বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) হলে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের হাতে নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে নিহত হয়েছিলেন বুয়েটের তড়িৎ কৌশল ও ইলেকট্রনিক প্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ। এবার একই প্রতিষ্ঠানে যন্ত্রকৌশল বিভাগে ভর্তির সুযোগ পেলেন তারই ছোট ভাই আবরার ফাইয়াজ। গতকাল বৃহস্পতিবার (৩০ জুন) বুয়েটের ২০২১-২২ ব্যাচের স্নাতক ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। প্রকাশিত ফলে আবরার ফাইয়াজ ৪৫০তম হয়ে যন্ত্রকৌশল বিভাগে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন। এর পরদিন গতকাল শুক্রবার (১ জুলাই) তার নিজ ফেসবুক আইডিতে নিজের ভাই, পরিবার, বন্ধুসহ সকলকে স্মরণ করে একটি পোস্ট করেছেন। সেখানে দেশবাসীর কাছেও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন তাদের সমর্থন করার জন্য।
লম্বা এই পোস্টে প্রায় সবখানেই উঠে এসেছে আবরারের কথা, আবরারের স্বপ্ন, ভাইয়ের প্রতি দরদ আর ভালোবাসা। নিচে সম্পূর্ণ পোস্টটি তুলে ধরা হলো : আলহামদুলিল্লাহ,আল্লাহর ইচ্ছায় বুয়েটে মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ ভর্তির সুযোগ লাভ করতে পেরেছি। আসলে এখন আমাদের অনেক খুশি হওয়ার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত বাড়ির কারোর মুখে তেমন খুশির ছিটেফোঁটাও দেখতে পায়নি। গতকাল যে সময় আমাদের রেজাল্ট দিয়েছে ২০১৭তেও ঠিক ঐ একই সময়ে ভাইয়ার রেজাল্ট দিয়েছিলো। তখন আমরা ৪জনই একই ঘরে বসে ছিলাম। সাথে চাচাও ছিলো। ভাইয়ার এক বন্ধু ফোন দিয়ে ভাইয়াকে বলেছিলো যে বুয়েটের রেজাল্ট দিয়েছে। সেদিনের মতো খুশি ভাইয়াকে আর কখনো দেখিনি। ঠিক যেন চোখ মুখ দিয়ে আনন্দ দেখা যাচ্ছিলো। আমিও সেদিন অনেক অনেক বেশি খুশি হয়েছিলাম। সত্যি বলতে সেদিনের আনন্দের ১০ভাগও গতকাল নিজের রেজাল্ট দেখে পাইনি।
এখন পর্যন্ত আমার পরিবারের একজনও বলেনি বুয়েটে ভর্তি হতে। আসলে কারোর সেটা বলার মতো সাহস নেই। আমার দাদা, ভাইয়ার রেজাল্ট শুনে পুরো এলাকায় বলে বেরিয়েছিলো সে কিনা আমাকে বারবার বলছে, “তুই আর বুয়েটে যাস না। দরকার হলে রাজশাহী/খুলনা ভার্সিটিতে পড়। ওরা খুব খারাপ।” কোথায় পড়বো জানিনা এখনো। ওটঞ তে ৪১তম হয়েছিলাম ঈঝঊ তে ভর্তি আছি ওখানে। আমাদের দুই ভাইয়ের বয়স আর ক্লাস গ্যাপ ৪ বছরের। তাই ভাইয়াকে ভর্তির দিনই বলছিলাম, “তাহলে ব্যাপারটা এমন যে তুই বের হবি আর আমাদের ব্যাচ ঢুকবে”। ভাইয়া একবার আম্মুকে বলেছিলো,“ এখানে দেখি যার বড় ভাইও পড়ে ছোট ভাইরাও বুয়েটেই আসে। তোমার ছেলে কী করবে?”
ভাইয়ার আসলে অনেক আশা ছিলো যে আমিও ভালো কোথাও ভর্তি হবো। ভাইয়ার এক বন্ধুর সাথে দেখা হলে বলছিলো, “তুমি তো সাব্বির ? তুমি নাকি অনেক ভালো ছাত্র। তুমি কী বুয়েটে আসবা? তোমার ভাই তো বলে তোমারো নাকি বুয়েটের ইচ্ছা?” আমি জানিনা ভাইয়া সবসময় কেন আমাকে পড়ালেখায় ভালো ভাবতো যেখানে আমি ভাইয়া বেঁচে থাকতে তেমন কোনো ভালো রেজাল্টই করিনি শুধুমাত্র স্কুলের পরীক্ষা বাদে। আসলে আমার থেকে ওরই আমার উপর বেশি ভরসা ছিলো। ভাইয়া মারা যাওয়ার পরে ভাইয়ার এক স্টুডেন্ট আর তার মা বাসায় এসে বলে, “তোমার ভাই কিন্তু তোমাকে নিয়ে অনেক চিন্তা করতো। সবসময় বলতো তোমার কথা। তুমি কোথায় পড়বা এসব কথা সবসময় বলতো।”
ভাইয়ার রেজাল্ট এর দিন ভাইয়া একটা পোস্ট দিয়েছিলো আলহামদুলিল্লাহ লিখে ফেসবুকে, আমি আবার তখন জোর করে বলেছিলাম, আমাকে ট্যাগ করতে। হয়তো আজ উলটোটা হতো। প্রথমবারের মতো ভাইয়ার খুশি হওয়ার মতো কিছু হতে পারতো এটা কিন্তু সেটা আর হলো না। এরপর কী করবো জানিনা এখনো। এতদিন তো শুধু ভাইয়ার দেখানো পথেই এগিয়েছি। বলা যায় ভাইয়ার দেখানো পথ এখান পর্যন্তই ছিলো। এরপরের দিনগুলো কেমন হবে সেটা আর আমাকে দেখিয়ে যাওয়ার সুযোগ ভাইয়া পায়নি। জানিনা ভাইয়া কি অবস্থায় আছে, কোথায় আছে কিন্তু এখন যতটা মিস করি ততটা আগে কখনো করিনি। আপনারা সবাই আমাদের অভিনন্দন জানাচ্ছেন। এত ভালোবাসার যোগ্য আমরা কিনা জানিনা। আসলে আমার শিক্ষক, বন্ধু কিংবা তেমন চিনিনা এমন অনেকেও আমাদের যেভাবে গত কয়েকবছর সাপোর্ট দিচ্ছেন এটা আমাদের কাছে কতটা মূল্যবান তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না। সকলের কাছে আমাদের কৃতজ্ঞতার কোনো শেষ নেই।