সৈয়দ আলী আহসান তার কাব্যসমগ্র এবং কবিতার কথা ও অন্যান্য বিবেচনা গ্রন্থে কবিতা রচনার কৌশল প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তার আলোচনায় কবিতার ভাব এবং ভাব প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে ভাষা এবং শব্দচয়ন সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। তিনি বলেন- ‘সমস্ত শিল্পই বস্তুনির্ভর উপাদানের মাধ্যমে প্রকাশিত বোধের সামগ্রী মাত্র। কবিতার ক্ষেত্রে তার মাধ্যম যে শব্দ, তা বোধ বা ধারণার প্রতীক।’ এ ছাড়াও তিনি মনে করেন, একজন কবি যখন কবিতায় কোনো শব্দ ব্যবহার করেন, তিনি ওই শব্দের অর্থ গ্রহণ করার সক্ষমতা, অর্থাৎ অর্থ সম্প্রসারণের সম্ভাবনাকে বিবেচনা করেন। কবিতার ক্ষেত্রে সচেতনভাবে শব্দ ব্যবহার করার রীতি যদিও প্রচলিত, তবু কবিতা কোনো বিশেষ ভাষায় কথা বলে না। কবিতার ভাষা মূলত অনুভূতিসাপেক্ষ এবং অনুভূতি অভিজ্ঞতাসাপেক্ষ। ফলে অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ, তথা কবিতা, কবিতার ভাষাঅভিজ্ঞতাকে অতিক্রম করে না। ক্রোচকে উদ্ধৃত করে সৈয়দ আলী আহসান বলেন- ‘মানুষ প্রতি মুহূর্তে কবির মতো কথা বলে। কেননা, কবির মতোই সে আপন অভিজ্ঞতা ও অনুভূতিকে প্রকাশ করতে তৎপর। নিজস্ব বাগধারায় কথা বলেও মানুষ মূলত প্রতিনিয়ত শব্দসমূহের স্বতন্ত্র অর্থ সৃষ্টি করে চলেছে। সাধারণ মানুষ এই আপন মানবীয় বোধেই কবির সমধর্মী।’ কবিতার মূল বা অন্যতম আশ্রয় যদি কোনো ভাব হয়, তাহলে এই ভাবের বাহন ভাষা, তথা শব্দ। সৈয়দ আলী আহসান এই কথার পুনরাবৃত্তি করেন এভাবে- ‘ভাস্কর্যের সাধন যেমন প্রস্তর, চিত্রকলার উপায় যেমন বর্ণ, সংগীতের বাহন যেমন ধ্বনি, কবিতার উপাদান তেমনি শব্দ।’ সৈয়দ আলী আহসানের মূল্যায়নে শব্দ কবিতার যতই মূল্যবান উপাদান হোক না কেন, পাথরের গুণাগুণ পর্যবেক্ষণ করে যেমন ভাস্কর্যের শিল্পমান নির্ণয় করা যাবে না, তেমনি কেবল শব্দ নিরীক্ষা করে কবিতার শিল্পসমৃদ্ধি নির্ধারণ করা যাবে না। যদিও পাথরের বৈশিষ্ট্যের ওপর ভাস্কর্যের অনেক কিছুই নির্ভর করে, একই বক্তব্য কবিতা এবং শব্দ প্রসঙ্গেও। সৈয়দ আলী আহসান কবিতার কলাকৌশল প্রসঙ্গে আলোচনার অধিকাংশজুড়েই শব্দ নিয়ে আলোচনা করেছেন। সম্ভবত শব্দকে তিনি দেখতে চেয়েছেন কবিতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে, ফলে তিনি কবিতায় শব্দের শক্তি ও সম্ভাবনাকে বহুদূর পর্যন্ত প্রসারিত করেছেন। শব্দের শরীরে তিনি অভিনব দীপ্তি সঞ্চার করেন, যা তার কবিতায় ব্যবহৃত শব্দাবলিকে আভিধানিক পরিবৃত্তির বাইরে পরিভ্রমণে প্রাণিত করে।
মৌনতার আবেগ: তিনি বিশ্বাস করতেন, অর্থের নতুনতর ব্যঞ্জনার জন্য আশ্চর্য কোনো শব্দ ব্যবহারের প্রয়োজন নেই। প্রচলিত যে কোনো শব্দই প্রয়োগের কৃতিত্বে বিশেষ ব্যঞ্জনা তৈরি করতে পারে। মূলত তিনি শব্দ ব্যবহারের সচেতনতা প্রসঙ্গে গাম্ভীর্যপূর্ণ অপ্রচলিত শব্দ ব্যবহারের পক্ষপাতী ছিলেন না, বরং যে কোনো শব্দকে সচেতনভাবে ব্যবহার করে তার অর্থ সম্প্রসারণের ব্যাপারে মনোযোগী ছিলেন। কেননা অতি সাধারণ একটি শব্দও হয়ে উঠতে পারে মহাকাব্যিক ব্যাপ্তিসমৃদ্ধ, একটি মুহূর্তের মধ্যেই মূলত থাকে মহাকাল-
যেহেতু সৈয়দ আলী আহসান বিশ্বাস করতেন শব্দকে এমনভাবে ব্যবহার করা উচিত যেন তা অর্থের সম্প্রসারণে সক্ষম হয়, তাই তিনি নিজে শব্দ সংক্রান্ত বিষয়ে সবসময় সাবধান থাকতেন। নির্বাচিত শব্দ প্রয়োগের মানসিকতা তার কবিতায় প্রভাব বিস্তার করতো। এই মানসিকতার ব্যাপক চর্চা একসময় তার মধ্যে এক বিশেষ বোধের জন্ম দিয়েছে, ফলে সাহিত্যিক জীবনের প্রথম পর্যায়ে লেখা কিছু কবিতা তিনি ‘বর্জন’ করেছেন, যেগুলোতে তিনি অর্থের বিস্তার খুঁজে পাননি। ১৯৪০-৪৪ সাল পর্যন্ত সময়ে তার লেখা কিছু ইসলামি ভাবধারার কবিতা এই তালিকায় রয়েছে। মূলত এই সময়পর্বে তিনি উন্মেষপর্বের ইসলামের ভাবাবহ সমৃদ্ধ কিছু কবিতা লিখেছিলেন। যদিও কেবল এই সময়কার কবিতাগুলোই নয়, সৈয়দ আলী আহসানের সমগ্র সাহিত্যজীবনেই ধর্মীয় অনুষঙ্গের অনুবর্তন পাঠকের দৃষ্টি এড়ানোর কথা নয়। ধর্মীয় অনুষঙ্গের উপস্থিতিতে কবিতার বলিষ্ঠতা যুক্ত হতে পারে বলে মনে করেন তিনি। আলী আহসান বলেছেন, ‘ধর্মীয় আবেগ কবিতাকে অনেক সময় বলিষ্ঠ করে। ধর্মীয় আবেগের প্রেরণায় মহৎ কবিতাও হতে পারে। ধর্মীয় আবেগের উচ্ছ্বলতায় কবিতার একটা ভাবাবহও নির্মিত হতে পারে।’ উদাহরণ হিসেবে তিনি ইংরেজি কবিতার দিকে দৃষ্টি দিতে বলেছেন, উল্লেখ করেছেন টিএস এলিয়ট এবং এডিথ সিটওয়েলের কথা। কারণ আধুনিকতার যাবতীয় অনুষঙ্গের নিবিড় পরিচর্যা সত্ত্বেও ‘জীবন সম্পর্কে যে বিশ্বাসের দ্বারা এরা উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন, সে বিশ্বাস হচ্ছে ক্যাথলিক ধর্মীয় বিশ্বাস।’ যাহোক, ইসলামি আবহের কবিতা হওয়ায় প্রাসঙ্গিকভাবেই আরবি এবং ফারসি ভাষার শব্দবাহুল্য এই কবিতাগুলোর বৈশিষ্ট্য ছিল। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন- ‘বিদেশি শব্দগুলো আমার কবিতায় নতুন তাৎপর্য বহমান হয়নি। উপরন্তু শব্দগুলোর নিজস্ব ঐতিহ্যের সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটেনি। তাই সে সময়ের কবিতাগুলো আমি-পরবর্তী পর্যায়ে গ্রহণ করিনি।’
উন্মেষ-লগ্নের অসম্পন্নতার স্মারক হিসেবে এ পর্যায়ের কবিতাসমূহ কবির রচনা সমগ্রের অন্তর্গত না হলেও এ সম্পর্কে সাঈদ-উর রহমানের মত হচ্ছে, আলী আহসানকে অনুধাবনের জন্য ওই অবহেলিত প্রয়াসকেও গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করা প্রয়োজন, কারণ ওগুলো আলোচনার মধ্য দিয়ে সেকালের সাংস্কৃতিক পরিবেশের সন্ধান কিছুটা পাওয়া যাবে। সৈয়দ আলী আহসানের কাব্যকৌশলের বিবর্তন সম্পর্কে কৌতুহলী পাঠকদের জন্য কবিতাগুলোকে কবি অনুজ সৈয়দ আলী আশরাফ চাহার দরবেশ ও অন্যান্য কবিতা শিরোনামে সংকলিত করেছেন।
তরুণ প্রজন্ম সাহিত্যের প্রতি কতটা আগ্রহী? যেহেতু সৈয়দ আলী আহসান স্বয়ং কবিতাগুলোকে ‘বর্জন’ করেছেন, ফলে এই প্রসঙ্গে অধিক আলোচনা বাহুল্য। তবে ভূমিকায় এই আলোচনা প্রাসঙ্গিক এ কারণে যে, আজকের নিবন্ধে আমরা এই বর্জিত কবিতাগুলোর সমসাময়িক কিছু কবিতা নিয়ে আলোচনা করব, যেগুলো আরবি-ফারসি শব্দবহুল ভাষায় লেখা নয় এবং উল্লেখ্য, কবির শব্দের অর্থ সম্প্রসারণ ক্ষমতা সংক্রান্ত বোধোদয়ের পূর্বে লেখা। এসব কবিতার উপজীব্য বিষয়- সমাজ, সংকট, মানবতা, সচেতনতা, প্রতিবাদ এবং প্রেম। এর অধিকাংশই সওগাত পত্রিকায় প্রকাশিত এবং কিছু কিছু সমসাময়িক অন্যান্য পত্রিকা ও সাময়িকপত্রে প্রকাশিত।
রাত্রি তখন হয়তো কিছুটা গভীর নিঝুম হবে
তুমি আর আমি কথা কত শত বলিতেছিলাম যবে
বলিতেছিলাম মনের মাধুরী মাখি,
বলিতেছিলাম প্রণয়ের কথা গভীর গভীর অতি।
দুইটি রজনীগন্ধা ; সওগাত, ফাল্গুন, ১৩৪৮।
উল্লিখিত কবিতাগুলোতে কবির বয়সাভিজ্ঞতার প্রভাব স্বভাবতই বিদ্যমান। সদ্য যৌবনে উত্তীর্ণ হওয়ায় কবিতায় দ্রোহ, প্রেম প্রভৃতি বিষয়বস্তুর ব্যাপকতা বিদ্যমান। নিজের কবিসত্তার অপরিণতির কারণে পূর্ববর্তী কবিদের দ্বারাও ব্যাপকভাবে প্রভাবিত ছিলেন, বলাই বাহুল্য। যদিও অতি অল্পকাল পরেই সৈয়দ আলী আহসান বাংলা কবিতায় আবির্ভূত হয়েছেন স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর নিয়ে। পরবর্তীকালের বাংলা কবিতায় সৈয়দ আলী আহসানের কণ্ঠস্বর ব্যতিক্রমী ও ব্যক্তিত্বচিহ্নিত। সাহিত্যিক জীবনের প্রথম পর্বে ইসলামি ভাবাবহকে প্রমাণ করার জন্য আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহারে তিনি অতৃপ্তই থেকে গেছেন। তাই তিনি নতুন আবহ ও নতুন শব্দভা-ারের সন্ধান করেছেন। পরবর্তী সময়ে সৈয়দ আলী আহসান বলেছেন- ‘বাংলা কবিতার শব্দ ভা-ার থেকে এবং সংস্কৃত সাহিত্যের ঐতিহ্য থেকে আমি প্রধানত শব্দ নির্বাচন করেছি। এই শব্দ নির্বাচনের ক্ষেত্রে ভারতবর্ষের বিভিন্ন সাধন পদ্ধতির ইচ্ছা এবং অনুজ্ঞার ভাষা আমি গ্রহণ করেছি। এর ফলে আমার কবিতার ভাষার এমন একটি রূপ ফুটে উঠেছে যা একান্তই আমার, কোনক্রমেই অন্য কারও নয়।’
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং দুর্ভিক্ষের প্রেক্ষাপটে লেখা সৈয়দ আলী আহসানের বেশ কিছু কবিতা তৎকালীন সওগাতে প্রকাশিত হয়েছিল, পাশাপাশি নবযুগেও প্রকাশিত হয়েছিল বেশ কয়েকটি। এরকমই একটি কবিতা ‘নতুন সূর্যের দিন’। এই কবিতায় মনসুর ও রওশন- দুইটি চরিত্রের সংলাপের মাধ্যমে কবি সে সময়কার সমাজ সংকটের স্বরূপ তুলে ধরেছেন-
রওশন :
নতুন সূর্যের দিন জ্বলিতে তখন;
নতুন উচ্ছ্বাস আর প্রাণ অগণন
নতুন পথের প্রান্তে সত্য হয়ে উদিবে আবার
রুদ্ধ হবে সশঙ্কিত অঙ্গনের দ্বার।
সওগাত, মাঘ, ১৩৫১।
কাছাকাছি সময়ে প্রেমেন্দ্র মিত্র সম্পাদিত নিরুক্ত সাহিত্য পত্রিকায় ‘প্রশ্ন’ কবিতাটি ছাপা হয়েছিল। কবিতায় সমাজ সংকটের সাপেক্ষে প্রতিবাদী প্রশ্ন উচ্চারিত হয়েছিল। এরকমই আরেকটি কবিতা ‘ক্ষমা নাই ক্ষমা নাই’, সওগাত, আশ্বিন, ১৩৪০-এ প্রকাশিত।
ক্ষমা নাই, ক্ষমা নাই
অভিযোগ অভিমান সবকিছু জমা থাকা চাই
কালের প্রত্যন্ত পথে সহসা আসিয়া থামি যদি
জীবনের সব স্বাদ, আলোকের সব পরমাণু
সব যদি ভুলে যাই, তবুও তো ক্ষমা নাই
অভিযোগ থেকে যাবে, হেতু আছে নয়কো বৃথাই।
এই কবিতার শব্দ ব্যবহারের বিশিষ্টতা লক্ষণীয়, ছন্দচয়নও অত্যন্ত গতিশীল। এইসব কবিতাগুলো যে সময়ে কবি লিখছিলেন, তখন তিনি এলিয়টের কবিতা দিয়ে প্রভাবিত ছিলেন। তিনি এইসময় এলিয়টের বেশকিছু কবিতাও অনুবাদ করেছেন। এলিয়ট ছাড়াও তিনি ওয়েলসলি, সিডি লুইস প্রমুখের কবিতাও অনুবাদ করেছেন। সৈয়দ আলী আহসান এলিয়টের বিখ্যাত ঔড়ঁৎহবু ড়ভ ঃযব গধমর গধমর কবিতার অনুবাদ করেছেন ‘নবজাতক’ শিরোনামে। এই সময়ে প্রকাশ হওয়া অনুবাদগুলোতে ভাষার প্রাঞ্জলতা আর শব্দ ব্যবহারের নানা রকমের নীরিক্ষা আছে-
শীত এসেছে
যাত্রীদের পক্ষে বৎসরের
একান্ত দুঃসময় এটা-
যাত্রাপথও তো স্বল্প নয়;
পথ অনন্তবিস্তারি, আবহাওয়ার
অবস্থাও ভালো নয়।
স্থবির শীত সময়েরে করেছে আঘাত
উট চলতে চায় না পথে
ক্লান্ত, ক্লান্ত হয়ে সে শুয়ে পড়ে গলিত তুষার প্রবাহে।
সওগাত, ফাল্গুন, ১৩৫২।
এই সময়পর্বের কবিতাগুলোর পর সৈয়দ আলী আহসানের কবিতায় শব্দচয়নের সচেতনতা আরও বৃদ্ধি পায়। ফলে তার কাব্যচেতনা ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়ে যায়। আমরা সৈয়দ আলী আহসানের যে সময়কার কবিতা নিয়ে কথা বলছি, সে সময়ে তিনি কিছু গল্প এবং প্রবন্ধও লিখেছেন। এসব গল্পেরও মূল উপজীব্য ছিল প্রেম এবং সামাজিক সংকট। ‘রহিমা’ শিরোনামের গল্পটির কথা উল্লেখ করা যায়- সওগাতে প্রকাশিত গল্পটিতে লেখকের সমাজ সচেতনতার চিহ্ন বর্তমান। একটি মানবিক দায়বোধ নিয়েই গল্পটি আরম্ভ হয়েছে-
আজ সারাদিন ধ’রে শুধু ভাবছি যে, যারা অসহায় দুর্বল, তারা দগ্ধ হচ্ছে প্রতিনিয়ত। কেউ তাদের বাঁচাবার চেষ্টা করছে না। কারও মনে হয়তো সদিচ্ছা জাগছে, কিন্তু তা মরে যাচ্ছে মুহূর্তেই। প্রকাশ্যে আমরা কমিউনিস্ট, সমাজসেবী ও আরও কত কী, কিন্তু মনে প্রাণে আমরা বুর্জোয়া। সওগাত, আষাঢ়, ১৩৫১।
মূলত সওগাতে প্রকাশিত গল্পগুলো ছিল সামাজিক সংকটকে কেন্দ্র করে, অন্যদিকে মোহাম্মদীতে প্রকাশিত গল্পগুলোর অধিকাংশই প্রেমকেন্দ্রিক। এই সময়ে লেখা তার প্রায় সব গল্পই পারিবারিক আবহকে কেন্দ্র করে রচিত। সওগাত, ভাদ্র, ১৩৪৯ সংখ্যায় প্রকাশিত আরেকটি গল্প- ‘জন্মদিন’। এই গল্পের মঞ্চও পারিবারিক পরিবেশকে কেন্দ্র করে। তার সমসাময়িক গল্পকাররা সবাই, যেমন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্, শওকত আলী, আবু রুশদ প্রমুখ লেখকগণ গল্প লিখে ব্যাপক নন্দিত হলেও সৈয়দ আলী আহসান গল্প বা উপন্যাসের দিকে খুব বেশি অগ্রসর হননি। অল্পসংখ্যক গল্পের প্রায় সবগুলোতেই পরিবার এবং ব্যক্তিঅভিজ্ঞতা প্রাধান্য পেয়েছে। ফলে এমন মন্তব্য করা যেতে পারে যে, সৈয়দ আলী আহসান কথাসাহিত্যে নিজের জীবন অভিজ্ঞতা এবং পারিবারিক বৃত্তের প্রভাবকে অতিক্রম করে উঠতে পারেননি। এমনকি পরিণত বয়সে জিন্দাবাহারের গলি নামে যে উপন্যাসটি তিনি লিখেছেন, সেটির কাহিনিতেও তার বাল্যজীবনের অভিজ্ঞতার ছাপ প্রত্যক্ষ করা যায়। কেননা, পারিবারিক পরিম-লের বাস্তবতা প্রত্যেকের শিল্পসাধনায় স্বতন্ত্র পথনির্দেশ করে, তেমনি শিক্ষাজীবন ও কর্মজীবনের প্রকৃতিও তাঁদের মানসভুবনকে ভিন্ন দ্রাঘিমায় প্রতিষ্ঠা দিয়ে থাকে। যে চেতনার রঙে কল্পবিশ্বে বাস্তবের প্রতিবিম্ব ধরা পড়ে, সেই চেতনার ভিত্তিভূমিতেও শৈশব-কৈশোরের নানা ঘটনার ছায়াপাত লক্ষ্য করা যায়।
সাহিত্যিক জীবনের প্রথম পর্যায়ে তিনি যে কবিতা লিখেছেন, গল্প লিখেছেন, অনুবাদ করেছেন, তার পাশাপাশি তিনি কিছু সাহিত্য সমালোচনা বিষয়ক প্রবন্ধও লিখেছেন। এসব প্রবন্ধ সওগাত, নবযুগ, মোহম্মদী, পত্রিকায় নিয়মিত ছাপা হতো। সৈয়দ আলী আহসানের সাহিত্যিক জীবনের অন্যতম
কৃতিত্বপূর্ণ অধ্যায় তার সমালোচনা সাহিত্যে কীর্তিসমূহ। সাহিত্য সমালোচক হিসেবে উত্থানের সময়কার একটি ঘটনাকে সৈয়দ আলী আহসান এভাবে বর্ণনা করেছেন- “আমার একটি লেখা সুধীন দত্ত ‘পরিচয়’ পত্রিকায় ছেপেছিলেন ১৯৪১ সালে, যখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। প্রবন্ধটি কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ওপর। দীর্ঘ প্রবন্ধটি ‘পরিচয়’-র অনেক পাতা দখল করে রেখেছিল। আমার সৌভাগ্য যে, এখানে সুধীন দত্ত আমার প্রবন্ধটি ছেপে আমাকে বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে স্বাগত জানিয়েছিলেন।”
এ সময় তিনি বেশকিছু প্রবন্ধ লিখেছিলেন, যা সওগাত, নবযুগ ইত্যাদি পত্রিকায় নিয়মতি ছাপা হয়েছে। সওগাতে প্রকাশিত তার কয়েকটি প্রবন্ধের মধ্যে আছে- ‘রোহিনী’, ‘কবিতার বিষয়বস্তু’, ‘কালি-কলমের প্রথম বর্ষ’ ইত্যাদি। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বিখ্যাত চরিত্র রোহিনীকে নিয়ে লেখায় চরিত্র বিশ্লেষণে সৈয়দ আলী আহসান বিশিষ্টতার পরিচয় দিয়ে প্রশংসিতও হয়েছেন। এ সময়েই সৈয়দ আলী আহসান সাহিত্য সমালোচনার প্রথম পদক্ষেপগুলো নিয়েছিলেন, পরে যে পরিচয়ে তিনি সমধিক পরিচিত হয়েছিলেন। সাহিত্য সমালোচনায় তার অবদান স্বতন্ত্র আলোচনার দাবিদার।
মূলত সৈয়দ আলী আহসানের সাহিত্যিক জীবনের প্রথম পর্যায়ের সাহিত্যিক প্রবণতা আলোচনা- পর্যালোচনা করাই এই লেখার উদ্দেশ্য। কেননা, প্রথম পর্যায়ের সৈয়দ আলী আহসানই পরিণত কবি সৈয়দ আলী আহসানের সাহিত্যিক জীবনের ভিত্তিমূল। তাই তার প্রাথমিক জীবনের সাহিত্যিক সত্তা এবং এই সত্তার প্রবণতা পর্যবেক্ষণ করা জরুরি। সৈয়দ আলী আহসানের উত্থানপর্বের সময়টা এমন, যখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ক্ষত মুছে না যেতেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ভয়াল থাবা বাগিয়ে এগিয়ে আসছে। এর প্রভাব তৎকালীন ব্রিটিশ শাসনাধীন বাংলাদেশ তো বটেই, সারা বিশ্বের মানুষের মধ্যে সামাজিক ও রাজনৈতিক বোধের বিবর্তন ঘটিয়েছে। মানবিক বিপর্যয়, দুর্ভিক্ষের করালগ্রাসে বিপন্ন হয়েছে মানুষের জীবন। একই সঙ্গে মানুষের দারিদ্র্য ও দুঃসময়কে পুঁজি করে বিত্তের পাহাড় গড়েছে এক সুবিধাবাদী শ্রেণি। সঙ্গত কারণেই এই সময়কার কবিবৃন্দের মানসগঠনকেও তা প্রভাবিত করেছে। সৈয়দ আলী আহসানের উত্থানপর্বের কবিতাগুলোকে এই রাজনৈতিক পটভূমিতে রেখে বিবেচনা করলে তার সাহিত্যিক জীবন এবং শিল্পদর্শনকে উপলব্ধি করা সম্ভব হবে।
সৈয়দ আলী আহসানের জীবনবৃত্তান্ত ও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ- ১৯২০ সালের ২৬ মার্চ মাগুরা জেলার আলোকদিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা সৈয়দ আলী হামেদ ছিলেন একজন স্কুল ইন্সপেক্টর। ১৯৩৭ সালে আর্মানিটোলা স্কুলে অধ্যয়নকালে স্কুল ম্যাগাজিনে সৈয়দ আলী আহসানের ‘ঞযব জড়ংব’ নামে একটি ইংরেজি কবিতা প্রকাশিত হয়। সাহিত্যিক জীবনের হাতেখড়ি হওয়ার পর ক্রমে আজাদ, মাসিক মোহাম্মদী, সওগাত প্রভৃতি পত্রিকায় তার গল্প, প্রবন্ধ ও কবিতা প্রকাশিত হতে থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র থাকাকালে তিনি ‘পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ’ প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংগঠন থেকে টিএস এলিয়ট ও আইরিশ রিভাইভালের চিন্তাধারা, বাংলা পুথিসাহিত্য ও মুসলিম ঐতিহ্যের সমন্বয়ে এক বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন গড়ে ওঠে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে অনার্সসহ স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করে সৈয়দ আলী আহসান কিছুদিন কলেজে অধ্যাপনা করেন এবং ১৯৪৫ সালে অল ইন্ডিয়া রেডিওর কলকাতা কেন্দ্রে সাহিত্য সম্পর্কিত অনুষ্ঠান প্রযোজনার কাজে যোগ দেন। এ সময় থেকে তিনি দেশ-বিদেশের বহু খ্যাতনামা সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীর সান্নিধ্য লাভের সুযোগ পান এবং নিজেও কবি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। ১৯৪৯ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে অধ্যাপনায় যোগ দেন।
১৯৫৪ সালে সৈয়দ আলী আহসানে করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলার রিডার ও বিভাগীয় প্রধান হিসেবে যোগ দেন। সেখানে তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্য সম্পর্কিত একটি ইংরেজি পত্রিকা প্রকাশ করেন। ১৯৬০ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত বাংলা একাডেমির পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৭ সালে তিনি নতুন প্রতিষ্ঠিত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং কলা অনুষদের ডিন নিযুক্ত হন। ১৯৭২ সালে তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিযুক্ত হন। এ সময় তিনি সংবিধানের বাংলা ভাষ্য চূড়ান্তকরণ, শিল্পকলা একাডেমির গঠনতন্ত্র প্রণয়ন, বাংলা একাডেমি ও বাংলা ডেভেলপমেন্ট বোর্ড একত্রীকরণ, অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা কমিশন ইত্যাদি বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজে ভূমিকা রাখেন। বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতের ইংরেজি অনুবাদ তিনিই সম্পন্ন করেন। ১৯৭৫ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে যোগদান করেন। ১৯৭৭ সালের ২৬ জুন তিনি বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা, সংস্কৃতি, ক্রীড়া ও ধর্ম সম্পর্কিত মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিযুক্ত রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যপদ গ্রহণ করেন। ১৯৭৮ সালের ২৪ জুলাই তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপকরূপে যোগদান করেন। ১৯৮০ সাল থেকে কিছুকাল সৈয়দ আলী আহসান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটে খ-কালীন শিক্ষকরূপে বক্তৃতা দেন ও গবেষণাকার্য পরিচালনা করেন। ১৯৮৯ সালে তিনি জাতীয় অধ্যাপক ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন।
অধ্যাপক আহসান জীবৎকালে বহু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সম্মানে ভূষিত হন। ১৯৬৭ সালে তিনি কবিতার জন্য বাংলা একাডেমি পুরস্কার, ১৯৮৩ সালে একুশে পদক এবং ১৯৮৭ সালে স্বাধীনতা পদক লাভ করেন। তা ছাড়া ১৯৭৪ সালে নাগপুরে বিশ্ব হিন্দি সম্মেলনে বিশেষ সম্মাননা পত্র ও ১৯৯২ সালে ফরাসি সরকারের FFICER DE LÕORDRE DES ARTS ET DES LETTRES পদক ও সনদ লাভ করেন। মৃত্যুর কিছু পূর্বে বাংলাদেশ সরকার তাকে শিক্ষাবিদরূপে এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট প্রকল্প ভাষাবিদরূপে দুটি পৃথক স্বর্ণপদক প্রদান করে। তার জীবদ্দশায় লেখা এবং সম্পাদিত শতাধিক গ্রন্থের মধ্যে উইকিপিডিয়া এবং বাংলাপিডিয়া নির্বাচিত কয়েকটি গ্রন্থ হলো- Our Heritage (১৯৪৮), ইকবালের কবিতা (সম্পাদনা : ১৯৫২), কবিতার কথা (১৯৫২), নজরুল ইসলাম (১৯৫৪), বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত আধুনিক কাল (মুহম্মদ আব্দুল হাই সহযোগে ১৯৫৬), প্রেমের কবিতা (ফরাসি থেকে অনুবাদ ১৯৫৯), একক সন্ধ্যায় বসন্ত (১৯৬২), ওয়াল্ট হুইটম্যানের কবিতা (১৯৬৫), সহসা সচকিত (১৯৬৮),পদ্মাবতী (সম্পাদনা ১৯৬৮), মধুমালতী (১৯৭১), কাব্যসমগ্র (১৯৭৪), রবীন্দ্রনাথ : কাব্যবিচারের ভূমিকা (১৯৭৪), জার্মান সাহিত্য (১৯৭৬), কথাবিচিত : বিশ্বসাহিত্য (২০০১), বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস- প্রাচীনযুগ, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস- মধ্যযুগ (২০০১), বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ : আমাদের আত্মপরিচয় (২০০২) ইত্যাদি। সৈয়দ আলী আহসান ২০০২ সালের ২৫ জুলাই মৃত্যুবরণ করেন। * জীবনীপর্বের তথ্যসমূহ বাংলাপিডিয়ার ‘আহসান, সৈয়দ আলী’ টাইটেলের নিবন্ধ সাপেক্ষে উল্লিখিত।