গত সাড়ে ছয় বছরে সরকারকে বিদ্যুতে ভর্তুকি বাবদ সাড়ে ৪৩ হাজার কোটি টাকা গুনতে হয়েছে। প্রতি মাসে ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসারগুলোর (আইপিপি) কাছ থেকে বিদ্যুৎ ক্রয় বাবদ গড়ে ২ হাজার কোটি টাকারও বেশি ভর্তুকি দিতে হচ্ছে সরকারকে। এরই মধ্যে চলতি অর্থবছরের সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরের জন্য আইপিপির ভর্তুকি বাবদ অর্থ বিভাগে ৪ হাজার কোটি টাকারও বেশি চাহিদা দিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ। তবে অর্থ বিভাগ এখন পর্যন্ত সে অর্থ ছাড় করতে পারেনি। বিদ্যুৎ ও অর্থ বিভাগের আশঙ্কা, চলতি অর্থবছরে আইপিপি বাবদ ভর্তুকির প্রয়োজন পড়বে ২০ হাজার কোটি টাকারও বেশি। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের বর্তমান ঊর্ধ্বগতি বজায় থাকলে এ ভর্তুকির পরিমাণ আরো বাড়তে পারে। এ বিপুল অংকের রাজস্ব ব্যয় করতে গিয়ে ভয়াবহ দুশ্চিন্তায় পড়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গিয়েছে, বিদ্যুৎ বিভাগের দেয়া চিঠিতে সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের ভর্তুকি হিসেবে চাওয়া অর্থের মোট পরিমাণ ৪ হাজার ২১০ কোটি টাকা। এর মধ্যে শুধু আইপিপিগুলোকেই পরিশোধের জন্য চাহিদা দেয়া হয়েছে ৪ হাজার ৮৭ কোটি ৯২ লাখ টাকার। আইপিপির ওপর বিদ্যুৎ খাতের ক্রমবর্ধমান নির্ভরতার বিষয়টি এ মুহূর্তে সংশ্লিষ্টদের জন্য বড় দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, আইপিপির কাছ থেকে বেশি মূল্যে বিদ্যুৎ কেনার কারণে ভর্তুকির পরিমাণও ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। একেবারে রক্ষণশীলভাবে হিসাব করলেও চলতি বছর এ বাবদ প্রয়োজনীয় অর্থের পরিমাণ কোনোভাবেই ২০ হাজার কোটি টাকার কম নয়। সামনের দিনগুলোয় তা আরো বাড়বে। চলতি বছরেই কমিশনিংয়ের অপেক্ষায় রয়েছে আরো বেশকিছু আইপিপি। এর সঙ্গে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহার্য জ্বালানির দামও এখন বাড়ছে। ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিকস অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল অ্যানালাইসিসের (আইইএফএ) সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনেও একই কথা উঠে এসেছে। সংস্থাটির বক্তব্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে বিপিডিবির ২০০ বিলিয়ন (২০ হাজার কোটি) টাকা ভর্তুকি হিসেবে প্রয়োজন হবে, যা গত অর্থবছরের চেয়ে ৭১ শতাংশ বেশি। বিষয়টি স্বীকার করছেন বিপিডিবির সংশ্লিষ্টরাও। নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে সংস্থাটির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বাড়তি বিদ্যুৎ কেনায় এ অর্থের প্রয়োজন হচ্ছে। বিশেষত গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির কারণে ফার্নেস অয়েলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনতে হচ্ছে। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যে অস্থিতিশীলতার কারণে সেখানেও অর্থের প্রয়োজন পড়ছে বেশি। চলতি অর্থবছরের বরাদ্দকৃত ভর্তুকি যুক্ত করে এ অংক দাঁড়ায় ৫৫ হাজার কোটি টাকার বেশিতে। এ বিষয়ে অর্থ বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, বিদ্যুতের ভর্তুকি বাবদ বাজেটে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়। কিন্তু পিডিবি প্রতি মাসে মোটা অংকের ভর্তুকির চিঠি পাঠায়। এতে বাজেটে তাদের জন্য যে বরাদ্দ থাকে, তা দিয়ে সংস্থাটির চাহিদা মেটে না। তাই পরবর্তী অর্থবছরের বাজেটের অর্থ দিয়ে আগের ভর্তুকির চাহিদা মেটাতে হয়। এবার যে বরাদ্দ রাখা হয়েছে, তা দিয়ে চলতি অর্থবছরের অক্টোবর পর্যন্ত ভর্তুকি দেয়া সম্ভব হবে। এর পরের আট মাসের ভর্তুকির অর্থ সংস্থান করতে হবে আগামী বাজেটের বরাদ্দ থেকে। বিপিডিবির তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে সংস্থাটি বিদ্যুৎ ক্রয় বাবদ ৪৯ হাজার ৪৩৯ কোটি টাকা ব্যয় করেছে। এর মধ্যে আইপিপি থেকে বিদ্যুৎ ক্রয়ে ব্যয় হয়েছে ২৭ হাজার ৭৩৭ কোটি টাকা। সে হিসেবে সরকারের বিদ্যুৎ ক্রয় বাবদ ব্যয়কৃত অর্থের ৫৬ শতাংশেরও বেশি ব্যয় হয়েছে আইপিপিগুলোর পেছনে। এর আগের অর্থবছরে (২০১৯-২০) এর পরিমাণ ছিল অর্ধেকেরও কম। ওই সময় আইপিপি থেকে বিপিডিবি বিদ্যুৎ কিনেছিল ১৭ হাজার ৫১৯ কোটি টাকার। গত অর্থবছরে আইপিপি থেকে বিদ্যুৎ ক্রয়ে বিপিডিবির আর্থিক লোকসান হয়েছিল ১১ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছর তা বেড়ে দ্বিগুণ হওয়ার জোর আশঙ্কা রয়েছে। কারণ বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গেছে। সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রেখে বেসরকারি খাত থেকে বেশি বিদ্যুৎ কেনার কারণে বিপিডিবি প্রতিনিয়ত আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা অধ্যাপক ম. তামিম বলেন, উৎপাদন খরচ কম এমন সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে বসিয়ে রাখার কোনো যৌক্তিকতা নেই। এ ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো সার্বক্ষণিক চালু রাখা দরকার। এক্ষেত্রে দেখা যাবে আইপিপি থেকে বিদ্যুৎ নেয়া কমে গিয়েছে। তবে আইপিপি থেকে সবসময় বিদ্যুৎ কেনা হবে এমন চুক্তিতেই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো নির্মাণ করা হয়। এক্ষেত্রে কেন্দ্রগুলো বসিয়ে রাখলে সেখানেও সরকারকে মোটা অংকের অর্থ গুনতে হয়। বিদ্যুৎ খাতের অপচয় কমাতে এরই মধ্যে একবার পুরনো ও ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর চুক্তি নবায়ন না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সরকার। সিদ্ধান্তটিকে স্বাগত জানিয়ে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হলে বিপিডিবির সক্ষমতা বাবদ পরিশোধিত অর্থের পরিমাণ কমে আসবে। আর্থিক ক্ষতিও কম হবে। যদিও এরই মধ্যে সরকার সে পরিকল্পনা থেকে পিছিয়ে এসেছে। সম্প্রতি নতুন করে পাঁচটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তি নবায়নের অনুমোদন দিয়েছে সরকার। বিদ্যুতের নীতি ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে ৭৮টি আইপিপি বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে। সব মিলিয়ে এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের মোট সক্ষমতা ৮ হাজার ৭৭৭ মেগাওয়াট, যার মোট বিদ্যুৎ সক্ষমতার এক-তৃতীংশের বেশি। এছাড়া আরো প্রায় ৩ হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতার আইপিপির বিদ্যুৎকেন্দ্র চালুর অপেক্ষায় রয়েছে। চলতি বছরে এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র কমিশনিং হওয়ার কথা জানিয়েছে পিডিবি। এর মধ্যে চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে নির্মাণাধীন এসএস পাওয়ার লিমিটেডের বিদ্যুৎকেন্দ্রটিকে ধরা হচ্ছে বেসরকারি খাতের সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র হিসেবে। বিদ্যুৎকেন্দ্রটির প্রথম ইউনিট উৎপাদনে আসার কথা রয়েছে চলতি বছরের জুলাইয়ে এবং দ্বিতীয় ইউনিট আগস্টে। নারায়ণগঞ্জের মেঘনাঘাটে সামিট মেঘনাঘাট-২ নামে ৫৮৩ মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে সামিট পাওয়ার। বেসরকারি খাতে নির্মাণাধীন বিদ্যুৎকেন্দ্রটি চলতি বছরের আগস্টে কমিশনিং হওয়ার কথা রয়েছে। ৫৮৪ মেগাওয়াট সক্ষমতার আইপিপি খাতে আরেকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে ইউনিক গ্রুপ। চলতি বছরের নভেম্বরে এটি চালু হওয়ার কথা রয়েছে। এর বাইরে চাঁদপুরে ১১৫ মেগাওয়াট, ঠাকুরগাঁওয়ে ১১৫ ও বরিশালে ৩০৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন রয়েছে। পিডিবির কমিশনিং টাইম অনুযায়ী এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র চলতি বছরের জানুয়ারি, মার্চে চালু হওয়ার কথা থাকলেও এখনো এগুলোর কার্যক্রম শুরু করা যায়নি। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে আসার পর আইপিপি বাবদ ভর্তুকির পরিমাণ আরো বাড়বে।
এ মুহূর্তে মূল্যবৃদ্ধি ছাড়া বিদ্যুৎ খাতের ভর্তুকি কমানো সম্ভব নয় বলে মনে করছেন বিদ্যুৎ বিভাগ-সংশ্লিষ্টরা। তাদের দাবি, বিশেষ করে জ্বালানি পণ্যের বৈশ্বিক বাজার অস্থিতিশীলতার এ মুহূর্তে সম্ভাব্য আর কোনো বিকল্প নেইও। বিদ্যুৎ বিভাগ সচিব মো. হাবিবুর রহমান এ বিষয়ে বলেন, বৈশ্বিক পর্যায়ে কভিড মহামারী এবং বর্তমানে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ায় বিদ্যুতের উৎপাদন খরচও বেড়েছে। এ কারণে বিদ্যুতে ভর্তুকির পরিমাণও একটু বেড়েছে। তবে এ মুহূর্তে ভর্তুকি কমাতে হলে বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হবে। যদিও বিদ্যুতে ভর্তুকি কমানোর জন্য মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। তবে কখন তা বাড়বে সেটা বিইআরসির সিদ্ধান্ত। এছাড়া অন্য যেসব উদ্যোগ নিলে ভর্তুকি কমানো সম্ভব, সেসব বিষয় নিয়েও কাজ করছে সরকার। প্রতি মাসে ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসারগুলোর (আইপিপি)ন পিছনে বাড়তি ব্যয়েই চাপে ফেলেছে সরকারের অর্থ বিভাগকে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে বিদ্যুৎ খাতের ভর্তুকি বাবদ শুরুতে বরাদ্দ রাখা হয়েছিল ৯ হাজার কোটি টাকা। বিপিডিবির বাড়তি চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে এরই মধ্যে তা এক দফায় বাড়ানো হয়েছে আরো ৩ হাজার কোটি টাকা। এতে বর্তমানে মোট বরাদ্দ দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার কোটি টাকায়। এর মধ্য থেকে গত অর্থবছরের মার্চ থেকে চলতি অর্থবছরের আগস্ট পর্যন্ত মোট ছয় মাসের জন্য ৮ হাজার ৭০০ কোটি টাকা এরই মধ্যে ছাড় করেছে অর্থ বিভাগ।
সাশ্রয়ী বিবেচনায় বর্তমানে গ্যাসের পরিবর্তে ফার্নেস অয়েলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে বেশি কাজে লাগাচ্ছে সরকার। বাংলাদেশ ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইপিপিএ) প্রেসিডেন্ট মো. ইমরান করিম বলেন, বৈশ্বিকভাবে গ্যাসের তুলনায় এখনো জ্বালানি তেলের মূল্য কিছুটা সাশ্রয়ী। এ কারণে ফার্নেস অয়েলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে বিদ্যুৎ নিচ্ছে সরকার। আবার বৈশ্বিক বাজার পরিস্থিতির কারণে আগের তুলনায় উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। কভিড উত্তরণ-পরবর্তী সময়ে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বাজার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরলে বা জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম আগের অবস্থায় চলে গেলে বিপিডিবির লোকসান কমে আসবে। আমরাও এ বিষয়ে সরকারকে সহায়তা করার চেষ্টা করছি।