করোনার নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলায় বড় ব্যবসায়ীরা প্রণোদনার ঋণ পেলেও এই ঋণের জটিলতা থেকে এখনও রেহাই পাননি ছোট উদ্যোক্তারা। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং-সানেম’র এক জরিপের তথ্য বলছে, জরিপ করা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ৭৪ শতাংশই প্রণোদনা পায়নিÍপেয়েছে মাত্র ২৩ শতাংশ। এদিকে বড় গ্রাহকদের বেআইনি কর্মকা-ের মাধ্যমে সহায়তা দিতে গিয়ে ফেঁসে গেছে ব্যাংকগুলো। ২০২১ সালের মার্চ, জুন, সেপ্টেম্বর ও ডিসেম্বর ত্রৈমাসিকের ভর্তুকির টাকাও পাচ্ছে না ব্যাংকগুলো।
ভর্তুকি না পাওয়ার কারণ:ব্যাংক খাতের অনেকেই বলছেন, প্রণোদনার ঋণে ছয়-নয় হওয়ার কারণে ভর্তুকির টাকা আটকা পড়েছে। এর আগে প্রণোদনার ঋণের অপব্যবহার খতিয়ে দেখতে একাধিকবার পরিদর্শন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একাধিক বিশেষ পরিদর্শন প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, এ খাতের অনেক টাকা কোথায় ও কীভাবে নেওয়া হয়েছে, এর কোনও হদিস মিলছে না। প্রতিবেদনে বলা হয়, এছাড়া প্রণোদনার ঋণ মূল হিসাব থেকে ৪/৫ দফা স্থানান্তরের পর নগদ আকারে তুলে নেওয়ার ঘটনাও আছে। এসব অর্থ অন্যের নামে পে-অর্ডার করে স্থানান্তর হয়েছে। বেশ কিছু শিল্প প্রতিষ্ঠান বড় জালিয়াতি করেছে। তারা শর্ত ভঙ্গ করে কম সুদে ঋণ নিয়ে বেশি সুদের ঋণ পরিশোধ করেছে।
প্রসঙ্গত, ভর্তুকির টাকা ছাড় করার আগে প্রণোদনার ঋণের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত হওয়ার শর্ত দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে প্রতিটি ব্যাংকের ঋণের অন্তত ১০ শতাংশ যাচাই করে তা পাঠাতে হয় মন্ত্রণালয়ে। যাচাই প্রতিবেদনে যে ব্যাংকের যে পরিমাণ ঋণের অপব্যবহারের তথ্য মিলবে, তার সমপরিমাণ সুদ ভর্তুকি দেবে না সরকার। ঋণের সদ্ব্যবহার যাচাই করতে গিয়ে নানা অসঙ্গতি পাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। অনেক ক্ষেত্রে প্রণোদনার ঋণ নিয়ে আগের ঋণ সমন্বয়ের তথ্য মিলেছে। কেউ কেউ প্রণোদনার টাকা নগদে তুলে জমি কেনা বা অন্য কাজে লাগিয়েছেন। বড় গ্রাহককে মাঝারি শিল্প হিসেবে প্রণোদনার ঋণ দেওয়া হয়েছে। এমন অনিয়মের কারণে কোনও ব্যাংকই গত বছরের ভর্তুকি পায়নি।
সমস্যার নেপথ্যে রয়েছে সিএমএসএমই খাত: বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনার আলোকে গ্রাহক পর্যায়ে চার শতাংশ সুদে অতিক্ষুদ্র, কুটির ক্ষুদ্র ও মাঝারি বা সিএমএসএমই খাতে প্রণোদনার ঋণ দিচ্ছে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান। বাকি পাঁচ শতাংশ প্রতি তিন মাস অন্তর সরকার থেকে ভর্তুকি দেওয়ার কথা। তবে ২০২১ সালের মার্চ, জুন, সেপ্টেম্বর ও ডিসেম্বর ত্রৈমাসিকের ভর্তুকির টাকা পায়নি কোনও ব্যাংক। কবে নাগাদ এ ভর্তুকি মিলবে, তা নিশ্চিত নয়। এদিকে ভর্তুকি না পাওয়ার কারণে ২০২১ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন চূড়ান্ত করার সময় চলে এলেও আয় দেখানো নিয়েও সমস্যায় রয়েছে ব্যাংকগুলো। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে আশ্বস্ত করা হয়েছে যে যাচাই প্রক্রিয়া শেষে প্রতিবেদন পেলেই অর্থ ছাড় করা হবে।
উল্লেখ্য, প্রতিটি ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদন চূড়ান্ত করার আগে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পরিদর্শন করে একটি দ্রুত সংক্ষিপ্ত প্রতিবেদন দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। ২০২১ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনের ওপর এখন পরিদর্শন কাজ চলছে। মূলত, করোনার ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবিলায় সিএমএসএমই খাতে ভর্তুকি সুদে ২০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে সরকার। তিন বছর ধরে এই তহবিল থেকে এ পরিমাণ অর্থের বিপরীতে ৫ শতাংশ হারে ভর্তুকি দেবে সরকার। তবে এ তহবিল থেকে ঋণ বিতরণে সাড়া কম। গত অর্থবছরে ২০ হাজার কোটি টাকার মধ্যে বিতরণ হয়েছে ১৫ হাজার ৩৮৭ কোটি টাকা বা ৭৬ দশমিক ৯৩ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে ঋণ বিতরণে আরও ধীরগতি দেখা দিয়েছে। গত জুলাই থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত বিতরণ হয়েছে মাত্র পাঁচ হাজার ৯৬০ কোটি টাকা, যা ২৯ দশমিক ৮০ শতাংশ।
ব্যাংক কর্মকর্তারা যা বলছেন:বেসরকারি খাতের বেশ কয়েকটি ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তারা জানান, অনেক ব্যাংক এমনিতেই ছোট ঋণ বিতরণে অনীহা দেখাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে ভর্তুকির টাকা পেতে দেরি হলে ছোট ব্যবসায়ীদের ঋণ দেওয়ার ব্যাপারে ব্যাংকগুলোর অনীহা আরও বাড়বে। তারা বলেছেন, আমানত সংগ্রহে তাদের গড় খরচ হচ্ছে ৪ শতাংশের বেশি। এর সঙ্গে তাদের অন্যান্য খরচ যোগ হয়ে তহবিল ব্যবস্থাপনা খরচের হিসাব হয়। এছাড়া ছোট ঋণে এমনিতেই তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় বেশি। রাষ্ট্রীয় মালিকানার অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শামস-উল ইসলাম বলেছেন, প্রক্রিয়া শেষ করে ভর্তুকির টাকা পেতে একটু দেরি হচ্ছে। তবে এই টাকা নিশ্চিতভাবে পাওয়া যাবে।
গবেষণা যা বলছে: গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) এক জরিপে দেখা গেছে, ৯ শতাংশের মতো ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠান প্রণোদনা ঋণ পেয়েছে। জরিপের একটি বড় অংশ ছিল কোভিড মোকাবিলায় ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের কার্যকারিতা নিয়ে। এতে বলা হয়, জরিপ করা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ৭৪ শতাংশ প্রণোদনা পায়নিÍপেয়েছে মাত্র ২৩ শতাংশ। প্রণোদনা পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসা পুনরুদ্ধারের হার ৭১ শতাংশ, আর প্রণোদনা না পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর পুনরুদ্ধারের হার ৫৮ শতাংশ। আবার যে প্রতিষ্ঠানগুলো প্রণোদনা পেয়েছে, তাদের মধ্যে ৪০ শতাংশ জানিয়েছে, এই প্যাকেজ তাদের জন্য যথেষ্ট নয়। ৬৫ শতাংশ প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, সরকারের পক্ষ থেকে আরও সাহায্য দরকার। সরকারের পক্ষ থেকে কী ধরনের সহায়তা দরকার, এমন প্রশ্নের জবাবে প্রতিষ্ঠানগুলো বলেছে, স্বল্প সুদে কার্যকরী পুঁজির ঋণ, রফতানিকারকদের জন্য শিপমেন্ট-পূর্ববর্তী পুনঃঅর্থায়ন সুবিধা ও শ্রমিকদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি। ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রণোদনা পাওয়ার ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকার কারণ সম্পর্কে সানেম-এর নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, ‘বড় ও সংগঠিত খাতের সংগঠন শক্তিশালী। তারা সরকারের সঙ্গে দরকষাকষি করতে পারে। সে জন্য সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে তারা এগিয়ে থাকে। তবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাত অতটা সংগঠিত নয় বলে সুযোগ-সুবিধা আদায়ে তারা পিছিয়ে থাকে।’- বাংলাট্রিবিউন