বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় ‘অশনি’ বাংলাদেশে আঘাত হানার আশঙ্কা এখন পর্যন্ত নেই বলে জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান। গতকাল রবিবার সচিবালয়ে নিজ দপ্তরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এ কথা জানান প্রতিমন্ত্রী। আন্দামান সাগরে সৃষ্ট লঘুচাপটি রবিবার সকালে ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়েছে জানিয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, যেদিকে যাচ্ছে এটি যদি সেদিকে ধাবিত হয় তাহলে ভারতের বিশাখাপত্তনম, উড়িষ্যা, পশ্চিমবঙ্গে আঘাত হেনে বাংলাদেশের সাতক্ষীরা অঞ্চলে আঘাত হানতে পারে। এটি চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে এক হাজার ১৭৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থান করছে।
এনামুর রহমান বলেন, ঘূর্ণিঝড়টি ১২ মে সকালে বিশাখাপত্তনম, ভুবনেশ্বর, পশ্চিমবঙ্গ স্পর্শ করে দুর্বল হয়ে নি¤œচাপে পরিণত হবে। আবহাওয়াবিদ এবং আন্তর্জাতিক আবহাওয়া অফিস থেকে ধারণা করছে, বাংলাদেশে আঘাত হানার সম্ভাবনা এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। অশনির প্রভাবে বাংলাদেশে ঝড়-বৃষ্টি হবে। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় বা জলোচ্ছ্বাস হবে না বলে জানান প্রতিমন্ত্রী।
এনামুর রহমান বলেন, এখন এটি উত্তর-পশ্চিম দিকে ধাবিত হচ্ছে। ঘূর্ণিঝড় যে কোনো সময় যে কোনো দিকে মোড় নিতে পারে। এটি যদি মোড় নিয়ে উত্তর দিকে ধাবিত হয়, তাহলে আমাদের দেশের সাতক্ষীরা, পটুয়াখালী, বরিশাল ও খুলনাতে আঘাত হানতে পারে।
এনামুর রহমান বলেন, আমরা আশ্রয় কেন্দ্রগুলো প্রস্তুত করার নির্দেশনা দিয়েছি। আমরা সবাইকে নিয়ে সভা করেছি। তাদের সচেতন করে দেওয়া হয়েছে। মাঠে নেমেছে সিপিপি স্বেচ্ছাসেবকরা। তারা ঘূর্ণিঝড়ের সতর্কবার্তা প্রচার করছেন। সেগুলোর প্রস্তুতি প্রায় শেষ। মোটামুটি প্রস্তুতি আছে। সেখানে রান্না করা খাবার দেওয়ার জন্য চাল ও অর্থ দিয়েছি। করোনার কারণে আশ্রয় কেন্দ্রে স্বাস্থ্যবিধি মেনে মানুষকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য নির্দেশনা দিয়েছি। দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গোপসাগর ও কাছাকাছি এলাকায় অবস্থানরত গভীর নি¤œচাপটি রবিবার সকালের দিকে ঘূর্ণিঝড় ‘অশনি’তে রূপ নেয়। ফলে দেশের সমুদ্রবন্দরগুলোকে ২ নম্বর দূরবর্তী হুঁশিয়ারি সংকেত দেখাতে বলেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
অবশেষে দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গোপসাগর ও কাছাকাছি এলাকায় অবস্থানরত গভীর নি¤œচাপটি ঘূর্ণিঝড় ‘অশনি’তে রূপ নিয়েছে। এটির দিক এখনও উড়িষ্যা, পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ ড. মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক।
গতকাল রোববার সকালে এ তথ্য জানান তিনি। এছাড়া এসময় বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর আবহাওয়ার বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে দেশের সমুদ্রবন্দরগুলোকে ১ নম্বর দূরবর্তী সতর্ক সংকেত নামিয়ে ২ নম্বর দূরবর্তী হুঁশিয়ারি সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। ড. মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক বলেন, বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থানরত নি¤œচাপটি গভীর নি¤œচাপে রূপ নিয়েছে। এটি আরও ঘণীভূত হয়ে উপকূলের দিকে এগিয়ে আসছে। এটি ঘূর্ণিঝড় ‘অশনি’তে রূপ নিতে পারে। এজন্য চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরগুলোকে ১ নম্বর দূরবর্তী সতর্ক সংকেত নামিয়ে ২ নম্বর দূরবর্তী হুঁশিয়ারি দেখাতে বলা হয়েছে। এছাড়া উত্তর বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত সব মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে উপকূলের কাছাকাছি এসে সাবধানে চলাচল করতে বলা হয়েছে। সেই সঙ্গে তাদেরকে গভীর সাগরে বিচরণ না করতে বলা হয়েছে।
অন্যদিকে আবহাওয়া অধিদপ্তর আবহাওয়ার বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থানরত গভীর নি¤œচাপটি উত্তর-পশ্চিম দিকে অগ্রসর ও ঘণীভূত হয়ে ঘূর্ণিঝড় ‘অশনি’-তে পরিণত হয়ে একই এলাকায় অবস্থান করছিলো। এটি রোববার সকাল ৬টায় চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে এক হাজার ২৫৫ কিলোমিটার দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমে, কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে এক হাজার ১৭৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণপশ্চিমে, মোংলা সমুদ্রবন্দর থেকে এক হাজার ২৫০ কিলোমিটার দক্ষিণে এবং পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে এক হাজার ২০৫ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থান করছিল। এটি আরও ঘনীভূত হয়ে উত্তর-পশ্চিম দিকে অগ্রসর হতে পারে।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও জানানো হয়েছে, ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৫৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ৬২ কিলোমিটার, যা দমকা বা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ৮৮ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের নিকটবর্তী এলাকায় সাগর বিক্ষুব্ধ রয়েছে। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ১ নম্বর দূরবর্তী সতর্ক সংকেত নামিয়ে এর পরিবর্তে ২ নম্বর দূরবর্তী হুঁশিয়ারি সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।
দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গোপসাগর ও কাছাকাছি এলাকায় অবস্থানরত গভীর নি¤œচাপটি ঘূর্ণিঝড় ‘অশনি’তে রূপ নিয়েছে। তবে এটি কোন স্থান দিয়ে উপকূল অতিক্রম করবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না।
আবহাওয়ার প্র্বূাভাস দেওয়া বিভিন্ন সংস্থা জানিয়েছে, এটি আরও এগিয়ে ভারতের উপকূল ঘেঁষে বাঁক নিয়ে আবার বাংলাদেশের উপকূলের দিকে এগিয়ে আসতে পারে। তবে শেষ মুহূর্তে সেই বাঁকটি নেবে কি না- এটা জানতে আরও অপেক্ষা করতে হবে। গতকাল রোববার (৮ মে) সকালে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকা থেকে ঘূর্ণিঝড়টি এক হাজার কিলোমিটারেরও বেশি দূরে ছিল। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ২ নম্বর দূরবর্তী হুঁশিয়ারি সংকেত দেখাতে বলেছে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর।
‘অশনি’ এখন ঘণ্টায় ১৬ কিলোমিটার গতিতে উত্তর-পশ্চিম দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এভাবে এগিয়ে গেলে ভারতের উত্তর অন্ধ্রপ্রদেশ ও উড়িষ্যা উপকূল অতিক্রম করার কথা। কিন্তু ভারতের আবহাওয়া অধিদপ্তর ও আমেরিকার নৌ-বাহিনী পরিচালিত জয়েন্ট টাইফুন ওয়ার্নিং সেন্টার ‘অশনি’র যে সম্ভাব্য গতিপথ দেখিয়েছে সেটা অনুযায়ী, এটা উত্তর অন্ধ্রপ্রদেশ ও উড়িষ্যা উপকূলের কাছে এসে উত্তর ও উত্তর-পূর্ব দিকে বাঁক নিতে পারে। বাঁক নেওয়ার পর এর গতিপথ হতে পারে ভারতের উপকূল ঘেঁষে বাংলাদেশের দিকে। তবে শেষ মুহূর্তে পূর্বাভাস অনুযায়ী ‘অশনি’ এই বাঁক নেয় কি না সেটা দেখার বিষয়।
ভারতের আবহাওয়া বিভাগ (মৌসুম ভবন) জানিয়েছে, রোববার সন্ধ্যার মধ্যে ঘূর্ণিঝড়টি আরও শক্তিশালী হয়ে প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হতে পারে। আগামী ১০ মে ঘূর্ণিঝড়টি ভারতের উত্তর অন্ধ্র প্রদেশ ও উড়িষ্যা উপকূলের কাছাকাছি চলে যেতে পারে। এরপর এটি উত্তর ও উত্তর-পূর্ব দিকে বাঁক নিয়ে উড়িষ্যা উপকূল অভিমুখে উত্তর-পশ্চিম বঙ্গোপসাগরের দিকে যেতে পারে।
ঘূর্ণিঝড়টি কোন দিকে যেতে পারে জানতে চাইলে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক সানাউল হক মন্ডল বলেন, ঘূর্ণিঝড়টি এখন পর্যন্ত উত্তর-পশ্চিম দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা এর গতিপথ সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করছি। এটি যদি গতিপথ পরিবর্তন করে তখন আমরা জানাবো। তিনি বলেন, ঘূর্ণিঝড়টি যদি মোড় নিয়ে বাংলাদেশের দিকে আসার সম্ভাবনা থাকে, তখন আমরা সতর্ক সংকেত বাড়িয়ে দেবো। এখনই এটির গতিপথ নিয়ে নির্দিষ্ট করে বলা যাবে না। এখন যেভাবে এগোচ্ছে তাতে ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশ ও উড়িষ্যার দিকে যাওয়ার কথা।
কানাডার সাসকাচুয়ান ইউনিভার্সিটির আবহাওয়া ও জলবায়ুবিষয়ক বাংলাদেশি পিএইচডি গবেষক মোস্তফা কামাল পলাশ বলেন, সোমবারের আগে নিশ্চিত করে পূর্বাভাস দেওয়া যাচ্ছে না। এখনই বলা যাচ্ছে না এই ঘূর্ণিঝড় কোন স্থানের ওপর দিয়ে স্থলভাগে আঘাত করবে। তবে প্র্বূাভাস মডেলগুলোর তথ্য অনুযায়ী, ১০ মে থেকে চট্টগ্রাম বিভাগের জেলাগুলোতে বৃষ্টি শুরু হতে পারে। ১১ মে থেকে বরিশাল, খুলনা, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের জেলাগুলো এবং ১২ ও ১৩ মে দেশব্যাপী বৃষ্টি হতে পারে। একই সঙ্গ ১৩ ও ১৪ মে চট্টগ্রাম বিভাগের জেলাগুলোতে অতি ভারী বৃষ্টিপাত হতে পারে।