শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:৫২ অপরাহ্ন

পদ্মা নদীর ইতিকথা

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ২৪ জুন, ২০২২

বাংলাদেশের উর্বরা ভূমিতে বিছিয়ে আছে অনেক নদ-নদী, খাল-বিল, হাওড়, ডোবা-পুকুর। আমাদের জীবন জীবিকার উৎস হিসেবে নদ-নদীগুলোর উদারতা অসীম। মৎস্য শিকার, যোগাযোগের মাধ্যম, বর্ষার প্লাবনের অবদানে গঠিত উর্বরা পলল ভূমি ও নানা কারণে একদা নদী পাড়েই গড়ে উঠত মানব বসতি। পদ্মা পাড়ের মহানগরীর উৎপত্তি এমনিভাবেই। রাজশাহী নগরীর জীবনের মোহনায় পদ্মা মিশে আছে আত্মীয়তার বন্ধনে। পদ্মার উৎপত্তি ধরণীর সর্ববৃহৎ পর্বতমালা হিমালয়ের গঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে। ভারতের হিমাচল প্রদেশে গোমুখ বিন্দুর কাছে বার হাজার আটশ ফুট উপরে অবস্থিত হিমালয়ের গঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে ভাগীরথী ও অলকানন্দা দুটি ধারায় বেয়ে আসে ।
ভাগীরথী ও অলকানন্দার মিলিত স্রোত গঙ্গা নামে দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হবার পর হরিদ্বারের নিকট সমতল ভূমিতে পড়েছে। তারপর ভারতের উত্তর প্রদেশ, বিহার ও পশ্চিম বঙ্গের বুকে বেয়ে আসার পর মুর্শিদাবাদের কাছে পদ্মা ও ভাগীরথী নামে দুটি শাখায় বিভক্ত হয় এবং ভাগীরথী নামেই ভারতের ভিতর দিয়ে বঙ্গোপসাগরের অথৈ লোনা জলে মিশেছে। এদিকে পদ্মা রাজশাহী অঞ্চলের পশ্চিম সীমানা দিয়ে আমাদের সবুজ ভূমিতে প্রবেশ করে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে প্রবাহিত হবার পর গোয়ালন্দের নিকট যমুনার সঙ্গে ও চাঁদপুরের কাছে মেঘনার সাথে মিলিত হয়ে মেঘনা নামেই বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। উৎসমুখ থেকে সঙ্গম পর্যন্ত পদ্মার (গঙ্গা) দৈর্ঘ্য ১৫৫৭ মাইল। উৎসমুখ থেকে হিমালয়ের প্রবাহ সীমায় যে উপ-নদী উৎপন্ন হয়েছে তাদের মধ্যে যমুনা, কালী, বর্ণালী, ঘর্মরা, গ-ক ও কুশী প্রধান। আর দক্ষিণের উচ্চ ভূমি থেকে উৎপন্ন উপনদীগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো চম্বল, বেতওয়া, শোনেন। এগুলো উত্তর ভারতের সমতল ভূমিতে আবারো গঙ্গার সাথে মিলিত হয়েছে। পদ্মার উপনদীগুলোর মধ্যে মহানন্দা ও পুনর্ভবা বাংলাদেশ ও পশ্চিম বঙ্গের উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পদ্মার শাখা নদীগুলোর মধ্যে ভৈরব, মাথাভাঙ্গা, কুমার, গড়াই, আড়িয়ালখাঁ ও প্রশাখার মধ্যে মধুমতী, পশুর, কপোতাক্ষ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।৩
রাজশাহীর ইতিহাস ও ঐতিহ্যের দ্বার উন্মুক্ত করলে পদ্মার অবদানের স্পষ্ট ছবি ফুটে উঠে। প্রাচীনকালে পদ্মা পাড়ের পলল ভূমিতে চাষাবাদ আর যোগাযোগের সুবিধার্থেই হয়তো রাজশাহী শহরে ভৌগোলিক অবস্থানে জনপদের সৃষ্টি হয়েছিল। কথিত আছে, রাজশাহীর পুণ্যভূমিতে পদ্মার কোলে শায়িত হজরত শাহ্ মখদুম রূপোশ (রহ.) কুম্ভীর (কুমির) বাহনে মহাকাল গড়ে (রাজশাহী) নাপিত দম্পতির নিকট এসেছিলেন পদ্মা দিয়েই।৮ সেকালে রাজশাহী থেকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যোগাযোগের শ্রেষ্ঠ পথ ছিল পদ্মা। মূল পদ্মা ও তার শাখা, উপ-শাখা দিয়ে রাজশাহীর যোগাযোগ ছিল এবং আছে পাবনা, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, ঢাকা, যশোর, খুলনা, বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে।৩ সুদূর ইউরোপ থেকে ওলন্দাজরা এ পদ্মার গায়ে ভর দিয়ে এ অঞ্চলে এসে রেশম ব্যবসা শুরু করেছিল। তা থেকেই রাজশাহী নগরীর সূচনা। তখন থেকেই রাজশাহী বাংলার উত্তরাঞ্চলের অন্যতম ব্যবসা কেন্দ্র ও নদী বন্দরের খ্যাতি লাভ করে। দেশ বিদেশের ছোট বড় জাহাজ, নৌকা নোঙ্গর করে বিভিন্ন মালামাল খালাস ও ভর্তি হত রাজশাহীর পদ্মার তীরে। বর্তমান তালাইমারী ও কুমারপাড়া ছিল জাহাজ ও স্টিমার ঘাঁটি। সেকালে যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম ছিল পানি পথ। যোগাযোগের সুবিধার্থে ব্রিটিশ শাসক পদ্মার তীর রাজশাহীতেই প্রশাসনিক অফিস, আদালত ও বাণিজ্য ঘাঁটি স্থাপন করেছিল। তাই রাজশাহী নগরী সৃষ্টির পিছনে পদ্মার অবদান অনস্বীকার্য। দেশ স্বাধীনের পরও রাজশাহী চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভুবন বিখ্যাত আম, সকল প্রকার পণ্য ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নিয়ে যেত পদ্মার বুক দিয়েই। বড় বড় ছৈ তোলা নৌকা স্রোতের অনুকূলে পাল খাটিয়ে মাঝি মাল্লারা ঢেউ-এর তালে তালে ভাটিয়ালী গান গেয়ে নৌকা বায়তো। রাজশাহী শহরতলী বশড়ি গ্রামের ছেলে-মেয়েরা এককালে পদ্মা তীরে মাঝি-মাল্লাদের আনন্দের সাথে নিজেরাও গায়তো-
ঢাক্কা ঢোলের লা
কোল্লে কোল্লে যা
কোল্লে আছে লাল ছেলে
তুল্লে নিয়ে যা।
বাণিজ্য ছাড়াও অন্যভাবে আর্থিক সাহায্য করতো পদ্মা । পদ্মায় এক সময় পাঙ্গাস, বাঘাড়, বোয়াল, ইলিশ প্রভৃতি মাছ পাওয়া যেত। নদীতে ঘোলা জল পড়লেই পদ্মায় ইলিশ ধরার ধুম পড়ে যেত। জেলেরা সাধারণত ডিঙ্গি নৌকাকে বাহন করে বেড়াজাল দিয়ে নদীতে মাছ ধরতো। আর ইলিশ ধরার জন্য ব্যবহৃত হতো নদীর ধারে জোরালো স্রোতের জায়গায় লম্বা বাঁশে বাধা খোপার মতো জাল। এটা বাঁশজাল নামেই পরিচিত। মাছ ধরাকে কেন্দ্র করেই রাজশাহী মহানগরীর পদ্মার পাড় ঘেঁষে গড়ে উঠেছিল বিরাট জেলে পাড়া। মধ্য মহানগরীর এক জায়গায় অনেক জেলে বাস করতো। এর নাম মালোপাড়া। কোর্ট অঞ্চলে গুড়ি (গোঁড়ি) নামে জেলে গোষ্ঠী বাস করতেন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর গুড়িরা ভারত চলে গেলেও এখনও মহল্লাটি গুড়িপাড়া নামে পরিচিত। পদ্মায় পূর্বের মত মৎস সম্পদ আহরণ না হলেও এখনও নগরীর বুলনপুর, শ্রীরামপুর প্রভৃতি এলাকায় অনেক জেলে বাস করেন এবং নদীর ছোট বড় মাছ ধরে নগরবাসীকে টাটকা মাছ যোগান দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন।
কৃষি কর্মেও পদ্মার উভয় পাড়ের অবদান অতুলনীয়। পদ্মার চরে নগরীর অনেকের কৃষি জমি আছে। প্রতি বছর ধান, কলাই, বুট, মশুর প্রভৃতি ফসল ফলিয়ে সেখান থেকে তারা রুজি সংগ্রহ করেন। সে সব ফসল কাটা-মাড়া ও ওপার থেকে এপারে নিয়ে আনার জন্য নৌকা ব্যবহার করে অনেক মুটে-মুজুর তাদের জীবিকা নির্বাহ করেন। এছাড়াও পদ্মার বড় অবদান হলো খরা মৌসুমে নগরীর পার্শ্ববর্তী ও বরেন্দ্র অঞ্চলের ফসলী জমি শুকিয়ে গেলে আবাদের ব্যবস্থায় এর পারিন ব্যবহার। পদ্মার পানি সম্পদকে উপযুক্ত ব্যবহারের জন্য পাক্ আমলে পানি উন্নয়ন বোর্ড পদ্মার সাথে অনেক খাল খনন করে আবাদী জমির সঙ্গে সেচ ও নিষ্কাশণের ব্যবস্থা করেছিল। জিয়াউর রহমান সরকারের আমলেও খাল খনন কর্মসূচি গ্রহণ করে সুফল পাওয়া গিয়েছিল। তাছাড়াও শাখা-উপশাখা দ্বারা বর্ষার সময় পদ্মার ঘোলা জল প্রবেশ করে দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে এবং ফসলী জমিগুলোকে পলল দ্বারা উর্বর ও সিক্ত করে। নগরীর মানুষকে আর্সেনিক মুক্ত পানি সরবরাহের জন্য রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন পদ্মার পানি শোধনের জন্য পানি বিশুদ্ধকরণ বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতো। বর্তমানে নগরবাসীকে পানি সরবরাহ করছে রাজশাহী ওয়াসা। তারাও পদ্মার পানি ব্যবহারের বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। তবে পদ্মা পূবের্র মতো নাব্যতা নেই।
পদ্মার অবদান অপরিসীম হলেও কখনও সে পাগলা ঘোড়ার মত ক্ষেপে উঠে নদীর পাড় ধ্বংস করে। মহানগরীর অনেক মহল্লা, প্রথম বাজার, পরবর্তী বাজার সাহেবগঞ্জ, ইংলিশ স্কুলের (কলেজিয়েট স্কুল) প্রথম ঘর, জেলা প্রশাসনের প্রথম কার্যালয় প্রভৃতি পদ্মার গহবরে তলিয়ে গেছে।
ভারত সরকার পশ্চিম বাংলার ফারাক্কায় গঙ্গার উপর ব্যারেজ তৈরি করার পর পদ্মার পূর্বের রূপ আর নাই। পূর্বের মত আর ডিম ভরা ইলিশ ধরা পড়ে না। বর্ষা মৌসুমে পদ্মা টইটম্বুর হলেও রেল ও সড়কের উন্নতির ফলে জাহাজগুলো এখন প্রবীণদের স্মৃতির রোমন্থন মাত্র। তবে রাজশাহীবাসীর সাথে পদ্মার হৃদ্যতার ভাটা পড়েনি; রবং ক্রমশ উসকে উঠছে। রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন ও বেসরকারি উদ্যোগে নগরীর ধার ঘেঁষে পদ্মার দীর্ঘ পাড়ে গড়ে তুলছে সবুজ কারুকার্য। রাজশাহী মহানগরবাসী চিত্তবিনোদনের অন্যতম কেন্দ্র হিসেবে বেছে নিয়েছে পদ্মা পাড়। নীল আসমানের নিচে ওপারের সবুজ কাঁশবন, কখনও শান্ত পদ্মার নির্মল বাতাস, কখনও ভাঙ্গা ভাঙ্গা ঢেউ এর নাচন, প্রতিদিন স্বান্ধ্য প্রদীপ নেভার মতোই পশ্চিমাকাশে রক্তিম সূর্য ডোবা দেখার নেশায় হাজারো মানুষ ছুটে আসে পদ্মার মনোমুগ্ধ প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে। শুধু নগরবাসী নয়; দেশ-বিদেশের পর্যটকরাও নগরীর উপকন্ঠ বাধ ও সারা তীরে পদার্পণ করে পদ্মাকে ধন্য কওে তোলে। দিন বদলের পালায় সেকালের পদ্মা আর আজকের পদ্মার সাথে মানুষের জীবন কর্মের তফাৎ হলেও সম্পর্কের বিভেদ ঘটেনি। রাজশাহী নগরীর উৎস মুখ পদ্মা।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com