর প্রস্তাব করেছেন। বিধিমালা অনুসারে, বিভিন্ন খাত থেকে যে অর্থ সংগ্রহ করা হবে, তা সড়ক ও মহাসড়ক মেরামতের বাইরে কর্মীদের বেতন-ভাতা দেয়া এবং অফিস খরচের জন্যও ব্যয় করা হবে।
পরিবহন বিশেষজ্ঞ মোঃ শামসুল হক বলছেন, রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতে সরকারি যে বরাদ্দ থাকে, তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। এ কারণে নিজস্ব উৎস থেকে অর্থ সংগ্রহের তহবিল থাকলে তা সবার জন্যই ভালো। ”তবে আমি পরামর্শ দেবো, শুরুতেই যেন জনগণের ওপর চাপ তৈরি করা না হয়। প্রথমে অন্তত তহবিলটি যাত্রা শুরু করুক, টোল, সারচার্জ, বিআরটিএ-র লাইসেন্স, রেজিস্ট্রেশন ইত্যাদির টাকা দিয়ে কাজ শুরু করুক। তারপর জনগণ যদি সুফল দেখতে পায়, তখন ভালো সড়কের জন্য বাড়তি অর্থ দিতেও আপত্তি করবে না।” ”এটা সত্যি, বিশ্বের অনেক দেশে জ্বালানি তেল থেকে সড়ক রক্ষণাবেক্ষণে ফি ধরা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে শুরুতেই সেটা করা ঠিক হবে না। সেটা হয়তো জনগণের জন্য বাড়তি বোঝার মতো হয়ে যাবে,” তিনি বলছেন।
আরও যেসব খাত থেকে অর্থ আদায়ের প্রস্তাব: জ্বালানি তেল বা গ্যাসের মূল্যের বাইরে আরও কয়েকটি খাত থেকে সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতে অর্থ আদায়ের প্রস্তাব করেছে তহবিল বোর্ড।
ড্রাইভিং লাইসেন্স, মোটরযান রেজিস্ট্রেশন ফি, ওভারলোডিং ও অন্যান্য জরিমানা, মোটরযানের সিসি, ধরণ ও ব্যবহার থেকে আরোপিত চার্জ, অধিদপ্তরের পরিদর্শন বাংলো, সরঞ্জাম থেকে পাওয়া অর্থ, রোড কাটিং বাবদ অর্থ, অনুদান- উৎস হিসাবে এগুলোর কথা প্রস্তাব করা হয়েছে। কিন্তু অনুমোদিত হলে সরকারের আয়ের প্রধান উৎস হবে জ্বালানি তেল ও গ্যাস থেকে পাওয়া অর্থ। মি. মালেক আরও জানিয়েছেন, এক্সপ্রেসওয়েগুলো ব্যবহারের ক্ষেত্রেও একটি বিশেষ টোল আদায়ের কথাও ভাবা হচ্ছে, যদিও এখনো সেরকম কোন সিদ্ধান্ত হয়নি। অধ্যাপক শামসুল হক বলছেন, ”শুরুতে ভাবা হয়েছিল যে, যেকোনো স্থাপনা নির্মাণের সময় মোট ব্যয়ের দুই শতাংশ সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ খাতে ধরতে হবে। তহবিল গঠনের ক্ষেত্রে সেটাও বিবেচনা করা যায়।” তিনি পরামর্শ দিচ্ছেন, সড়ক নির্মাণ চোখে পড়লেও রক্ষণাবেক্ষণ সবসময় দৃশ্যমান হয় না। যেহেতু এই তহবিলের আকার অনেক বড় হবে, সেখানে যেন কোন অনিয়ম বা দুর্নীতির ঘটনা না ঘটে, সেটিকেও সতর্কতার সঙ্গে ব্যবস্থা নিতে হবে।