নদীপ্রধান দেশ বাংলাদেশ। এ দেশের বুক চিরে বয়ে যায় নদী। পারে পারে জনবসতি, নদীর ভাঙাগড়ার মতো মানুষের সামাজিক সাংস্কৃতিক অথর্নীতিক ধমর্ বণর্ গোত্র ও রাজনৈতিক অবস্থা নদীপ্রসঙ্গকে ধারণ করে কখনো কখনো পরিবতির্ত হয়। পরিবতের্নর হাওয়ায় গড়ে ওঠে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী। জীবনচক্রে জীবিকার পথগুলো সাধারণ জনগোষ্ঠী থেকে থাকে একটু ভিন্নতর। জল গড়ায় জীবন গড়ায়, জল থেকে উবর্রমাটির বুকে সবর্স্বহারা মানুষ বসতিস্থাপন করে। নদীর সঙ্গে জল মাটি মানুষের সঙ্গমে চিত্ররূপায়নে সময়ের বাতার্ সুধায় শিল্পীমন। বাংলাসাহিত্য বৃক্ষের প্রধানতম শাখা উপন্যাস। যেখানে থাকে বিশাল জনগোষ্ঠী জীবনযাপনের স্থির বা চলমান বিষয়। নদীও সাহিত্যের অনন্য অনুষঙ্গ, ভেতরের সামূহিক চিত্রগুলো তুলে পাঠকপ্রিয়তা লাভ করে। গড়ে ওঠে নদীভিত্তিক উপন্যাস। অনুষঙ্গ নদী, ঔপন্যাসিকের মননে জল খেলা করে বাদ পড়েনি সমাজ সংস্কৃতি ইতিহাস ঐতিহ্য ও অথর্নীতি। বঙ্গোপসাগরের জল ভিড়ে শ্যামলিমা পথে। নদীর নামকরণে বাঁক বদলে বদলে রিপুগুচ্ছকে নাড়িয়ে পাঠকপ্রিয়তা পায় উপন্যাস। যদি বলি বাংলাসাহিত্যে নদীভিত্তিক প্রথম উপন্যাস মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝি (১৯৩৬)। তারপর অদ্বৈত মল্লবমের্ণরÑ তিতাস একটি নদীর নাম (১৯৫৬)। আলাউদ্দীন আল আজাদের কণর্ফুলী (১৯৬২), আবু ইসহাকের পদ্মার পলিদ্বীপ (১৯৮৬), শামসুদ্দীন আবুল কালামের পদ্মা মেঘনা যমুনা, হুমায়ুন আহমদের ময়ূরাক্ষী, সৈয়দ শামসুল হকের নদী কারো নয় (২০১৮) হারুন পাশার তিস্তা (২০১৮), শাহমুব জুয়েলের মরা ডাকাতিয়া (অপ্রকাশিত)। বিভিন্ন সময়ে বাংলা ভাষায় অনেক ঔপন্যাসিক নদীকেন্দ্রিক সাধারণ মানুষের জীবনযাপন সমাজ সংস্কৃতি রাজনৈতিক ও অথর্নীতির চিত্র নিয়ে উপন্যাস লিখেছেন সে হিসেবে উপন্যাসগুলো হয়ে উঠেছে নদীকেন্দ্রিক। উপন্যাসের কাহিনী ভূগোল জীবনচিত্র দৃষ্টিভঙ্গি ও পরিবেশনশৈলীতে এসেছে ঔপন্যাসিকের নিজস্ব চিন্তা কৌশল। সময়ের পেক্ষাপটে যেসব উপন্যাসে নদী প্রসঙ্গ এসেছে সেগুলোর মধ্যে কাজী আবদুল ওদুদের নদীবক্ষে (১৯১৮), মানিক বন্দ্যোপাদ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝি (১৯৩৬), তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কালিন্দী (১৯৪০), সরোজকুমার রায়চৌধুরীর ময়ূরাক্ষী (১৩৪৩ বঙ্গাব্দ), নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের উপনিবেশ (১ম খ- ১৯৪৪, হুমায়ুন কবিরের নদী ও নারী (১৯৪৫), অমরেন্দ্রনাথ ঘোষের চরকাশেম (১৯৪৯), মনোজ বসুর জলজঙ্গল (১৯৫১), তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাঁসুলী বাঁকের উপকথা (১৯৪৭), সমরেশ বসুর গঙ্গা (১৯৫৭), শহীদুল্লা কায়সারের সারেং বৌ (১৯৬২), সাধন চট্টোপাধ্যায়ের গহীন গাঙ (১৯৮০), শামসুদ্দীন আবুল কালামের সমুদ্র বাসর (১৯৮৬), দেবেশ রায়ের তিস্তাপারের বৃত্তান্ত (১৯৮৮), শ্যামল গঙ্গোপধ্যায়ের গঙ্গা একটি নদীর নাম (২০০১), ঘনশ্যান চৌধুরীর অবগাহন (২০০০), সিরাজুল ইসলাম মুনিরের পদ্মা উপাখ্যান (২০০৬), উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া রয়েছে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর কাঁদো নদী কাঁদো (১৯৬৮), অমিয়ভূষণ মজুমদারের গড় শ্রীখ- (১৯৫৭), রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নৌকাডুবি (১৩১৩ বঙ্গাব্দ), শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের তুঙ্গভদ্রার তীরে (১৩৭৩ বঙ্গাব্দ), প্রমথনাথ বিশীর কোপবতী (১৯৪১) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। প্রবাহমান নদী পারঘেঁষা মানুষের জীবনকিস্তির মতো। চিন্তাদূর জীবন, পরিণতি জানা, বাস্তবের সাথে খেলা, বয়সের মারপ্যাঁচ নেই মনোভূমিতে বুনে জীবনসংগ্রাম অস্তিত্বশীল চেতনা। ভেতরে একটা অবিবেচিত সময় পার করছে। নদীর গতিময়তার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের চিন্তাও নতুন রূপ পেয়েছে। বাহিত জলের কিনারে চর জাগে, চরদস্যু ভূমিখেঁকোরা দখল করে, ছন্নছাড়া পরিবার মাথাগোঁজার ঠাঁই থেকে বঞ্চিত হয়।ধাওয়া খেয়ে চর আর জলের কিনারে ঘুরঘুর করে শত গৃহহীন মানুষ শতশত জীবনের ঝুঁকি বহন করে খোঁজে আশ্রয়।
বাংলা সাহিত্যে নদ-নদীর চিত্র নানাভাবে এসেছে কিন্তু নদীঘনিষ্ঠ নাম ধরে নদীর অস্তিত্ব ঘোষিত হয়েছে বিশেষ উপন্যাস। নদী নারীর শরীরধারী। চঞ্চল রূপমোহনে আঁকিবুঁকি খায় শস্যশ্যামল, ভূমির মানচিত্র। জেলে-জেলেনি, কৃষাণ-কৃষাণী, মাঝিমাল্লা, বেদে জনগোষ্ঠীর বসতি, ভরা মৌসুমে ইলিশের আহরণ বালিচোর ও চর, খেয়া পারাপার, ভ্রমণপিয়াসুর হৈচৈ, ট্রলার ও ইঞ্জিনের হামাগুড়ি ব্যবসা-বাণিজ্যের ছুটে বণিকশ্রেণি, তীব্র ধ্বনিতে কেঁপে ওঠে পারের বসতি জীবনযাত্রার ঘনিষ্ঠ প্রতিমূতির্ নদী। নদীর সুর কখনো করুণ কখনো সরব আলোকচিত্রির ভাষায় নদী স্বপ্নলক্ষ্মী ও জীবনসঙ্গী। অন্যদিকে পুণ্যলাভে দেবীবিসজর্ন, স্নানও চলে নদীর অববাহিকায়। পদ্মা নদীর মাঝি, গঙ্গা ও তিতাস একটি নদীর নাম- তিনটি নদীর প্রতিচ্ছবি পাথর্প্রতিম বন্দ্যোপাধ্যায়ের বণর্নায় এরকমÑ
‘পদ্মা নদীর মাঝি গঙ্গা ও তিতাস একটি নদীর নাম উপন্যাসত্রয়ে যে মানুষ এসেছে তারা তো নদী অন্বিতই। নদী ছাড়া তাদের অস্তিত্ব নেই, নদী তাদের বাঁচা মরার, তাদের সাফল্য ব্যথর্তা, তাদের জয় পরাজয়ের অনিবাযর্ পটভূমি। লক্ষণীয় তিনটি উপন্যাসে জেলে মালোর জীবনের নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতার স্বপ্নে কৃষিবিশ্ব, চাষীর জীবন উঁকি মেরেছে কিন্তু নদীর সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা এ জীবন নদীর বাহিরে যেতে পারে না।’ নদী নামভিত্তিক প্রথম উপন্যাস পদ্মা নদীর মাঝি (১৯৩৬) পদ্মার মূল উৎস হিমালয়। উৎস থেকে ভারতে যে অংশ প্রবিষ্ট হয়েছে তা হলো গঙ্গা, বাংলাদেশের অংশের নাম পদ্মা। রাজশাহী জেলার পশ্চিম সীমানা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। দক্ষিণ পূবির্দকে প্রথমে গোয়ালন্দের নিকট যমুনার সঙ্গে পরে চাঁদপুরে মেঘনার সঙ্গে মিলিত হয়ে মেঘনা নামে বঙ্গোপসাগরে গিয়েছে। এই পদ্মাপাড়ের সংকীণর্ পল্লী, জেলে পাড়া, মাছ শিকার বিক্রি, দরদামে হঠকারিতা, পুজো, মেলার দ্রব্যাদি, রথের বৃষ্টি, প্রেম, ছন্নছাড়া জীবন, মাদকতা, পাশবিকতা, সরলতা, নীচতা বিশ্বাস চিন্তা বলা চলে সামগ্রিক জীবনের নিখুঁত বিষয়াদি উপন্যাসে পরতে পরতে চিত্রিত হয়েছে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এখানে নিজস্বশৈলীগুণ দেখিয়েছেন। কাহিনীর শুরুটা ছিল এরকমÑ এভাবে বাংলার অববাহিকায় পাঁচটি ঋতুর বণর্না, ময়নাদ্বীপে পৌঁছা আশা আবেগ অনুভূতি জীবনসংগ্রামের নানা রকম বিষয় বিবৃত হয়েছে। রূপকথা, বিভক্তসংস্কৃতি, নদীসংস্কৃতি, লোকবিশ্বাস প্রকাশ পেয়েছে। হোসেন মিঞার দৌরাত্ম্য, শীতলের ফন্দী, পীতম মাঝির নীরবতা এসব যেন মানিক নিঙড়ে নিঙড়ে উপস্থাপন করেছেন। প্রেম আনয়নে নতুনত্ব এসেছে। পরান ভরে দুজনের মনের বাসনা প্রকাশ করে, কুবের কপিলাকে পরান ভরে ভালোবাসে চরডাঙায় কপিলাকে একান্ত পেয়ে কুবের বলে তর লাইগা দিবারাত্র পরানডা পোড়ায় কপিলা ১৩৯। কপিলে কয়-আমারে ভুইলো মাঝিÑ পুরুষের পরান পোড়ে কয়দিন? গাঙের জলে নাও ভাসাইয়া দূর দ্যাশে যাইও মাঝি, ভুইলো আমারে।’ জীবনের চড়াই-উতরাইয়ের হিসেব-নিকেস চলে। মনে গাঁথে জীবনযুদ্ধের ইতিকথা, চরিত্রগুলো জল ও মাটির মতো নিবিড় কেমন করে তিনি মানুষের মনের কথাগুলো আপন যতেœ আঞ্চলিক ভাষায় পেশ করেন। কুবের মালা কপিলা, রাসু পীতম প্রভৃতিজনের ভাষা সম্পূণর্ ভিন্নভাষা। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নদীভিত্তিক উপন্যাস ইছামতি (১৯৫০) এতে রয়েছে জীবনবাস্তবতার স্থিরচিত্র। ঔপনাসিক তার গ্রামকে গ্রামের কাশবনকে নানা বণের্র ফুল ফলকে এবং গাঁয়ের ওপর দিয়ে বাহিত নদীকে জীবনের সঙ্গে বিনিয়ে উপস্থাপন করেছেন। নদী জীবন ও সময়ের প্রতীক এবং কালের সাক্ষী। বলা সমাজ বাস্তবতা ফোকাস হলো ইছামতি। অন্যান্য নদীভিত্তিক উপন্যাসের মতো এতেও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট রৈখিক ও তথ্যসমৃদ্ধ হয়ে ব্যক্ত হয়েছে। আফগান যুদ্ধ, তিতুমীর, নীল বিদ্রোহ, ছোট লাটের নদী পরিদশর্ন। এসেছে গতিময়তা, কালচেতনা চলমান প্রবাহমান ছবি গাঁও গেরামের ফুল-ফল পাখ-পাখালি, গৃহস্থ ওঠানামা, তরুণ-তরুণী গৃহস্থবাসীর হাসি কান্না নদী উপভোগের শান্ত সমাহিত ছবি। বষাের্ত নদী ফুলে ওঠে, চিনতে সহজ হয় বষার্ নদী ও তীরের মানুষের চিত্র ত্রয়ীবিন্যাস উপন্যাস নৈমিত্তিক সমাজ ও বাস্তবতার আকরে চিহ্নিত করে।
বণর্না এরকমÑইছামতি নদী বষার্র জলে কূলে কূলে ভতির্। খোকাকে নিয়ে গিয়ে একটা নৌকোর ওপর বসলেন ভবানী। দুই তীরে ঘন সবুজ বনঝোপ, লতা দুলছে জলের ওপর, বাবলার সোনালি ফুল ফুটেছে তীরবতীর্ বাবলাগাছের নত শাখায়। ওপার থেকে নীল নীরদমালা ভেসে আসে হলদে বসন্তবৌরি এসে বসে সবুজ বননিকুঞ্জের ও ডাল থেকে ডালে।… ইছামতি অত বড় নদী নয় কিন্তু ঔপন্যাসিক নদী মনের ডোরে বৃহৎ এবং নান্দনিকভাবে চিন্তা করতেন। এ চিন্তা তার প্রেমের আবেগ ও অনুভূতিনিভর্র। নদী সংযোগ যেমন বঙ্গোপসাগরে তার সংযোগ সাগরসঙ্গমের মতো বিস্তৃত ও সমাদৃত।
গ্রামকে কত ভালোবাসতেন তা তো তার উপন্যাসের উপাদান নিণর্য় অনুভূত হয়। বট, অশ্বথ, বৈচি, বাঁশঝাড়, গাঙ শালিকের গতর্ লতাগুল্ম কত জীবনঘনিষ্ঠ ছবি তা ভাবা যায়। শুধু তা-ই নয়Ñ জীবনসায়াহ্নে চিতার ছাই সুন্দরী বধূর পায়ের চিহ্ন, প্রৌঢ়ার পায়ের দাগ, নানা আয়োজনের তৈজস আছে এ নদীর জলে। ইতিহাস জীবন যৌবন মাখামাখি করে চঞ্চলবেগ সব মোহনাকে ছুঁয়ে গিয়ে মিশেছে বঙ্গোপসাগরে। অদ্বৈত মল্লবমের্ণর তিতাস একটি নদীর নাম (১৯৫৬) ছিন্নমূল মানুষের জীবনচিত্রের আলোকচিত্র। ভাসমান মানুষ, ছিন্নমূল মানুষ জীবন সম্পকের্ যাদের চিন্তা ক্ষীণ জীবনতৃষ্ণাই এ নদী। ইতিহাসের বিবরণ না থাকলেও মানুষের হাসি-কান্নার লোকসাহিত্য ও দৈনন্দিন জীবনের চিহ্ন রয়েছে। তিতাস পারের জীবন্ত চিত্র তুলে কালকে টেনে ধরে আনে এবং তীরবতীর্ মানুষের ধ্বংসের চিত্র নতুন যুগ ও সময়ের তালে তালে তুলে ধরেন। নৈসগির্ক হাওয়ায় বিরাজমান নদী তিতাস। মাঝারি নদী, পদ্মা মেঘনার মতো তার দানবীয় হুঙ্কার নেই। জলজীবনী নদী তেরো মাইল দূরে বিজয় নদী। তিতাস ও বিজয় নদীর সাথে পাড়ের মানুষের বন্ধন চিরকালীন। পুরুষের জীবিকা মাছ শিকার। নারীরা তাদের বহিরাগমনে ভয় পায় না। তারা মনে করে তিতাস শান্ত নদী তাতে ভয় নেই। এরা বামুন কায়েত নানান জাতের। জেলের ছেলেরা তাদের বউদের নদী পার করে ভাগ্যকে দোষারোপ করে। ছইয়ের ফাঁক দিয়ে বউ উঁকিঝুঁকি মারে অভিভাবকরা কাপড় টেনে দেয় বউ বাহির দেখে কিন্তু বাইরের লোকেরা বউ দেখে না। মালো নারী-পুরুষ সবার চোখে-মুখে বাঁচার লড়াই। প্রেমের দেবতা এখানে ফাঁদ পাতে কখন কোথায় কাকে গিঁট ধরায় তা কেউ জানে না।
নদীর বুক চিরে অনন্ত এলো মালো পাড়ায়। পড়াশোনো শুরু করে পাড়ি দিল শহুরের কোনো মালো পাড়ায় ফিরে ধানের আবাদ সবুজ পাতার শব্দ শুনে জনশূন্য পাড়ায় মরা মানুষের নিঃশ্বাসই বুঝি বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ সমাজ সত্যের প্রতিবিম্ব তিতাস নদী। পাড়বাসীর বসতি জীবনসংসার, বেড়ে ওঠা, উচ্চমধ্যবিত্তের চিন্তা-চেতনা তিতাসের জলে মিলে মিশে পাঠকমনকে স্পশর্ করেছে। পাঠক সহজেই নিজ জীবনের স্মৃতিমথিত বহু অলিগলি খুঁজে পায়। এ ধরনের রচনা খুব কমই বটে। এ বিষয়ে শান্তনু কায়সারের বণর্না এরকমÑ ‘তিতাস নদীর বণর্না দিতে গিয়ে অদ্বৈত মল্লবমর্ণ লিখেছেনÑ সে সত্যের মতো গোপন হইয়াও বাতাসের মতো স্পশর্প্রবণ। উপন্যাসের সম্পূণর্ পরিকল্পনাটিই একটি শৃঙ্খলায় আবদ্ধ।। অনন্তর মন যেমন মাছ হয়ে জলের গভীরে ডুব দেয় অদ্বৈত ও তেমনি বক্তব্যকে তার উপন্যাসের অন্তকাঠামোরই অংশ করে তোলেন। স্নিগ্ধ বাতাসের মতো কখনো কখনো তা আমাদের বোধের শিকড় ধরে নাড়া দেয়। কিন্তু কখনই উপন্যাসের শিল্পকাঠামোকে আঘাত করে না।’
আলাউদ্দিন আল আজাদের কণর্ফুলী (১৯৬২)। কাহিনীজুড়ে নদীতীরের মানুষের জীবনের টানাপড়েনের চিত্র। শব্দ এবং জীবনের বাঁক অঞ্চলের সঙ্গে মিশ্রিত। সবুজের সমারোহ, পাহাড়ের গড়ন, সাগরের সঙ্গম, সম্পানের ধেয়ে চলা, সচ্ছল জীবনের স্বপ্ন, পকেট মেরে জীবিকাজর্ন সহজ-সরল জীবনের চিত্র সামান্যভাবে এসেছে। পাঠকের আগ্রহ নদী নিয়ে সে নদীর তীরবতীর্ অঞ্চলের মানুষের সমাজ সংস্কৃতি বিষয়ে কিন্তু পাঠকের আগ্রহ ঘুরে যায় রোমান্টিকতার দিকে আঞ্চলিকতার বহরে। ধমীর্য় বেড়াজাল টপকে ইসমাইল চাকমা ধবলিকে বিয়ে করে। তার ইচ্ছা বড় হওয়া একারণে সে জীবনযুদ্ধে দিকবাদী সৈনিক। সে স্বপ্ন দেখে সারেং হবে স্বপ্নের ছক আঁকে সচ্ছল জীবনের। নদী নামকরণে সাথর্কতা কমতি হলেও রোমান্টিকতার ছাড় নেই, ইসমাইলের দৃষ্টি এবং ভালোলাগার কথা পাঠককে খাবলে ধরেÑ নদীর বৈচিত্র্য সবাইকেই মোহিত করে কাছে টানে হৃদয়ের সঙ্গে মিশে জীবনের গান গায়। নদীতে ভ্রমণ চলন, জীবিকা নিবাের্হর আবাদ, মাছের খনিজ উৎস, সে সময়ের তোড়জোড়ে সে পারে দখলদারের শকুনি নজর পড়ে, তীরবতীর্ অঞ্চলে গড়ে ওঠে দালান-কোঠা হাট-বাজার ঘর-বাড়ি আড়তঘর মজুদঘর,। নদী নাব্য হারায় সরু হয়ে যায় হারিয়ে যায় তার চিরায়ত রূপবৈচিত্র্য।
কণর্ফুলী উপন্যাসে- ‘এমনি চিকন গাং, এমন বনজঙ্গল পাহাড় টিবির ভিতরে এতবড় কা- ভাবতে পারিনি। গল্প শুনেছে কিন্তু সেভাবে যে আন্দাজ তা সামান্যই। বিরাট বাঁধ নদীকে আঁটকে রেখেছে ধারে ছোটখাটো একটা শহর। রেস্ট হাউস, অফিসারদের ঘর-বাড়ি মজুর বস্তি! স্কুল, সিনেমাহল, বাচ্চা-কাচ্চাদের খেলার মাঠ, সবই আছে মসজিদটাও দেখবার মতো।’
আবু ইসহাকের পদ্মার পলিদ্বীপ (১৯৮৬) পদ্মাপাড়ের জনজীবন শ্রেণি, পেশা, জাতিবণর্ কৃষিভিত্তিক ও কৃষিবহিভুর্ত পেশা, হিন্দু-মুসলমানের মাছ ধরা গ্রামীণ ক্ষমতা-কাঠামোর সন্ধান মেলে। চর দখলের চিত্র মামলা হামলা পুলিশি শাসন ভূমি মালিকদের চর দখলের ক্ষেত্রে দ্বন্দ্ব হিংসা বিদ্বেষ কলহ বিরোধ জগুরুল্লার চরিত্রের আদলে ঔপন্যাসিক গ্রাম বাংলার খেটে খাওয়া সহজ-সরল মানুষ যারা কুচক্রী মাতব্বরের হাতে বন্দি নিরুপায়ের দৃশ্য উঠেছে। দখল ও প্রতিরোধের চিত্র। চরভাঙে চর জাগে চরবাসী দখলের জন্য লাঠিকাঁধে হাঁক দেয়। পদ্মা অজগর স্রোত গিলে খায় সব জমি উন্মাদিনী পদ্মা গুণগাঁ, নমকান্দি বিদগাঁও, কাউনিয়াকান্দা, ডিঙ্গাখোলা লক্ষ্মীচর বুকে টেনে নিচ্ছে। সম্প্রতি টেনে নিচ্ছে নড়িয়ার অঞ্চল। ইতিহাসের ভয়াবহ ভাঙন বুঝে ওঠার আগে দালান-কোঠা, মসজিদ-মন্দির, খেলার মাঠ অজান্তেই প্রতিনিয়ত তলিয়ে যাচ্ছে নদীগভের্; নদী হলো ভাঙা-গড়ার খেলা। সে সময়ের বণর্না এরকমÑ‘চরের বসত আজ আছে কাল নেই। নদীর খেয়াল-খুশির ওপর নিভর্র করে চরের আয়ু। তার খুশিতে চর জাগে। তার খেয়ালে ভেঙে যায় আবার। এ যেন পানি আর মাটির চুক্তি। চুক্তি অনুযায়ী পাঁচ, দশ, বিশ বছরের মেয়াদে বুকের ওপর ঠাঁই দেয় পানি। মেয়াদ ফুরালেই আবার ভেঙে-চুরে নিজের জঠরে টেনে নেয়। চরবাসীরা তাই স্থায়ী হয়ে বসতে পারে না কোনোদিন। তাদের বাপ-দাদার ভিটে বলতে কিছু নেই। বাপ-দাদার কবরে চেরাগ জ্বালাবার প্রয়োজন হয় না তাদের কোনো দিন।’
সামাজিক অসামাজিক চিত্র উপন্যাসকে গতিময় করেছে। ফজল ও রূপজানের মহব্বত সব বাধাকে টেনে ভালোবাসার বন্ধনকে টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে। শ্বশুরের কবল জগুরুল্লার ফাঁদ তার সবল বাহুডোরে বন্দি করেছে। সে যখন পরম মমতায় বলে ওঠেÑ ‘আমার জোড়া বান্দা কইতর-কইতরি। এই দুনিয়া জাহানের কেও আমাগো জোড়া ভাঙতে পারবো না, কোনো দিন পারব না।’
উত্তরাধিকার বাংলা একাডেমি মাসিক পত্রিকা ১৯৮৭-তে প্রকাশিত- ‘পদ্মার পলিদ্বীপে চিত্রিত হয়েছে পদ্মার চরাঞ্চলের জীবন, এই জীবনের সঙ্গে আবু ইসহাক ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত।… তিনি একটি জটিল জীবনের চিত্র এঁকেছেন, এই জটিলতা সূযর্দীঘল বাড়িতে নেই। আবু ইসহাক পল্লীজীবনকে ঘনিষ্ঠভাবে জানেন। পদ্মার পলিদ্বীপে পল্লীজীবনের একটা বিশেষ দিক চরাঞ্চলের সংঘাতময় জীবনের কথা নিয়ে লিখেছেন’।
হারুন পাশা তিস্তা (২০১৮) নদীপাড়ের মানুষ ও নদীর অস্তিত্বসংকটের চিত্র অসময়ে প্রতিবেশী দেশের পানিহিস্যার হিসেব যাতে সাধারণ মানুষের জীবন বিপন্ন হয়ে যায়। জলের অভাবে সরু হয়ে ওঠা তিস্তা জীবনকেও খাটো করে দেয়। হঠাৎ জলের মিশেলে ভাঙে ধার নদী আবাদি জমি ঘরবাড়ি কেড়ে নেয়। গৃহহীন মানুষ ভিড় করে উত্তোলিত বালির বুকে খাস জমিতে। সরকারের প্রয়োজনে বোডর্ লাগানো হয়। আশ্রিতরা হাপিত্যেস করে মাথাগোঁজার জায়গা থাকে না শূন্যজীবন। জীবনচক্রে তারা বেহুশ। প্রকৃতির প্রতিকূলতার সঙ্গে জীবন ছুটছে কচুরিপানার মতো দারিদ্র্যের চাপে কৃষক। গরিবের পড়াশোনা সৎমায়ের সংসার, ভঙ্গুরজীবন কমবয়সে বিবাহ, উপযুক্ত পাত্রের অভাব, সংসারের টান, জমির বিনিময়ে কন্যাসম্প্রদান, পরিবতির্ত সমাজ ফেসবুক, ইমো কল, গোলাপ গ্রামের সাইতুনরের সঙ্গে মিরাজের প্রেম ও গভর্ধারণ, এনজিওর কিস্তি, পানির জন্য আন্দোলন, লংমাচর্ পানিশূন্যতার কারণে অনাবাদি জমি কৃষকের বেহালদশা তিস্তা তীরবতীের্দর জীবনযাপনের বিপযর্স্ত বহুমাত্রিক সমস্যা ঔপন্যাসিকের মননে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছে। চরিত্রগুলো তিস্তাপাড়ের মাটি বালুচর জলের সঙ্গে সঙ্গতিপূণর্।
তিস্তার পূবের্র চিত্র বণর্নায়… আগে নদীবতির্ পানি আছিন। নদীতে ডেউ আছিন। নাউ বাওয়া রিস্ক আছিন। নাউ পাহো পড়লে আর খুঁইজ্জা পাওয়া গেছে না। যা জিনিসপাতি আছিন সবই লইয়া গেছে। পিন্দনের কাপড় লইয়া বাড়িত আইছি। শইল্লো খালি হাফপ্যান্ট আর গেঞ্জি আছিন।
বতর্মান চিত্র বণর্নায়… ‘এ্যাহন তো নদী নাই। পানি নাই। ইনকাম নাই। বাড়িওয়ালির অসুখ। জয়েন্ডো জয়েন্ডো ব্যথা অষুধ খাওয়াইলে ব্যথা বালা অয়, না খাওয়াইলে আবার শুরু অয়। আতো ট্যাহা নাই, হ্যার লাইগ্গা চিকিৎসার বন্দ রাখছি।’
চাষাবাদের উপযোগী তিস্তা পারে ধান, গম, ভুট্টা ডাল বেশ হতো এখন তিস্তার নিঃশ্বাসে ভাটা পড়ায় কৃষি ও কৃষকের জীবনোপায় হ্রাস পেয়েছে। তিস্তা এবং দেবেশ রায়ের তিস্তাপাড়ের বৃত্তান্ত দুটো নামকরণে এক হলেও ভাষা ও অঞ্চলের চিত্র ভিন্নধমীর্। জল আছে জল নেই, অঞ্চলের বণর্না, তিস্তাতে পানির অভাবে বিধ্বস্ত গোটা বাংলাদেশের করুণচিত্র। নদী ভ্রমণ আনন্দের নদীতে পা পেল উদাসমনের, নদী ভাবের নদী আবেদনের, নদী মন গহীনের বেহুশ সুর, নদী বিরহের, নদী মিলনের, নদী মা নদী শিক্ষক নদী সীমানা নদী সময়ের রেখাচিত্র। তাই মনখোরাখের লোভে সব লোকই নদীকে কাছে টানে ছুটে চলে তার কিনারে। তিস্তাতে সে চিত্র এরকম- শেষ বিকেলে নদীর পাড়ে হাঁটলে দেখবেন ঠা-া বাতাস ছুঁয়ে যাচ্ছে। এ সময়টায় নৌকায় ঘুরলে নদী মানুষকে যে কত আপন করে নেয়। পানি থেকে ওঠা বাতাস দিনভর। জমা হওয়া দিনভর জমা হওয়া যন্ত্রণা মুছে দেবে।’
হরিপদ দত্তের শীতলক্ষ্যা (২০১০)। মাছমারা শ্রেণি ও অস্তিত্বসংকটে টিকে থাকার বৃত্তান্ত। ইতিহাসে প্রেক্ষাপট এসেছে দেশভাগ। শহরায়ন ও নগরায়ণের ফলে ঢাকা নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী শহর সম্প্রসারণ এবং যোগাযোগের ক্ষেত্রে দ্রুত উন্নয়ন ব্যাপক কল-কারখানা শ্রমিক বাসস্থান, আবাসন প্রকল্প গড়ে ওঠায় শীতলক্ষ্যা দেহ সংকুচিত হয়ে বজ্র্যজলে মাছ ও নদীতে বসবাসকারী নানা প্রজাতির প্রাণী বিপন্ন হচ্ছে। পরিবেশ হয়ে উঠছে বিষাক্ত ও ভারসাম্যহীন। এ দূষণে অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে ছুটে যাচ্ছে প্রতিবেশী দেশে। নদী মানে জলের পাশে হঠাৎ গড়ে ওঠা জাগানিয়া চর, উবর্র মাটি, সোনালি ফসল, মাছ, জলজ প্রাণী, জটহীন ভ্রমণ, শান্তি ও জীবনদশের্নর জলাভূমি।
অমানুষিক আচারে দস্যুতা, হীনতা, রাহাজানি দখল ও দৌরাত্ম্যকারীর ক্ষেপাঞ্চল। স্বাথাের্ন্বষী মহলে নদীর পাড়ে গড়ে তুলছে অনিরাপদ কল-কারখানা, ইটভাটা দূষিত হচ্ছে নদীমাতৃক অঞ্চল ছড়িয়ে পড়ছে বিষবাষ্প। গড়ে তুলছে ইমারত দম বন্ধ হয়ে নদী হারাচ্ছে তা ঐতিহাসিক অবয়ব। কেউ দখল করছে কেউ সুবিধার ইট মাথায় দিয়ে সুখনিদ্রা যাচ্ছে বোঝা বহনের অপেক্ষায় সিঁড়ির পর সিঁড়ি বাস্তবতা এই। এটুকু বাদ দিলে চিরায়ত বাংলার রূপ নদী জীবনের রঙ মাখে, মনের গাহন শুধায়।
শতবষের্র ইতিহাস দেখায় বিশালত্বকে নিবন্ধন করে প্রতিবাদে ভাষা শেখায়, শক্তিসামথ্র্যকে বুঝিয়ে দেয়, প্রাকৃতিক সম্পদের সাথে পরিচিত করে বাহনের ভ্রমণের মাঝে আনন্দ ও জীবনসংগ্রাম বহন করে। এ নদী কখনো ইতিহাস কখনো অভিশাপ মূলত আশীবার্দ। নদ নদী আছে বলে বাংলাদেশের মানুষকে বিশ্ব সহজভাবে আলাদা করে এবং অবাক হয়ে অন্যকে এই যে দেখছো নদীর দেশ এটাই বাংলাদেশ।
বাংলা সাহিত্যের বিবিধ শাখার মতো উপন্যাসে নদীপ্রসঙ্গ মুখ্য ও গৌণভাবে এসেছে। তবে নদী নামভিত্তিক উপন্যাসে নদীপারের সমাজ ইতিহাস ঐতিহ্য অস্তিত্বসংকট ও রক্ষা, দূষণ, ভাঙন, নিশ্চিহ্ন, মরা আধমরা বদলের ইতিহাস হারানোর চিত্র, জলশূন্যতা, পারবাসী নিশ্চিহ্নতা এবং জীবনশ্রমের ইতিবৃত্ত ঔপনাসিকের দরদীয় মানসিকতায় চমৎকার ও তথ্যসমৃদ্ধ হয়ে ধরা দিয়েছে। বিশেষ করে এসেছে তীরবতীর্ জনজীবনের আঞ্চলিক বয়ান। এ কারণে কোনো কোনো উপন্যাস সমাজ বাস্তবতার পাশাপাশি আত্মজৈবনিক রূপ পেয়েছে এখানে লেখকের শৈল্পিক দক্ষতার সচ্ছল প্রভাব লক্ষণীয়। নদীর সাথে জনজীবনের সম্পকর্ কালানুক্রমে বাংলা সাহিত্যে কবিতা গল্প নাটক উপন্যাস প্রবন্ধ প্রভৃতি শাখায় নদী প্রসঙ্গ সময়ের সাথে সাথে সম্পৃক্ত হয়েছে। সময়ের বিবতের্ন নদীর গতি মোড় নিয়েছে দখলদার’ দস্যু ও আধিপত্যকারীর ছোবলে বিপন্ন প্রায় নদী। মূল সীমানা ও চিরায়ত বাংলার নদীমাতৃক রূপবৈচিত্র্য রক্ষা করা সময়ের কণ্ঠবান।