সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমাদের দেশে আভ্যন্তরীণ পর্যটন বাড়ার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পর্যটনও বেড়েছে। পর্যটন থেকে আয়ও বেড়েছে। এর একটি উল্লেখযোগ্য কারণ, অবকাঠামো ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ উন্নতি হয়েছে এ সময়। যমুনাসেতু, কর্ণফুলীসেতুসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ নদীসেতু নির্মাণসহ সড়ক যোগাযোগের লক্ষ্যযোগ্য উন্নয়ন লোকজনের যাতায়াত, মালামাল পরিবহন ও ভ্রমণ-পর্যটনে ব্যাপক অবদান রাখছে। অতি সম্প্রতি পদ্মাসেতুর উদ্বোধন হয়েছে এবং ইতোমধ্যেই দেশের উত্তর-পূর্বের সঙ্গে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমের যোগাযোগ ও যাতায়াতের ক্ষেত্রে এ সেতু প্রত্যাশিত ভূমিকা রাখতে শুরু করেছে। যমুনাসেতু ও পদ্মাসেতুতে এবার ঈদ টোল আদায়ের রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। পদ্মাসেতুতে ৯ জুলাই থেকে ১১ জুলাই পর্যন্ত চার দিনে টোল আদায় হয়েছে ৭ কোটি ৮০ লাখ ৫৪ হাজার ৫৫০ টাকা। একই সময়ে বঙ্গবন্ধু যমুনাসেতুতে টোল আদায় হয়েছে ৫ কোটি ১৮ হাজার ২০০ টাকা। এই টোল আদায় থেকেই বোঝা যায়, এই দুই সেতু ব্যবহারকারীর সংখ্যা কত হতে পারে। উত্তর এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বিপুল সংখ্যক মানুষ যাতায়াত করেছে। এর মধ্যে পর্যটকদের একটা বড় অংশ রয়েছে বলে অনুমান করা যায়। এবার অন্যান্য বারের তুলনায় কুয়াকাটায় অনেক বেশি লোক গেছে। সেটা যে পদ্মাসেতুর কারণে, তা বলাই বাহুল্য। খবরে প্রকাশ, এ বছরের মধ্যে আরো তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সেতুর উদ্বোধন হবে। এর মধ্যে রয়েছে এক. পিরোজপুরের বাকুটিয়া সেতু। এটি বরিশাল শহর ও পিরোজপুরের মধ্যে সংযোগ ঘটাবে। দুই. নড়াইলের কালনা সেতু। এটি দেশের প্রথম ৬ লেনের সেতু। এই সেতু এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে যুক্ত হবে। ৩. শীতলক্ষ্যা সেতু। নারায়ণগঞ্জ শহরকে বন্দর উপজেলার সাথে যুক্ত করবে এই সেতু। এই তিন সেতুর উদ্বোধন হয়ে গেলে সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলোতে পর্যটন, যাতায়াত ও যোগাযোগ ক্ষেত্রে নবদিগন্ত উন্মোচিত হবে। সড়ক-মহাসড়ক এবং সেতু, যোগাযোগ ও যাতায়াতের ক্ষেত্রে কী ভূমিকা রাখে তা আমাদের মোটেই অজানা নয়। প্রতিনিয়তই আমরা এর প্রমাণ পাচ্ছি। একটি বিষয় খুবই লক্ষ্যণীয়, এবার চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে পর্যটকদের সমাবেশ আগের চেয়ে কম হয়েছে। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, এর প্রধান কারণ, যতায়াত দুর্ভোগপূর্ণ এবং দীর্ঘ সময়সাপেক্ষ। তা ছাড়া পরিবেশ এবং হোটেল-মোটেল মালিকদের ব্যবহার নিয়ে সাম্প্রতিক কালে ব্যাপক প্রশ্ন উঠেছে। পক্ষান্তরে পদ্মাসেতুর কারণে কুয়াকাটায় যাতায়াত সহজ হয়েছে। দ্রুতই সেখানে পৌঁছানো যাচ্ছে এবং পরিবেশও ভাল। পর্যটনে বাংলাদেশের যে অপার সম্ভাবনা, তাকে পূর্ণভাবে কাজে লাগাতে হলে অবকাঠামো উন্নয়ন যথাযথ পর্যায়ে আনার পাশাপাশি যাতায়াত সহজ, অবাধ, নিরাপদ করতে হবে। পর্যটনস্থল বা স্পটগুলোর উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে সেখানে পর্যটকদের থাকা-খাওয়ার ভালো বন্দোবস্ত নিশ্চিত করতে হবে। ঈদের বন্ধে এবার দেশের বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত বিনোদন কেন্দ্র ও পার্কগুলোতে ব্যাপক লোক সমাগম প্রত্যক্ষ করা গেছে। বিপুল সংখ্যক মানুষ শহর থেকে গ্রামে গেছে। ঈদ উপলক্ষে তাদের এই ঘরে ফেরাও কার্যত বিনোদন ভ্রমণে পর্যবসিত হয়েছে। ভ্রমণ ও বিনোদন মানুষের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ও অপরিহার্য। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস অফিস-আদালত, চাকরি-বাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি করতে গিয়ে মানুষ কর্মক্লান্ত হয়ে পড়ে। তখন তাদের দরকার হয় ভ্রমণ-বিনোদন। এতে তাদের মধ্যে উজ্জীবনী শক্তির আবির্ভাব হয়, কর্মশক্তি ফিরে আসে। পূর্ণ উদ্যমে পুনরায় তারা কর্মক্ষেত্রে নিয়োজিত হয়। সব দেশেই এমন ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, যাতে অন্তত একসাথে কয়েকদিনের ছুটি পাওয়া যায় এবং মানুষ ভ্রমণে ও বিনোদনে সেই সময়টা উপভোগ করতে পারে। আমাদের দেশেও ঈদ ও বিভিন্ন উৎসবে ছুটি থাকে এবং এই সময় অনেকেই ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। অনেক সময় পরিবার-পরিজনকে সঙ্গে নিয়েও অনেকে পার্কে, দর্শনীয় স্থানে ছুটে যায়। এবারের ঈদে রাজধানীর হাতিরঝিল, চিড়িয়াখানা, রমনাসহ বিভিন্ন পার্ক ও দর্শনীয় স্থানসমূহে নানা বয়সী মানুষের ভীড় দেখা গেছে। কক্সবাজার, কুয়াকাটা, সুন্দরবন, তিন পার্বত্য জেলা, চট্টগ্রামের পতেঙ্গা, রাজশাহীর পদ্মার চর প্রভৃতি পর্যটন স্থান বা কেন্দ্রে হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতি দেখা গেছে। পর্যটনের দিক দিয়ে ব্যাপক সম্ভাবনাময় আমাদের দেশ। এখানে যেমন রয়েছে কক্সবাজারের মতো বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত, তেমনি রয়েছে কুয়াকাটার মতো বিরল সমুদ্র সৈকত, যেখানে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দর্শন করা যায়। আরও রয়েছে বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন। এছাড়া তিন পার্বত্য জেলা, সিলেট, প্রভৃতি এলাকায় রয়েছে অনেক প্রাকৃতিক ও দর্শনীয় স্থান, যা পর্যটকদের নিত্যই আকর্ষণ করে। সহজেই বাংলাদেশও পরিণত হতে পারে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, শ্রীলঙ্কা, ভারত প্রভৃতি দেশের মত পর্যটন অর্থনীতির বড় দেশে।
একই সঙ্গে পর্যটকদের নিরাপত্তাও নিশ্চিত করতে হবে। যে কোনো ভ্রমণ হতে হবে দ্রুতগতির এবং কম ব্যয়সাপেক্ষ। হোটোল-মোটেল-রেস্টুরেন্টের মালিকরা যেন সুযোগ বুঝে গলাকাটা দাম নিতে কিংবা পচা-বাসি খাবার কিক্রী করতে না পারে, সে ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা থাকতে হবে। এবার চট্টগ্রাম-কক্সবাজারে কম পর্যটক হওয়ার কারণ ভালোভাবে খতিয়ে দেখতে হবে। প্রতিবন্ধকতা ও বাধাগুলো দূর করার ব্যবস্থা নিতে হবে। সারাদেশকে যদি আমরা পর্যটনবান্ধব করে তুলতে পারি, তবে দেশি-বিদেশি পর্যটকরা দলে দলে আসবে, ভ্রমণ করবে। আর এর দ্বারা অর্থনীতি স্ফীত হবে, যার সুফল পাবে দেশ ও দেশের মানুষ।