কয়েকবছর আগে এক দুপুরে হঠাৎ দরজায় বেল। নীলা (ছদ্মনাম) দরজা খুলতে একজন জানালেন তারা খানা জরিপ করছেন, কিছু তথ্য দরকার। প্রশ্ন করলেন, আপনার বাসার খানাপ্রধান কে? নীলা জানতে চাইলেন খানাপ্রধান বিষয়টা আসলে কী? তাকে স্পষ্ট না করে জানতে চাওয়া হয়, বাড়ির কর্তা বা সিদ্ধান্তগ্রহীতা কে? নীলা বলেন, এ বাসার খানাপ্রধান তিনি। তখন তাকে বলা হয় খানাপ্রধান সাধারণত বাসার যিনি কর্তা, যিনি আয় করেন। নীলা হলেন ওই বাসার খানাপ্রধান, তার স্বামী নন। এরপর ফর্ম পূরণ না করেই চলে যান ওই ব্যক্তি।
ষষ্ঠ জনশুমারি ও গৃহগণনা শুরুর দিন (১৫ জুন) তথ্যসংগ্রহকারী এক ব্যক্তি শামীমাকে জিজ্ঞেস করেন, খানাপ্রধানের বিষয়ে। শামীমা বলেন, তিনি ও তার স্বামী সমান আয় করেন ও পরিবারের সব সিদ্ধান্ত একসঙ্গে নেন। ফলে এখানে কেউ প্রধান নেই। কিন্তু তথ্যসংগ্রহকারী সেটি কোনোভাবেই মানতে রাজি নন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটা একেবারেই করা যাবে না। এভাবে জোর করে পুরুষকে খানাপ্রধান বানানোর কারণে আসলে কত শতাংশ নারী খানাপ্রধান তার সঠিক চিত্রটা পাওয়া যাবে না। নারী নেতারা বলছেন, এ ধরনের প্রশ্ন বৈষম্য সৃষ্টি করবে। এই প্রশ্ন এখন করারই সুযোগ নেই। যেখানে খানাপ্রধান পুরুষ না সেখানে জোর করে পুরুষ লেখানো মানে ভুল তথ্য দিচ্ছে।
জরিপের খানা মডিউলে রয়েছে, খানার (পরিবার) ক্রমিক নম্বর, খানার ঠিকানা। বসবাসের ধরনের মধ্যে রয়েছে, ব্যক্তির অন্য কোথাও বসতঘর আছে কিনা? খানার প্রকার, খানার প্রধান বসতঘরের মেঝের উপকরণ, খানার প্রধান বসতঘরের দেয়ালের উপকরণ, খানার প্রধান বসতঘরের ছাউনির উপকরণ।
বিবিএসের সংজ্ঞানুযায়ী যে কয়জন ব্যক্তি একই রান্নায় খাওয়া-দাওয়া এবং একসঙ্গে বসবাস করে, তাদের একত্রে একটি খানা বা হাউসহোল্ড বলা হয়। প্রতি পাঁচ বছর পর করা হয় খানা জরিপ। এটি থেকে বের করা হয় দেশের দারিদ্র্যের হার, সাক্ষরতার হার, স্কুলে ভর্তি ও ঝরে পড়ার হার, পেশাগত জনসংখ্যার হার, প্রতিবন্ধীর সংখ্যা, অভিবাসনের হার, বিদ্যুৎ ব্যবহারকারীর হার, দেশবাসীর খাদ্যাভ্যাস, মাথাপিছু ক্যালরি গ্রহণের পরিমাণ, খানার মাসিক আয় ও মাসিক ব্যয়, খাদ্যের পেছনে ব্যয়, ভোগ্য পণ্যে ব্যয় ইত্যাদি।
খানাপ্রধান হিসেবে পুরুষকে বোঝানোর বিষয়টি সাসটেইনেবল ডেভলপমেন্ট গোল (এসডিজি) পরিপন্থী উল্লেখ করে ‘নিজেরা করি’র নির্বাহী খুশী কবীর বলেন, ‘এসজিডিতে নারী পুরুষ সব জায়গায় সমানাধিকারের কথা বলা হচ্ছে। কেউ উপরে কেউ নিচে না। কোনও বৈষম্য থাকবে না। সেখানে এ ধরনের কর্মকা- নীতির বিপরীত হয়ে যাচ্ছে। যেখানে খানাপ্রধান পুরুষ না, সেখানে জোর করে পুরুষ লেখানো ভুল তথ্য দিচ্ছে। এই শুমারির ওপর কীভাবে নির্ভর করবো।’
জরিপে জোর করে কোনও উত্তর বসানোর সুযোগ আছে কিনা প্রশ্নে পরিসংখ্যান গবেষণা ও শিক্ষণ ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক হাসানুর রহমান বলেন, ‘না। এটা একেবারেই করা যাবে না।’ তাহলে কেন এ ধরনের অভিযোগ আসছে প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘তথ্য সংগ্রহের জন্য মাঠে পাঠানোর আগে যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় সেখানে সবার কাছে এ ধরনের বার্তা দেওয়া না হয়ে থাকতে পারে, বা দিলেও কেউ কেউ ঠিকমতো রিসিভ নাও করে থাকতে পারেন। এভাবে জোর করে পুরুষকে খানাপ্রধান বানানোর কারণে আসলে কত শতাংশ নারী খানাপ্রধান তার সঠিক চিত্রটা পাওয়া যাবে না। আগে যখন জরিপ হতো তখনকার সামাজিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বদলে গেছে। ফলে সেই পরিবর্তনটা সামনে না এলে প্রগতির সূচকে প্রভাব পড়বে। মনে রাখা জরুরি, সামগ্রিকভাবে নারীর অগ্রগতি একটা সূচক, সেটাকে দুর্বল দেখাবে।’ ‘জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২’-এর প্রকল্প পরিচালক দিলদার হোসেনের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করে পাওয়া যায়নি।
উল্লেখ্য, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশনায় ১৯৭৪ সালে প্রথম আদমশুমারি ও গৃহগণনা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১০ বছর পরপর ১৯৮১, ১৯৯১, ২০০১ এবং ২০১১ সালে যথাক্রমে দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ এবং পঞ্চম আদমশুমারি ও গৃহগণনা অনুষ্ঠিত হয়। আইন অনুযায়ী, প্রতি ১০ বছর পরপর দেশের প্রতিটি মানুষকে গণনার আওতায় আনতে হবে। এ জন্য ‘জনশুমারি ও গৃহগণনা-২০২১’ শীর্ষক প্রকল্প ২০১৯ সালের ২৯ অক্টোবর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে অনুমোদন পায়। তবে করোনা মহামারির এটি কারণে এক বছর পিছিয়ে যায়।-বাংলাট্রিবিউন