শনিবার, ১৮ মে ২০২৪, ০৪:৫১ অপরাহ্ন

সড়ক যোগাযোগ অবকাঠামোর উন্নয়নে বিনিয়োগের সুফল দৃশ্যমান নয়

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ২২ ফেব্রুয়ারী, ২০২২

দেশের সড়ক যোগাযোগ অবকাঠামোর উন্নয়নে বিনিয়োগের সুফল দৃশ্যমান নয়। সড়ক খাতের উন্নয়ন দর্শনকেই এ খাতের যাবতীয় বিড়ম্বনার উৎস হিসেবে দেখছেন বিশেজ্ঞরা। তারা বলছেন, যোগাযোগ অবকাঠামোর উন্নয়নে বিনিয়োগ হচ্ছে ঠিকই। কিন্তু সেগুলো পরিকল্পিত ও সমন্বিত হচ্ছে না। ফলে সেগুলো কার্যকর ও টেকসই হচ্ছে না। এসবের প্রভাবেই অনিরাপদ, বিশৃঙ্খল হয়ে উঠছে সড়ক। এক দশকে বিপুল বিনিয়োগ করা সত্ত্বেও দেশের সড়ক অবকাঠামো নিরাপদ ও স্বস্তিদায়ক না হওয়ায় সরকারের উন্নয়ন দর্শনেই ভুল দেখছেন পরিবহন বিশেষজ্ঞরা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. সামছুল হক বলেন, আমাদের কোনো উন্নয়নের দর্শনেই সড়ক নিরাপত্তাকে প্রাধান্য দেয়া হয় না। সড়ক দুর্ঘটনা কমিয়ে আনার ক্ষেত্রেও সুনির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্য নেই সরকারের। আমরা শুধু একের পর এক প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে দেখছি। সেগুলো কতটা কাজে লাগছে, তার মূল্যায়ন দেখছি না। বিপুল বিনিয়োগ করে তৈরি করা সড়ক অবকাঠামো নিরাপদ ও স্বস্তিদায়ক না হলে সেগুলোর নির্মাণকারী কর্তৃপক্ষকেও কারো কাছে জবাবদিহি করতে দেখছি না। পরিকল্পনা থেকে শুরু করে বাস্তবায়ন পর্যন্ত সবই করা হচ্ছে বিক্ষিপ্তভাবে। এতে আমাদের অবকাঠামো হচ্ছে ঠিকই। কিন্তু এগুলো টেকসই হচ্ছে না। ফলে বাড়ছে জনভোগান্তি ও দুর্ঘটনা। পাশাপাশি ভবিষ্যতে একটি ভারসাম্যপূর্ণ যোগাযোগ অবকাঠামো গড়ে তোলার যে সুযোগ, তাও নষ্ট করা হচ্ছে। দেশে সড়ক অবকাঠামো উন্নয়ন ও পরিবহন খাত তত্ত্বাবধান হয় সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের অধীনে। মন্ত্রণালয়ের দুটি বিভাগের ছয়টি সংস্থা, অধিদপ্তর ও করপোরেশনের মাধ্যমে ২০১১-১২ থেকে ২০২০-২১ অর্থবছর পর্যন্ত ১ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে সড়ক অবকাঠামো উন্নয়নে। বিনিয়োগ হওয়া অনেক অবকাঠামো যেমন এরই মধ্যে চালু হয়েছে, তেমনি বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোর নির্মাণকাজ এখনো চলমান বা শেষের পথে।
এ বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগও দেশের সড়ক চলাচলকে নিরাপদ করে তুলতে পারেনি। বরং এক দশকেরও কম এ সময়ের মধ্যে সড়কে দুর্ঘটনায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে দ্বিগুণে। বাংলাদেশ পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ৫ হাজার ৪৪ জনের, যেখানে ২০১২ সালে এ সংখ্যা ছিল আড়াই হাজার। অন্যদিকে চার-ছয় লেনের সড়ক, এক্সপ্রেসওয়ে, ফ্লাইওভারের মতো বৃহৎ অবকাঠামোগুলোও সড়ক যাতায়াতে মানুষের ভোগান্তি কমাতে পারেনি। বিলম্বিত করছে পণ্য পরিবহন। ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে যাত্রাবাড়ী থেকে মাওয়া পর্যন্ত যাতায়াতের সময় কমিয়েছে ঠিকই, কিন্তু এখনো যাত্রাবাড়ী থেকে ঢাকার বিভিন্ন গন্তব্যে যাত্রী দুর্ভোগ রয়ে গেছে আগের মতোই। এক দশক আগে ঢাকা-চট্টগ্রামের মধ্যে যাতায়াতে সময় লাগত ৬-৭ ঘণ্টা। চার লেনের সড়ক হওয়ার পরও অবস্থার খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। গাড়ির চাপ বাড়লে এখন ৬-৭ ঘণ্টারও বেশি সময় লেগে যায় মহাসড়কটি পাড়ি দিতে। একই অবস্থা চার লেন হওয়া ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কেরও। দেশের জাতীয়, আঞ্চলিক, জেলা কোনো সড়কেই স্বস্তিতে চলতে পারছে না মানুষ।
বিপুল ব্যয়ে নির্মিত সড়কগুলোও টেকসই হচ্ছে না। সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের ডিজাইন ম্যানুয়াল অনুযায়ী, নির্মাণের পর প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণের মধ্য দিয়ে একটি সড়ক ২০ বছর পর্যন্ত টেকসই হওয়ার কথা। কিন্তু নি¤œমানের নির্মাণকাজ ও উপকরণ ব্যবহার, নকশা ও পরিকল্পনার ত্রুটি-বিচ্যুতি, ভারী যানবাহন নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতাসহ বিভিন্ন কারণে এক-দেড় বছরের মাথায় নষ্ট হচ্ছে সড়ক। চলাচলের জন্য হয়ে উঠছে ঝুঁকিপূর্ণ। ভাঙাচোরা সড়কে যাতায়াতে যেমন বাড়তি সময় লাগছে, তেমনি বাড়ছে দুর্ঘটনার ঝুঁকিও। আবার সড়কের পাশে গড়ে ওঠা হাটবাজারও দুর্ঘটনা-যানজটের কারণ হচ্ছে। সওজ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, এখনো ভাঙাচোরা দশায় রয়েছে দেশের ৩ হাজার ৬৪৭ কিলোমিটার সড়ক। যেসব সড়ক ভালো আছে, সেগুলোর বিভিন্ন নকশা ও পরিকল্পনাগত ত্রুটি-বিচ্যুতি বাড়িয়ে দিচ্ছে সড়ক দুর্ঘটনার ঝুঁকি। সড়ক নিরাপত্তা ও যাতায়াতে স্বস্তির বিষয়টি নিশ্চিত করা সওজ অধিদপ্তরের একার পক্ষে সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করেছেন সংস্থাটির প্রধান প্রকৌশলী মনির হোসেন পাঠান। তিনি বলেন, সড়ক নিরাপত্তা শুধু একটি নির্দিষ্ট সংস্থার বিষয় নয়। এর সঙ্গে অনেকগুলো সংস্থা জড়িত। কোনো সংস্থা সড়ক নির্মাণ করে, কোনো সংস্থা সড়কের যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করে, আবার কোনো সংস্থা সড়ক ব্যবহারকারীদের নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব থাকে। সবক’টি সংস্থা যদি তাদের দায়িত্বগুলো যথাযথভাবে পালন করে, তাহলে অবশ্যই সড়ক অবকাঠামোকে নিরাপদ করে গড়ে তোলা সম্ভব। সওজ অধিদপ্তর নিজের দায়িত্বটুকু যথাযথভাবেই পালন করছে। দেশের পরিবহন খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। যদিও বাস্তবে তা নিয়ন্ত্রণ করছেন গুটিকয়েক পরিবহন মালিক-শ্রমিক নেতা। অভিযোগ রয়েছে, তাদের প্রভাবেই দেশের সড়কে-মহাসড়কে অবাধে চলছে আনফিট গাড়ি। বিআরটিএর হিসাবে, বর্তমানে দেশে আনফিট গাড়ির সংখ্যা ৫ লাখ ৮ হাজার (৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত)। অদক্ষ ও লাইসেন্সবিহীন চালকের সংখ্যাও কয়েক লাখ। কোথায় যাত্রী ও মালপত্র উঠবে-নামবে, কোথায় পার্কিং হবে তা দেশের আইনে নয়, ঠিক হয় পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের ইচ্ছায়। সরকার সড়ক পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে কঠোর সড়ক আইন (সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮) করলেও মালিক-শ্রমিকদের চাপে তা সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে। সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে শুরু করে জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিল কারো সুপারিশই ঠিকঠাক বাস্তবায়ন হয়নি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব কারণে দিন দিন আরো অনিরাপদ হয়ে উঠছে বাংলাদেশের সড়ক।
দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ধারাবাহিকভাবে বাড়লেও বিআরটিএর চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার বলছেন ২০৩০ সালে দুর্ঘটনার সংখ্যা অর্ধেকে নামিয়ে আনার লক্ষ্যের কথা। তিনি বলেন, ২০৩০ সালের মধ্যে আমরা দেশে সড়ক দুর্ঘটনা অর্ধেকে নামিয়ে আনার লক্ষ্যে একটি ন্যাশনাল রোড সেফটি স্ট্র্যাটেজিক অ্যাকশন প্ল্যান করছি। এর মাধ্যমে ধাপে ধাপে দুর্ঘটনার পরিমাণ কমিয়ে আনা হবে। এ কৌশলগত পরিকল্পনা তখনই বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে, যখন সড়কের সব ধরনের ব্যবহারকারী আরো দায়িত্বশীল ও আন্তরিক ভূমিকা রাখতে শুরু করবে। একইভাবে সড়কের নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা রক্ষায় বিআরটিএসহ দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিরলস কাজ করে যাচ্ছে।
বেসরকারি খাতের অব্যবস্থাপনায় দেশের সড়ক পরিবহন খাতে যাত্রী পরিবহনে সুনাম অর্জনের পাশাপাশি মুনাফাজনক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছিল বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশনের (বিআরটিসি) সামনে। কিন্তু সংস্থাটি যাত্রীসেবার মানের বদলে শুধু ঋণের বোঝাই বাড়িয়েছে। অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল শেষ হওয়ার আগেই অচল হয়ে পড়েছে সংস্থাটির শত শত বাস-ট্রাক, যেগুলো বিক্রি হচ্ছে ভাঙারি হিসেবে। গত এক দশকে নতুন বাস-ট্রাক কেনায় প্রায় ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করলেও বাড়েনি সংস্থাটির যাত্রীসেবার মান। দেশের সব বেসরকারি পরিবহন কোম্পানি যখন ভালো মুনাফা করছে, তখন সব সরকারি সুযোগ-সুবিধা নিয়েও বছর বছর লোকসান গুনছে বিআরটিসি। একই সঙ্গে ভারী হচ্ছে সংস্থাটির ঋণের বোঝাও। সর্বশেষ নিরীক্ষা প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ১ হাজার ৪৬০ কোটি টাকার দেশী-বিদেশী ঋণ রয়েছে বিআরটিসির।
যদিও সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা বলছেন, ক্রমবর্ধমান যানবাহন ও ট্রাফিকের উপযোগী করেই গড়ে তোলা হচ্ছে সড়ক অবকাঠামো। সড়কে নিরাপত্তা ও স্বস্তি দুটিই নিশ্চিত হতে শুরু করেছে।
দেশে যে হারে যানবাহন বেড়েছে, সে হার বিবেচনায় নিলে দুর্ঘটনা না বেড়ে উল্টো কমেছে বলে দাবি করেছেন সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ২০০৮ সালের দিকে বাংলাদেশে যানবাহনের সংখ্যা ছিল ৮-১০ লাখ। বর্তমানে তা প্রায় ৪৮ লাখে উন্নীত হয়েছে। ক্রমবর্ধমান যানবাহনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই কিন্তু আমরা এ সময়ে দেশের সড়ক অবকাঠামোর উন্নয়ন করেছি। দেশে গত এক যুগে যানবাহন বেড়েছে চার-পাঁচ গুণ। সে তুলনায় কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনা বাড়েনি; বরং কমেছে এবং সড়ক দুর্ঘটনার হার আরো কমিয়ে আনতে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ কাজ করে যাচ্ছে। একইভাবে আগের চেয়ে সড়কপথে যাতায়াতও স্বস্তিদায়ক হয়েছে উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, এরই মধ্যে যেসব সড়ক চার লেনে উন্নীত করা হয়েছে, সেগুলোয় অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে মানুষ অনেক বেশি স্বস্তিতে যাতায়াত করছে। গত এক দশকে বিনিয়োগ করা এমন প্রতিটি সড়ক অবকাঠামো থেকেই সুফল পাচ্ছে বাংলাদেশের মানুষ।
তবে পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, যাত্রাপথে কোনো ভোগান্তি হবে না। দুর্ঘটনার ঝুঁকি থাকবে কম। দেশে দেশে সড়ক অবকাঠামো বিনিয়োগের ক্ষেত্রে মূলত এ দুটি বিষয়কেই প্রাধান্য দেয়া হয়। গত এক দশকে বাংলাদেশও সড়ক পরিবহন খাতে বিপুল বিনিয়োগ করেছে। চার-ছয় লেনের নতুন সড়ক, এক্সপ্রেসওয়ে-সেতু-ফ্লাইওভারসহ জাতীয়, আঞ্চলিক ও জেলা মহাসড়ক উন্নয়নে বিনিয়োগ হয়েছে। বিনিয়োগ হয়েছে নগর-মহানগরের সড়ক অবকাঠামো উন্নয়নেও। চলমান রয়েছে পদ্মা সেতুসহ একাধিক মেগা প্রকল্প। যদিও এক দশকের বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ সড়কে নিরাপত্তা বা স্বস্তি কোনোটাই নিশ্চিত করতে পারেনি। উল্টো এ সময়ে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ। বেড়েছে যানজটও। এতে একদিকে বিলম্বিত হচ্ছে সাধারণ মানুষের ভ্রমণ, অন্যদিকে ক্ষত তৈরি হচ্ছে দেশের অর্থনীতিতে। পরিবহন খাতের অনিয়ম-বিশৃঙ্খলায়ও প্রতিনিয়ত নাজেহাল হচ্ছে মানুষ।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com