বাঙালি জাতির জীবনে আজ এক গৌরবোজ্জ্বল দিন মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। আজ থেকে ৭০ বছর আগে মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য জীবন উৎসর্গ করার অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন বাংলা মায়ের অকুতোভয় সন্তানেরা। এই অনন্য ইতিহাসকে স্বীকৃতি দিয়ে ইউনেসকো ১৯৯৯ সালে দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। সেই থেকে বাঙালির আত্ম-অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের দিনটি সারা বিশ্বেই পালিত হয়ে আসছে।
পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকেরা যখন অন্যায়ভাবে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাঙালির ওপরে চাপিয়ে দিতে উদ্যত হয়েছিল, তখন সারা পূর্ব বাংলা ফুঁসে উঠেছিল প্রতিবাদে, বিক্ষোভে। ১৯৫২ সালে সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মিছিল করে এগিয়ে যেতে থাকলে তাঁদের ওপর গুলি চালানো হয়। সালাম, বরকত, রফিক, শফিক, জব্বারসহ অনেকে নিহত হন। আজ সেই বীর শহীদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করতে রাজধানীসহ সারা দেশের শহীদ মিনারে প্রভাতফেরি নিয়ে যাবেন আবালবৃদ্ধবনিতা। কণ্ঠে থাকবে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি…।’ মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শহীদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করে পৃথক বাণী দিয়েছেন। দিবসটি উপলক্ষে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন দিনভর বিভিন্ন কর্মসূচির আয়োজন করেছে।
মহান শহীদ দিবস উপলক্ষে আওয়ামী লীগের কর্মসূচি : অমর একুশে ফেব্রুয়ারি মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করেছে আওয়ামী লীগ। যথাযথভাবে স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিধি মেনে মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের সকল কর্মসূচি পালন তরবে দলটি।
প্রিয় মাতৃভাষার মর্যাদা-অধিকার রক্ষা, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্ভাসিত অগণিত শহীদের রক্তে রঞ্জিত দিবসটি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সমগ্র বাঙালি জাতির সাথে বরাবরের মতো এবারও শ্রদ্ধাবনতচিত্তে স্মরণ ও পালন করবে।
কর্মসূচির মধ্য রয়েছে, একুশে ফেব্রুয়ারি ভোর সাড়ে ৬ টায় সংগঠনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়, বঙ্গবন্ধু ভবনসহ সারাদেশে সংগঠনের সকল শাখা কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা অর্ধনমিতকরণ ও কালো পতাকা উত্তোলন। সকাল ৭ টায় কালো ব্যাজ ধারণ, প্রভাতফেরী সহকারে আজিমপুর কবরস্থানে ভাষা শহীদদের কবরে ও কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ ও শ্রদ্ধা নিবেদন।
এছাড়াও ২২ফেব্রুয়ারি বিকেল সাড়ে ৩ টায় দলের পক্ষথেকে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউস্থ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এই আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। সভায় সভাপতিত্ব করবেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সভায় যুক্ত হয়ে তিনি গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখবেন।
দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এক বিবৃতিতে ২১ ফেব্রুয়ারি মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের সকল কর্মসূচি যথাযথভাবে স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিধি মেনে পালনের জন্য আওয়ামী লীগ এবং সহযোগী সংগঠনসমূহের সর্বস্তরেরনেতাকর্মীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
মহান শহীদ দিবস উপলক্ষে বিএনপির দুই দিনের কর্মসূচি: একুশে ফেব্রুয়ারি মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে দুই দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। গত বৃহস্পতিবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী এই কর্মসূচি ঘোষণা করেন। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে ২০ ফেব্রুয়ারি বিএনপির পক্ষ থেকে আলোচনা সভা। এছাড়া ২১ ফেব্রুয়ারি সকাল ৬টায় নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা অর্ধনমিতকরণ এবং কালো পতাকা উত্তোলন করা হবে। এছাড়া রয়েছে সকাল ৬টায় কালো ব্যাজ সহকারে রাজধানীর বলাকা সিনেমা হলের সামনে দলের নেতা-কর্মীদের জমায়েত ও আজিমপুর কবরস্থানে ভাষা শহীদদের মাজার জিয়ারত শেষে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার অভিমুখে যাত্রা। কেন্দ্রের পাশাপাশি সারাদেশে দলের জেলা ও উপজেলা কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা অর্ধনমিতকরণ ও কালো পতাকা উত্তোলন করা হবে। স্থানীয় সময় ভাষা শহীদদের স্মরণে আলোচনা সভা আয়োজন করা হবে।
এই কর্মসূচি সফল করতে দলের সকল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন রিজভী। এ সময় উপস্থিত ছিলেন – বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবুল খায়ের ভূঁইয়া, যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন, স্বেচ্ছাসেবক বিষয়ক সম্পাদক মীর সরাফত আলী সপু, সহ-দফতর সম্পাদক মুনির হোসেন ও তাইফুল ইসলাম টিপু প্রমুখ।
জামায়াতের আহ্বান: ২১ ফেব্রুয়ারি যথাযোগ্য মর্যাদায় ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ও মহান শহীদ দিবস’ পালনের জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা: শফিকুর রহমান। গত শনিবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ও মহান শহীদ দিবস উপলক্ষে দেয়া এক বিবৃতির মাধ্যমে তিনি এ আহ্বান জানান। ডা: শফিকুর রহমান বলেন, ১৯৫২ সালে আমাদের তরুণ, ছাত্র ও যুব সমাজ বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য তদানীন্তন শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। আন্দোলন দমনের জন্য সেদিন রাষ্ট্রের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মিছিলকারীদের উপর নির্বিচারে গুলি চালায়। সেই গুলিতে প্রাণ হারিয়েছিলেন দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসহ আরো অনেকেই। বাংলা ভাষার জন্য এ আত্মত্যাগের কারণে দেশের মানুষ তাদেরকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে। আমি মহান আল্লাহর কাছে তাদের রূহের মাগফেরাত কামনা করছি।
২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা লাভ করেছে। এটা ভাষা শহীদদের প্রতি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। বাংলা ভাষাকে যথাযোগ্য মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করার জন্য দেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করে বিজাতীয় শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন থেকে বাংলা ভাষাকে রক্ষা করতে হবে। তাহলেই ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্বপ্ন সার্থক হবে। তিনি বলেন, আমরা আজ এমন এক সময় ভাষা দিবস পালন করতে যাচ্ছি যখন দেশে গণতন্ত্র, আইনের শাসন, মানবাধিকার, ভোটাধিকার ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা বলতে কিছু নেই। অন্যায়ের বিরুদ্ধে দেশের মানুষের কথা বলার কোনো অধিকার নেই। সকল ক্ষেত্রেই শাসকগোষ্ঠীর অগণতান্ত্রিক আচরণের বহিঃপ্রকাশ ঘটছে। এ শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি থেকে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমে দেশ ও জাতিকে উদ্ধার করতে হবে। ২১ ফেব্রুয়ারি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ও মহান শহীদ দিবস’ যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করার জন্য আমি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সকল শাখা ও দেশবাসীর প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি।’ প্রেস বিজ্ঞপ্তি
২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনারে ৬ স্তরের নিরাপত্তা থাকবে : আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ছয় স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকবে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম।গত শনিবার বেলা সাড়ে ১১টায় সাংবাদিকদের তিনি এ তথ্য জানান।
ডিএমপি কমিশনার বলেন, শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণের জন্য নিরাপত্তার কোনো ঘাটতি থাকবে না। ইউনিফর্ম পরিহিত পুলিশের পাশাপাশি সাদা পোশাকের পুলিশ, বোম ডিসপোজাল ইউনিট, ডিবি, র্যাব ও সোয়াটের টিম থাকবে। ছয় স্তরের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা করা হয়েছে। তিনি বলেন, শহীদ মিনার কেন্দ্রীক চারিদিকে যে রাস্তা রয়েছে তার প্রত্যেকটিতে পুলিশের চেকপোস্ট থাকবে। চেকপোস্টের বাইরের এলাকা ও ভেতরের এলাকায় সিসিটিভি ক্যামেরা থাকবে।
শফিকুল ইসলাম বলেন, স্বাস্থ্যবিধিগুলো মানার ক্ষেত্রে সরকারঘোষিত এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের যেসব নির্দেশনা রয়েছে তা সবাইকে মেনে চলার অনুরোধ করছি। পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ শেষে আপনি আপনার পরিবারের কাছেই ফিরে যাবেন। সুতরাং আপনার নিরাপত্তা ও আপনার পরিবারের নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালন করবেন।
তিনি বলেন, শ্রদ্ধা নিবেদনের সময় কেউ কোনো ধরনের ব্যাগ বহন করতে পারবে না। নিজের মোবাইল ফোন ব্যবহারের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে। কারণ প্রতিবছর এই শহীদ মিনার এলাকা থেকে প্রচুর মোবাইল ফোন চুরি হয়। শত শত মানুষ লাইনে থাকে। এতে করে মোবাইল চুরির বিষয়টি ধরা আমাদের পক্ষে কঠিন হয়ে যায়। ‘সোয়াট টিম, বোম ডিসপোজাল ইউনিট ও ডগ স্কোয়াড দিয়ে পুরো এলাকা তল্লাশি করা হবে। আমাদের পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) থেকেও বিশেষ তল্লাশি করা হবে।’ যোগ করেন ডিএমপি কমিশনার। কোনো রাজনৈতিক ব্যানার-ফেস্টুনে যাতে এলাকা নোংরা না হয় সেজন্য সবাইকে অনুরোধ করবো। আর যদি কেউ এসব ব্যানার-ফেস্টুন টানিয়ে থাকেন তাহলে ঢাবি ও ডিএমপি যৌথভাবে সেগুলো অপসারণ করবে। বিদেশি রাষ্ট্রদূত ও কূটনীতিকদের আলাদাভাবে শহীদ মিনারে আনা হবে বলেও জানান তিনি।