নতুন বছরেও স্বস্তি নেই। করোনাভাইরাসের নতুন ধরন অমিক্রনের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বে। বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন বয়সের মানুষ সংক্রমিত হচ্ছেন এ ভাইরাসে। তবে এর মধ্যেও কিছু মানুষ তুলনামূলক স্বস্তিতে রয়েছেন। সংক্রমিত হওয়ার যথেষ্ট ঝুঁকি থাকার পরও কিছু মানুষ আছেন, যাঁরা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছেন না। আর তাঁদের নিয়েই এবার গবেষণা শুরু করেছেন গবেষকেরা। খবর সিএনবিসির। ধরা যাক, স্বামী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। স্ত্রী সার্বক্ষণিক তাঁর পাশে থেকেও দিব্যি সুস্থ রয়েছেন। আবার এমন দম্পতি আছেন, স্বামী কঠোর আইসোলেশন মেনে চলেছেন, স্ত্রী ধারেকাছেও যাননি, তারপরও করোনায় সংক্রমিত হয়েছেন। কর্মস্থলে মাস্ক, স্যানিটাইজারের মতো সব স্বাস্থ্যবিধি মেনেও অনেক কর্মী একাধিকবার করোনায় সংক্রমিত হয়েছেন। আবার স্বাস্থ্যবিধির তোয়াক্কা না করেও কিছু কর্মী সুস্থ রয়েছেন। চারপাশের অনেকেই করোনায় আক্রান্ত হলেও তাঁদের মাঝে থেকেও দিব্যি সুস্থ আছেন তাঁরা।
গবেষকেরা বলছেন, এর পেছনে বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে। শরীরে রোগ প্রতিরোধী বিশেষ কোষ, বিশেষ জিন বেশি থাকা বা একই ধরনের ভাইরাসে যাঁরা আগে সংক্রমিত হয়েছেন, তাঁদের কাবু করতে পারে না করোনাভাইরাস। তবে গবেষণার এ পর্যায়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিতে নারাজ গবেষকেরা। এ ধরনের ব্যক্তিদের নিয়ে আরও গবেষণা চালাচ্ছেন সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞরা।
‘টি সেল’ বেশি থাকা: ইমপিরিয়াল কলেজ লন্ডনের রোগ প্রতিরোধবিজ্ঞান-বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ড্যানি অল্টম্যান সিএনবিসিকে বলেন, যাঁদের শরীরে টি সেলের (রোগ প্রতিরোধক্ষমতাসম্পন্ন একধরনের কোষ) মাত্রা বেশি থাকে, তাঁদের করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি কম থাকে।
ইমপিরিয়ালসের ন্যাশনাল হার্ট ও লাংস ইনস্টিটিউটের গবেষক রিয়া কু-ু বলেন, ‘করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংস্পর্শে এলে সবাই করোনায় আক্রান্ত হন না। কেন এমনটা হয়, আমরা তা বোঝার চেষ্টা করছি।’ তিনি বলেন, দেখা গেছে, ঠান্ডা-সর্দিতে আক্রান্ত হওয়ার কারণে আগে থেকেই শরীরে উচ্চমাত্রায় টি সেল থাকলে করোনার সংক্রমণ রোধ করা সম্ভব।
কু-ু আরও বলেন, করোনা থেকে কিছু ব্যক্তির সুরক্ষিত থাকার পেছনে এটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি কারণ। তবে সুরক্ষা পেতে এটিই একমাত্র কারণ নয়। এমনটা ভাবার সময় এখনো আসেনি যে যাঁরা সর্দি-জ্বরে বেশি আক্রান্ত হন বা যাঁদের টি সেল বেশি, তাঁদের করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমে যায়। করোনা থেকে সুরক্ষা পাওয়ার উপায় হলো দুই ডোজ ও বুস্টার টিকা নেওয়া।
ওয়ারউইক বিশ্ববিদ্যালয়ের মলিকিউলার অনকোলজি বিভাগের শিক্ষক স্কট গটলিয়েব লরেন্স ইয়ং গত বুধবার সিএনবিসিকে বলেন, করোনার অমিক্রন ধরনে একবার আক্রান্ত হওয়ার পর প্রতিরোধক্ষমতা খুব বেশি দিন কার্যকর থাকবে না। তবে যাঁরা পরিবার ও কর্মক্ষেত্রে বারবার করোনায় সংক্রমিতের সংস্পর্শে এসেছেন অথচ কখনোই করোনায় আক্রান্ত হননি, এমন ব্যক্তিদের নিয়ে গবেষণা চলছে। তাঁদের মধ্যে হয়তো ২০ শতাংশের সাধারণ সর্দি-জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার কারণে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা তৈরি হয়েছে। তবে করোনায় সংক্রমিত ব্যক্তিদের মধ্যে থেকেও সংক্রমিত না হওয়ার পেছনে টিকার বড় ভূমিকা রয়েছে।
টিকার ভূমিকা: করোনার দুই ডোজ টিকা ও বুস্টার ডোজে হাসপাতালে গুরুতর অসুস্থতা ও মৃত্যু ঠেকানো সম্ভব। তবে টিকা করোনার সংক্রমণ থেকে ১০০ শতাংশ সুরক্ষা দেয় না।
কার্ডিফ ইউনিভার্সিটি মেডিকেল স্কুলের সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ অ্যান্ড্রু ফ্রিডম্যান সিএনবিসিকে জানান, কিছু ব্যক্তির করোনায় আক্রান্ত হওয়া বা না হওয়ার বিষয়টি টিকা নেওয়া বা আগে করোনায় সংক্রমিত হওয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত। তিনি বলেন, ‘আমরা জানি, অনেকে দুই ডোজ টিকা ও বুস্টার ডোজ নেওয়ার পরও অমিক্রনে সংক্রমিত হচ্ছেন। তবে তারপরও এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে টিকা এ ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে।’ ওয়ারউইক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইয়ং অবশ্য বলছেন, সাধারণ সর্দি-জ্বরের কারণে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা ও টিকা থেকে পাওয়া সুরক্ষা দুই মিলে কিছু মানুষের করোনায় আবার সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি কমে যায়।
বিশেষ জিনের প্রভাব: করোনার সংক্রমণ রোধে জিনগত বিষয়গুলোও ভূমিকা রাখতে পারে। ধরা যাক, দুজন ব্যক্তি করোনায় সংক্রমিত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে একজনের অনেক বেশি উপসর্গ থাকতে পারে। আবার একজন উপসর্গবিহীন হতে পারেন। জিনের বৈশিষ্ট্যের কারণে এমনটা ঘটতে পারে।
ইমপিরিয়াল কলেজের অল্টম্যান গত বুধবার সিএনবিসিকে বলেন, ইমিউনোজেনেটিকস নিয়ে তাঁদের গবেষণা শিগগির প্রকাশিত হবে। জিন ও রোগ প্রতিরোধক্ষমতা নিয়ে সম্পর্কের ওপর এ গবেষণা পরিচালিত হবে। এ সম্পর্কের ওপরে উপসর্গ নিয়ে করোনা বা উপসর্গবিহীন করোনার বিষয়টি নির্ভর করে। ওই গবেষণায় এইচএলএ (মানবশরীরের শ্বেতকণিকার অ্যান্টিজেন) জিনের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। এ জিনের সঙ্গে উপসর্গযুক্ত বা উপসর্গবিহীন করোনায় আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি জড়িত। অল্টম্যান আরও বলেন, এইচএলএ-ডিআরবিওয়ান ১৩০২ জিন বেশি থাকলে উপসর্গজনিত করোনা রোগ হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে।
যেভাবে গবেষণা: ইমপিরিয়াল ও বেশ কয়েকটি গবেষণা সংস্থা ৩৬ জনের ওপর গবেষণা পরিচালনা করেছে। এই ৩৬ জনকে করোনাভাইরাসের সংস্পর্শে আনা হয়েছে। তবে তাঁদের মধ্যে অর্ধেক করোনায় সংক্রমিত হয়েছেন। গবেষণায় অংশ নেওয়া ৩৬ জনের নাকে অল্প পরিমাণে করোনাভাইরাস ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। এরপর দুই সপ্তাহ ধরে তাঁদের নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেন চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা। দুই সপ্তাহের মধ্যে ১৮ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হন। ১৬ জনের মধ্যে মৃদু উপসর্গ দেখা দেয়। এর মধ্যে ছিল সর্দি, কাশি ও গলাব্যথা। এই ১৮ জনের মধ্যে গড়ে ৪২ ঘণ্টার মধ্যে এসব উপসর্গ দেখা দেয়। কয়েকজনের মধ্যে পাঁচ দিন ধরে করোনার জীবাণু দেখা গেছে। কয়েকজনের মধ্যে ৯ দিন ধরে করোনার জীবাণু পাওয়া গেছে। আবার কয়েকজনের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ১২ দিন পর্যন্ত করোনার জীবাণু পাওয়া গেছে। নাক দিয়ে ভাইরাস ঢোকানোর পর ৪০ ঘণ্টার মধ্যে গলায় বেশি ভাইরাস পাওয়া গেছে। সংস্পর্শে আসার পরও বাকি যাঁদের করোনাভাইরাস হয়নি, তাঁদের নিয়ে আলাদাভাবে গবেষণা চালিয়ে ভিন্ন ভিন্ন কারণ খুঁজে পান গবেষকেরা।- প্রথম আলো