শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৫:৩৮ অপরাহ্ন

শেরপুরে পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুরোধে কাজ করছে আঁচল

জাহিদুল খান সৌরভ শেরপুর :
  • আপডেট সময় বুধবার, ১৬ মার্চ, ২০২২

আলিয়া আফরিন রিতু। বয়স হয়েছিল ১ বছর ৩ মাস। পুরোদিন বাড়ি মাতিয়ে রাখতো। বাড়ির উঠোনে বসে খেলতো। দৌড়াতো এদিক সেদিক। এই ফুটফুটে শিশুটি গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর পানিতে ডুবে মারা গেছে। সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দেওয়ার একপর্যায়ে গুমরে কেঁদে ওঠেন মা ফারজানা। তার কান্না উপস্থিত সবাইকে আবেগাপ্লুত করলেও সন্তান হারানোর বেদনা শুধু তার একার। শেরপুর জেলা সদর থেকে ১২-১৩ কিলোমিটারের পথ কামারিয়া ইউনিয়নের রঘুনাথপুর শোলারচর গ্রাম। এ গ্রামেই স্বামী সন্তান নিয়ে বসবাস করেন গৃহিনী ফারজানা। ঘটনার পুরো বিবরনে ফারজানা বলেন, সেদিন আমি বাড়ির বাইরে কাজে গিয়েছিলাম। বাচ্চাটারে ভাসুরের মাইয়্যার কাছে রাইখ্যা। কাম শেষ কইরা আইসা দেহি আমার মাইয়্যা কোথাও নাই। এদিক সেদিক খুইজা কোথাও মাইয়াডার খোঁজ পাইতেছিলাম না। পরে বাড়ির পাশে একটি নালা থাইক্যা ভাসমান অবস্থায় তার লাশ উদ্ধার করি আমি। আমার মাইয়্যাডা আটতে আটতে (হাঁটতে হাঁটতে)  পানিতে পইরা গেছিল। কেউ তারে দেহে নাই। আমি সতর্ক থাকলে এইডা হইতো না। অহন গেরামে আঁচল মা আছে। তারা গেরামের বেবাক পুলাপানগো দেহাশোনা করে। এহন তাদের বাপ, মায়েরা নিশ্চিন্ত মনে গৃহস্থালির কাম- কাজ সারতে পারে। পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যুতে, বাংলাদেশে প্রতিদিন ফারজানার মতো বহু মায়ের বুক খালি হচ্ছে। ২০১৬ সালে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অর্থায়নে দ্যা সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি) এবং আইসিডিডিআরবি পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে গড়ে প্রতিদিন ৪০ শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়। এদের মধ্যে ৩০ জন পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু।বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) এর হিসাব অনুযায়ী, প্রতি বছর পৃথিবীতে তিন লাখ ৫৯ হাজার মানুষ পানিতে ডুবে মারা যায়। এর ৯০ শতাংশই মারা যায় নি¤œ ও মধ্যেমআয়ের দেশগুলোতে। এদিকে ডব্লিউএইচওথর গ্লোবাল রিপোর্ট অন ড্রাউনিংয়ের তথ্য জানাচ্ছে, বাংলাদেশে ১ থেকে ৪ বছরের শিশু মৃত্যুর ক্ষেত্রে ৪৩ শতাংশই মারা যায় পানিতে ডুবে। তাই পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু রোধে ২০০৫ সাল থেকে বাংলাদেশে কাজ করছে বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি)। সিআইপিআরবি কর্তক ঝুঁকিপূর্ণ চার ঘণ্টা (সকাল ৯ টা থেকে ১ টা) পর্যন্ত একটি নির্দিষ্ট স্থানে শিশুদের রাখা ও  শিক্ষামূলক নানা কাজে অন্তর্ভুক্ত করার কর্মসূচির নাম ‘আঁচলথ। এটি ‘ক্রেচে ফর চাইল্ড হেলথ অ্যান্ড সেফটিথ ও ‘ভাসাথ প্রকল্পের আওতায় বাস্তবায়িত হচ্ছে। সিআইপিআরবি, স্বাস্থ্য অধিদফতর ও আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র (আইসিডিডিআরবির) সম্মিলিত গবেষণার ফাইন্ডিংসের (প্রাপ্তি) ওপর ভিত্তি করে ২০১৩ সালে ‘আঁচলথ কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়। শুরু হওয়ার পর পরবর্তী কয়েক বছরে ‘আঁচল’ সেন্টারের সংখ্যা ৩ হাজার ২০০ টিতে বাড়ানো হয়। এরই ধারাবাহিকতায় শেরপুর সদর উপজেলার কামারিয়া, ভাতশালা, লছমনপুর, চরমোচারিয়া, চরপক্ষিমারী, পাকুরিয়াসহ ৭ টি ইউনিয়নে পরিচালিত হচ্ছে ‘আঁচল’ কেন্দ্র। শেরপুর সদরের রঘুনাথপুর শোলারচর গ্রামের তালেবুল ইসলামের বাড়িতে রয়েছে একটি আঁচল কেন্দ্র। এ কেন্দ্রের আঁচল মায়ের নাম ইফানা আক্তার(৩৬)। তার সহকারীর নাম শাপলা খাতুন(২৫)। ইফানা আক্তার বলেন, আমি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একজন আঁচল মা। আমার একজন সহকারী আছে।
তার নাম শাপলা খাতুন। আমার আঁচল কেন্দ্রে ২২ জন শিশু রয়েছে। সকাল ৮ থেকে ৯ টার মধ্যে সহকারী শাপলা গ্রামের সব বাড়ি থেকে শিশুদের আঁচল কেন্দ্রে নিয়ে আসেন। আমরা দু’জনে মিলে সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত ৯ থেকে ৫৯ মাসের শিশুদের নিরাপদ রাখার চেষ্টা করি। এছাড়া শিশুদের আমরা ছড়াগানসহ প্রারম্ভিক বিকাশ ঘটাতে নানা কর্মকা- করি। যদি কোনো বাচ্চা না আসে, তবে আমার সহকারী বা আমি তাদের বাড়ি গিয়ে আনার চেষ্টা করি এবং খোঁজ খবর নেই। ইফানা আক্তার আরো বলেন, ২০১৩ সাল থেকে এই সেন্টারটি চলছে। গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর পানিতে যে শিশুটি মারা গেছে। তখন করোনার কারণে ‘আঁচল’ সেন্টার বন্ধ ছিল। আঁচল হওয়ার আগে এই গ্রামে বছরে দু-চারটি শিশু মারা যেতো। এখন সেই হার অনেক কমেছে। সরজমিনে আঁচল কেন্দ্রে দেখা গেছে, চারপাশে টিনের বেড়া, চালাও টিনের। মাটির মেঝেতে বিছানো শীতল পাটি। সুন্দর করে সাজানো পুরো ‘আঁচল’ ঘর। ঘরের চারকোনায় ঝুলছে রঙিন কাগজের ফুল। দেওয়ালে ব্যঞ্জন ও স্বরবর্ণের সরণি। এছাড়াও রয়েছে সংখ্যা, মাছ, পাখি, প্রাণী, ফলের ছবিসহ বাচ্চাদের আঁকা বিভিন্ন ছবি। রঘুনাথপুর শোলারচর গ্রাম থেকে পায়ে হেঁটে মাত্র কয়েক মিনিটের পথ। গ্রামের নাম হাজীপাড়া। সেখানে ইজ্জত সরদারের বাড়ির সামনে রয়েছে আরেকটি আঁচল কেন্দ্র। সেখানে যাওয়ার পথে কিছুটা দূর থেকেই কানে ভেসে আসে শিশুদের কোলাহল। এই সেন্টারের আঁচল মা নিপা। কোমলমতি শিশুদের নিয়ে আড্ডায় ব্যাস্ত তিনি। নিপার সঙ্গে অভিনয় করে ছড়া বলছে উপস্থিত শিশুরা। সংখ্যার সঙ্গে ‘আঁচলথ মা নিপা একটি শব্দ বললে। তা অভিনয় করে দেখায়- আলফি, নাজিয়া, কাওসার, মিনহাজ, তন্ময়, জুনাইদসহ অন্য শিশুরা। এ গ্রামের গৃহিণী জুলেখা বেগম বলেন, বাচ্চাটা ‘আঁচলে’ রাইখা আমার ম্যালা সুবিধা হইছে। এখন আমি সংসারের সব কাজ করবার পারি। গরু-বাছুর মাঠে চড়াতে নিতে পারি। বাচ্চাটা এহানে রাখলে আমরা কোনো চিন্তা অয় না। পাশের বাড়ির গৃহিণী নূরজাহান বলেন, ‘আমার তিনডা সন্তান। ছোট দুইডারে আঁচলে রাইখ্যা নিশ্চিন্তে কাজ করি। সেখানে গিয়ে ল্যাহাপড়াও শিখে, নিরাপদেও থাহে। গেরামে ‘আঁচল’ থাকাতে আমাগোর অনেক উপকার হইছে। এই গ্রামের কৃষক জালাল উদ্দিন বলেন, আঁচল মা পোলাপান গো দেখাশোনা করে। ওখানে আদর ও নিরাপদে থাহে। ডোবা, খালে, বিলে পানিতে যাইতে পারে না। তাই পানিতে পইরা শিশু মৃত্যুর ঝুঁকি কম। শেরপুর সদরের কামারিয়া ইউনিয়ন পরিষদের ৩নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মো.আব্দুল করিম  ঢাকা পোস্টকে জানান ‘আঁচল’ থাকায় গ্রামের দরিদ্র মানুষের অনেক উপকার হয়েছে। সংসারে মায়েরা যখন কাজ করে তখন তাদের বাচ্চাদের আঁচলে রাখা হয়। এতে বাচ্চারা নিরাপদে থাকে। এই ইউপি সদস্য আরো বলেন, বর্ষার সময় সব জায়গায় পানি থাকে। এই সেন্টারটি হওয়ার পর বাচ্চাদের পানিতে পড়ার ঝুঁকি কমে গেছে। মা- বাবা আঁচলে তাদের বাচ্চাদের রেখে নিশ্চিন্ত মনে পরিবারের অন্যানো কাজকর্ম করতে পারেন। সিআইপিআরবির প্রোগ্রাম ম্যানেজার মো. আল-আমিন ভুঁইয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, দুটি প্রকল্পের অধীনে এখন দেশের ছয়টি জেলায় ৩ হাজার ২০০ টি আঁচল সেন্টার বা কেন্দ্র রয়েছে। এসব কেন্দ্রে শিশুর সংখ্যা ৫৬ হাজার। পটুয়াখালী, বরগুনা, চাঁদপুর, নরসিংদী, সিরাজগঞ্জ ও শেরপুর জেলায় আঁচল কেন্দ্র রয়েছে। প্রতিটি কেন্দ্রে ৯ থেকে ৫৯ মাস বয়সী ২০ থেকে ২৫ জন করে শিশু রয়েছে। তিনি আরো বলেন, প্রতিটি কেন্দ্রে একজন প্রশিক্ষিত আঁচল মা ও একজন সহকারী থাকেন। আঁচল মা ও সহকারীকে পাঁচদিনের একটি ইনক্লুসিভ ট্রেনিং দেওয়া হয়। একটি প্রকল্পে আঁচল মা তিন হাজার টাকা ও সহকারী এক হাজার টাকা এবং অন্য প্রকল্পে আঁচল মা দুই হাজার ২০০ টাকা ও সহকারী ৭৫০ টাকা পান। আঁচল মাকে কমপক্ষে দশম শ্রেণি ও সহকারীকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া জানতে হয়।
পরিবারের অন্য সদস্যরা যে সময়টা কাজে ব্যস্ত থাকে অর্থাৎ সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত। সেসময় শিশুরা আঁচল কেন্দ্রে অবস্থান করে। তাই শিশুর পানির কাছে যাওয়া ও মৃত্যু ঝুঁকি অনেটাই কমে যায়। শেরপুর সদর উপজেলা সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন এন্ড রিসার্চ বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি) কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, শেরপুরের সাতটি উপজেলায় ৫৩২ টি আঁচল কেন্দ্র রয়েছে। গত ২০২০ ও ২০২১ সালে সাত উপজেলায় পাঁচ বছরের কম বয়সী ১২ জন শিশু পানিতে ডুবে এবং অন্যান্য কারণে মারা গেছে। বর্তমানে আঁচলের কারণে এসব এলাকায় পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর হার হ্রাস পেয়েছে।
বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা (সমষ্টির) গবেষনা ও যোগাযোগ পরিচালক মো.রেজাউল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের গবেষনায় দেখা গেছে, সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর হার সবচাইতে বেশি। কারণ এই সময়ে শিশুর মা-বাবা গৃহস্থালির কাজে ব্যাস্ত থাকে। সিআইপিআরবি কর্তক ঝুঁকিপূর্ণ চার ঘণ্টা (সকাল ৯ টা থেকে ১ টা) পর্যন্ত একটি নির্দিষ্ট স্থানে শিশুদের রাখা ও  শিক্ষামূলক নানা কাজে অন্তর্ভুক্ত করার কর্মসূচির নাম ‘আঁচলথ। এটি নিয়েও আমরা সরকারের সাথে কাজ করছি। যেন দেশের যেসব উপজেলা/ইউনিয়নে পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর হার বেশি। সেসব এলাকায় যেন বাধ্যতামূলক ‘আঁচল’ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়। শেরপুর সদর উপজেলা সিআইপিআরবি কার্যালয়ের সমন্বয়ক মো.আব্দুল্লাহ আল কাফি ঢাকা পোস্টকে বলেন, যেখানে আঁচল সেন্টার রয়েছে। সেখানে পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর হার অনেক কমে গেছে। একই সঙ্গে সেখানকার মা-বাবাও অনেক সচেতন হয়ে গেছেন। আঁচলে যে শিশুরা আছে, তারা যখন স্কুলে ভর্তি হয়। তখন প্রাইমারির শিক্ষকরা জিজ্ঞাসা করেন? আগে এই শিশু কোথায় পড়েছে ? তখন বাবা-মা উত্তরে জানান, কোনো স্কুলে যায়নি, আঁচলে গেছে। আমাদের সেন্টারে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাটা দেওয়া হয়। তাই তাদের ভীতিটা আর থাকে না। তাই অন্য যে কোনো শিশুর চেয়ে আঁচলের শিশু বেশি অ্যাডভান্স।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com