একদিকে বিশ্বব্যাপী জাহাজ ও কনটেইনার সংকট, অন্যদিকে দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রামে এসে পড়তে হয় জটে। এ দুই কারণে বাংলাদেশে আমদানি পণ্যের চালান নিয়ে আসতে আগ্রহী নয় শিপিং কোম্পানিগুলো। ফলে তুলা আমদানি সম্পন্ন করতে অতিরিক্ত সময় প্রয়োজন হচ্ছে দেশের রফতানিমুখী সুতা উৎপাদনকারী স্পিনিং মিলগুলোর। আবার কাঁচা তুলা যখন বন্দরে পৌঁছাচ্ছে তখন তা পরিশোধন বা ফিউমিগেশন প্রক্রিয়ায় চালান ছাড় করতে আরো বেশি দেরি হচ্ছে। আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ দুই প্রেক্ষাপটেই সুতা উৎপাদনে তুলা সংকটের মুখে পড়ছে মিলগুলো। এ ধারা অব্যাহত থাকলে উৎপাদন ব্যবস্থা ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশে তুলা আমদানি হয়েছে ৭৫ লাখ বেল। ২০২০-২১ অর্থবছরে আমদানি ৭৬ লাখ বেল ছাড়িয়ে গেছে। চলতি অর্থবছর শেষে আমদানি ৯০ লাখ বেল ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রক্ষেপণ রয়েছে। কিন্তু আমদানি তুলার প্রাপ্তি নিয়ে অনিশ্চয়তা স্পিনিং মিল মালিকদের ফেলে দিয়েছে দুশ্চিন্তায়।
বিটিএমএ সূত্রে জানা গেছে, তুলা আমদানিতে বহুমুখী সমস্যা মোকাবেলা করতে হচ্ছে স্পিনিং মিলগুলোকে। বিশ্বব্যাপী জাহাজসহ কনটেইনার সংকটসহ রয়েছে বন্দর জট। দেশে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরেও রয়েছে ফিডার ভেসেলের সংকটসহ জটের সমস্যা। সব মিলিয়ে অনেক শিপিং কোম্পানি বাংলাদেশী পণ্য পরিবহনে আগ্রহী হচ্ছে না। দেশে বিটিএমএ সদস্য স্পিনিং মিল ৪৩০টিরও বেশি। এ মিলগুলোর কেনা তুলাসহ অন্যান্য কাঁচামাল দেশে আমদানিতে অতিরিক্ত সময়ের প্রয়োজন হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পাঁচ-ছয় মাস সময় লাগছে। ক্রয় করা তুলা যথাসময়ে দেশে পৌঁছাতে না পারার কারণে মিলগুলোর উৎপাদন ব্যবস্থা ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কাও সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশে কাঁচা তুলা আমদানি হচ্ছে মূলত যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, পূর্ব ও পশ্চিম আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, সিআইএসভুক্ত দেশসহ অন্যান্য দেশ থেকে। স্পিনিং মিলগুলোর কারিগরি প্রেক্ষিত বিবেচনায় ২৪ ঘণ্টা চালু রাখতে হয়। উৎপাদন অব্যাহত রাখার স্বার্থে মিলগুলোয় কাঁচা তুলার নিরবচ্ছিন্ন জোগান অব্যাহত রাখার কোনো বিকল্প থাকে না। এছাড়া উৎপাদিত সুতা তৈরি পোশাক খাতে দ্রুততম সময়ের মধ্যে সরবরাহের লক্ষ্যেও স্পিনিং মিলগুলোকে অব্যাহতভাবে কাঁচা তুলা আমদানি করতে হয়।
অন্য কোনো দেশের কাঁচা তুলার জন্য প্রযোজ্য না হলেও কৃষি মন্ত্রণালয়ের দিকনির্দেশনা ও আইনে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা তুলা বন্দর থেকে খালাসের আগে পরিশোধন বা ফিউমিগেশন করতে হয়। যুক্তরাষ্ট্রের তুলা জাহাজ থেকে নামার পর ফিউমিগেশন প্রক্রিয়া সম্পন্ন শেষে ৭২ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয় ফলাফল পেতে। ফলাফল প্রাপ্তি সাপেক্ষে সার্টিফিকেট ইস্যুর পর শুল্ক কর্তৃপক্ষ কাঁচা তুলার মূল্যায়ন কার্যক্রম শুরু করে। এসবই আমদানি করা কাঁচা তুলা খালাস পরিস্থিতিকে আরো জটিল করেছে। এদিকে কাঁচা তুলা আমদানিতে দীর্ঘসূত্রতার পাশাপাশি আমদানি অনুমতি (আইপি) নিয়েও জটিলতা রয়েছে। বিটিএমএর স্পিনিং মিলগুলোকে কাঁচা তুলা আমদানির আগে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইং থেকে আইপি সংগ্রহ করতে হয়। এক্ষেত্রে আইপির মেয়াদ নির্ধারণ করে দেয়া হয় সাধারণত চার মাস। পরবর্তী সময়ে কোনো কারণে সংশ্লিষ্ট মিলগুলো আইপির বিপরীতে তুলা আমদানি করতে সক্ষম না হলে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রয়োজনীয় ফি প্রদান সাপেক্ষে আইপির মেয়াদ বৃদ্ধি করতে হয়।
কিন্তু বৃদ্ধি করা মেয়াদের মধ্যেও তুলা আমদানি সম্ভব হচ্ছে না অনেক ক্ষেত্রে। চলমান পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে বর্তমানে তুলা আমদানিতে মিলগুলোর ছয়-সাত মাস বা তারও বেশি সময়ের প্রয়োজন হচ্ছে। অন্যদিকে ট্রানজিট ও চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ জটের কারণে আমদানি করা তুলা বাংলাদেশে পৌঁছতে ৯-১০ মাস সময় লাগছে। এদিকে বৃদ্ধি করা আইপির মেয়াদেও তুলা আমদানি সম্পন্ন না হওয়ায় মিলগুলোকে আমদানীকৃত তুলা বিশেষ আদেশ গ্রহণের মাধ্যমে ছাড় করতে হয়। প্রায় ক্ষেত্রেই এ ধরনের বিশেষ আদেশ প্রাপ্তি সময়সাপেক্ষ হয়ে থাকে। যার কারণে বন্দরে ড্যামারেজ, হয়রানি, উচ্চমূল্যে স্থানীয় বাজার থেকে তুলা কেনার কারণে সুতার উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি, আর্থিক ক্ষতি, ব্যবসার খরচসহ তুলা খালাসে অতিরিক্ত সময়ে মিলগুলোর উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে বলে জানিয়েছে বিটিএমএ। বিটিএমএ সভাপতি মোহম্মদ আলী খোকন বলেন, বর্তমানে তুলা আমদানিতে শিপিং সমস্যার কারণে সদস্য মিলগুলো কাঁচামাল আমদানিতে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। ক্রয় করা তুলা যথাসময়ে দেশে পৌঁছাতে না পারার কারণে মিলগুলোর উৎপাদন ব্যবস্থা ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। আবার মিলে গ্যাস সংকটের কারণেও উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এদিকে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যাচ্ছে।