শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৩১ অপরাহ্ন

সিরাজউদ্দৌলার ঘো

হারুন ইবনে শাহাদাতড়া
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ১৫ জুলাই, ২০২২

শীতের সকাল। বুড়িগঙ্গা নদীর এই দিকটায় তেমন ভিড় নেই। নদীটাও বেশ শান্ত। ছোট ছোট ডিঙি নৌকায় মানুষজন এপার থেকে ওপারে যাচ্ছে। ওপার থেকে এপারে আসছে। সকালের সোনালি মিষ্টি রোদ নদীর পানিতে পড়ে আকাশ আর পানির মধ্যে এক মিতালিবন্ধন সৃষ্টি করেছে। এভাবে দাঁড়িয়ে নাবিল ভাবছে, একটা ছোট্ট নৌকায় করে ওপারে গেলে কেমন হয়। যেই ভাবা সেই কাজ। সে একটা নৌকায় উঠে বসলো। শান্ত নদীর পানি নৌকার মাঝির বৈঠার ছলাৎ ছলাৎ শব্দে ছোট ছোট ঢেউ তুলছে। নৌকা এগিয়ে যাচ্ছে ওপারে। দূরে লঞ্চ আর বড় বড় ইঞ্জিন নৌকার হুইসেল বাজছে। নাবিল ভাবে এই বুুড়িগঙ্গা নদীকে ঘিরে গড়ে উঠেছে বিশাল নগরী ঢাকা। কিন্তু ঢাকাবাসী আজ এই বুড়িগঙ্গাকে গিলে খাচ্ছে। নদী ভরাট করে গড়ে তুলছে বড় বড় অট্টালিকা। নদীর তীরের কলকারখানার ময়লা-বর্জ্য দূষণ ছড়াচ্ছে। কিন্তু দেখার কেউ নেই। যাদের দেখার কথা তারাই তো রাক্ষসের তো নদীটাকে গিলে খাওয়ার আয়োজনে ব্যস্ত। নদীর পানির মিষ্টি শব্দটা এখন আর নেই। দূষণের তা-বে মাঝে মাঝে নাকে এসে ধাক্কা দিচ্ছে উৎকট পচা গন্ধ।
: ‘ভাই নামেন।’ মাঝির ডাকে নাবিল চোখ ফিরিয়ে দেখে নৌকা তীরে ভিড়েছে। সে নদীর তীর ধরে একা একা হাঁটছে। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ থমকে দাঁড়ায়। চোখের সামনে একটি প্রাচীন ভবনের খ-াংশ। আস্তর খসে বেরিয়ে পড়েছে পুরোনো দিনের ইট। অন্ধকার তিনটি প্রকোষ্ঠ। নাবিল ভাবছেÑ এই নদীর তীরে এই ভাঙা প্রাসাদটি কার? সে আস্তে আস্তে সামনে এগোয়। দেখে প্রাসাদের ভিতর থেকে ধোঁয়া আসছে। আরো এগোয়। প্রাসাদের সামনে এক বয়স্ক মহিলা রান্না করছেন। চুলা থেকে ধোঁয়া আসছে। সে আরো এগিয়ে যায়। মহিলাকে ডাকে: ‘চাচি। এটা কি আপনাদের বাড়ি?’ তিনি প্রশ্নের সরাসরি উত্তর না দিয়ে বলেন, ‘বাবা আপনি কারা? আমাদের বাড়ি?’
নাবিল আবার জানতে চায়:‘ চাচি এই রাজপ্রাসাদ এইগুলো এমন ভাঙা কেন?’ তিনি উত্তর দেন: ‘সে অনেক কথা বাবা, বলা যাবে না।’ নাবিল বাড়ির সামনে কোন নামফলক আছে কি না, তা খোঁজাখুঁজি করে। না সে তেমন কিছু দেখতে পায় না।
: চাচি, আমি কি ভিতরে আসতে পারি।
: আসেন
নাাবিল বাড়ির ভিতরে যায়। তিনটি পরিবার বাড়িতে বাস করে। সে সরু সিঁড়ি দিয়ে ছাদে ওঠে। সিঁড়ির কোঠর থেকে একটি পাখি উড়ে গিয়ে সজনে গাছের ডালে বসে। নাবিল খুব ভাল করে লক্ষ করে ঝোপঝাড়ে ঘেরা বাড়িটির আঙিনায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটি নারিকেল গাছ, একটি বড় নিম গাছ। সজনে গাছটি তার নরম শাখা আর পাতা ঝুলিয়ে আছে। ডালে কয়েকটি ছোট পাখি বসে আছে। দেখে মনে হয় পাখিগুলোর সাথে তার দারুণ মিতালি। এই ভাঙা প্রাসাদের চারপাশে অনেক বড় বড় অট্টালিকা। তাহলে এই প্রাচীন বাড়িটি আসলে কারÑ নাবিলের মনে বার বার এই প্রশ্ন উঁঁকি দিচ্ছে। আস্তে আস্তে নিচে নেমে আসে।
বাড়ি থেকে বের হয়। সামনে একটি মুদি দোকান। দোকানের রেডিওতে গান বাজছে;
‘ একূল ভাঙে ওকূল গড়ে
এই তো নদীর খেলা (রে ভাই)
এই তো বিধির খেলা।
সকাল বেলার আমির রে ভাই
ফকির সন্ধ্যাবেলা।
সেই নদীর ধারে কোন ভরসায়
(ওরে বেভুল) বাঁধলি বাসা সুখের আশায়
যখন ধরল ভাঙন পেলিনে তুই
পারে যাবার ভেলা।
এই দেহ ভেঙে হয় রে মাটি
মাটিতে হয় দেহ
যে কুমোর গড়ে সেই দেহ
তার খোঁজ নিল না কেহ।
রাতে রাজা সাজে নট-মহলে
দিনে ভিক্ষা মেগে পথে চলে
শেষে শ্মশান-ঘাটে গিয়ে দেখে
সবই মাটির ঢেলা
এই তো বিধির খেলা রে ভাই
ভব-নদীর খেলা॥’
গানের আবহে নাবিল হারিয়ে যায়। গান শেষে দোকানির জানতে চায় : ‘চাচা, এই বাড়িটি কার?’
: কোন বাড়ি?
: এই যে ভাঙা প্রাসাদটি কার?
: আপনি গবেষক?
: না। ছাত্র। ঢাকা কলেজে পড়ি। এদিকটায় বেড়াতে এসেছি।
: এটা হাবেলি প্রাসাদ
: কি বললেন, বা হাউলি প্রাসাদ?
: কেউ বলে হাবেলি, কেউ হাউলি আবার কেউ কেউ জিঞ্জিরা প্রাসাদ, ঘসেটি বেগমের কয়েদখানাও কয়।
: ঘসেটি বেগম নামটি শোনার সাথে সাথে নাবিল চমকে ওঠে!
নাবিল ভাবে তাহলে তো এটি একটি ঐতিহাসিক বাড়ি। এই বাড়ির সাথে মিশে আছে বাংলাদেশের অনেক অজানা ইতিহাস। আবার সেই বাড়িতে যায়। তার মোবাইল ফোনে ঝটপট কয়েকটি ছবি তুলে নেয়।


নাবিলের রিডিং রুম। পড়ার টেবিলের পাশে কম্পিউটার টেবিল বরাবর ডানে বুকসেলফ। বামপাশে ছোটখাটো। দেয়ালঘেঁষে একটি ড্রেসিং টেবিলও আছে। সকালে বুড়িগঙ্গার ওপারের জিঞ্জিরা প্রাসাদ থেকে আসার পর কিছুতেই পড়াতে মন বসাতে পারছে না নাবিল। তার মনপবনের ঘোড়াটা সব সময় চলে যাচ্ছে প্রাসাদে। তার মনটা আবার আনচান করছে টাইমমেশিনের ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে সময়ের সীমানা পাড়ি দিতে। সে চাইলেই কি আর সেই স্বপ্নের ঘোড়া আসবে। এমন সব সাত-পাঁচ ভাবনায় তার মনটা কিছুতেই শান্ত হচ্ছে না। মা কয়েকবার ডেকে গেছেন খাবার জন্য। কিন্তু কি করে তাকে বোঝাবে এখন তার কোনো ক্ষুধা নেই। কিচ্ছু খেতে ইচ্ছে করছে না।
: ‘আসসালামু আলাইকুম। প্লিজ ওপেন দ্য ডোর…’ কলিংবেলটার রোবটিং মানবিক কণ্ঠস্বর শুনে নাবিল বুঝলো তার বাবা এসেছেন। তার বাবা একটি করপোরেট প্রতিষ্ঠানের বড় কর্মকর্তা। অফিস শেষ করে ফিরতে তার প্রায়ই রাত ১০/১১টা বাজে। এবার আর না খেয়ে থাকার উপায় নেই। তাই সে দৌড়ে দরজার কাছে যায়। দরজা খুলে দেয়। তার বাবা ড্রেস পাল্টে ডাইনিং টেবিলে বসেন। নাবিলও বসে তার পাশে। চুপচাপ দু’জন খাওয়া শেষ করে। নাবিল আবার ওর পড়া টেবিলে বসে। না, পড়ায় মন বসছে না। বইটা খোলা রেখেই কম্পিউটার অন করে। ইন্টারনেট সংযোগটা ঠিক আছে কি না, পরীক্ষা করে দেখে। তারপর সকাল বেলা মোবাইলে তোলা ছবিগুলো দিয়ে গুগলে সার্চ দেয়।
ফলাফল পেতে খুবটা একটা বেগ পেতে হয় না। গুগল তথ্যভা-ার থেকে সে জানতে পারে, ‘এটি প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তরের একটি সংরক্ষিত পুরাকীর্তি। চারশ’ বছর আগে নির্মিত জিঞ্জিরা প্রাসাদের একটি ভঙ্গুর অংশ। বাংলার মোগল সুবাদার দ্বিতীয় ইবরাহিম খান (১৬৮৯-১৬৯৭) প্রাসাদটি বানিয়েছিলেন। স্থানীয় লোকজনের ভাষায় এলাকাটি ‘হাউলি’ নামে পরিচিত। হাউলি শব্দটি ফারসি হাভেলি শব্দ থেকে এসেছে, যার অর্থ আবাসিক এলাকা। আর জিঞ্জিরা শব্দটি আরবি জাজিরা (উপদ্বীপ) শব্দের বিকৃত রূপ। স্থানটি নদী ও পরিখা দিয়ে পরিবেষ্টিত হওয়ায় এ রকম নামকরণ বলে মত ঐতিহাসিকদের।
এশিয়াটিক সোসাইটি প্রকাশিত ঢাকা কোষ বইয়ের তথ্যানুসারে, সুবাদার ইবরাহিম খান ঢাকার বাইরে বুড়িগঙ্গার দক্ষিণ তীরে হাউলি গ্রামে বিস্তৃত এলাকাজুড়ে বাগান, হাম্মামখানা (স্নানঘর) সংবলিত প্রাসাদ তৈরি করেন। এখানে আসার জন্য বুড়িগঙ্গা নদীর ওপর একটি কাঠের সেতু নির্মাণ করেন। এই বইয়ের তথ্য অনুসারে, ১৭০৪ সালে মুর্শিদকুলী খান বাংলার দেওয়ানি মুর্শিদাবাদে সরিয়ে নিলে জিঞ্জিরা প্রাসাদের অবনতি শুরু হয়। বাংলাপিডিয়া জানাচ্ছে, জিঞ্জিরা প্রাসাদে ছিল মূল প্রাসাদ ভবন, আয়তাকার সুবিস্তৃত দ্বিতল হাম্মাম, দক্ষিণের সদরে প্রহরীকক্ষসহ দ্বিতল প্রবেশ ফটক এবং দুটি অষ্টকোণী পার্শ্ব বুরুজ। পলেস্তারা দেয়ালঘেরা কক্ষগুলো ছিল আয়তাকার এবং ওপরে কুঁড়েঘর আকৃতির চৌচালা খিলানাকার ছাদ। অনেক বেদনাবিধুর ঘটনার নীরব সাক্ষী এই জিঞ্জিরা প্রাসাদ। ইতিহাসের বইপত্রে পাওয়া যায়, নবাব সরফরাজ খানের (১৭৩৯-১৭৪০) পতনের পর তাঁর মাতা, স্ত্রী, বোন, পুত্র, কন্যাসহ হারেমের কিছু নারীকে এখানে বন্দী করা হয়। অদৃষ্টের নির্মম পরিহাস যে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের পর আলীবর্দী খানের প্রধান রানি শরীফুন্নেসা, সিরাজের মা আমেনা বেগম, প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের অন্যতম নেপথ্য কারিগর খালা ঘসেটি বেগম, সিরাজের স্ত্রী লুৎফুন্নেসা বেগম ও কন্যা কুদসিয়া বেগম ওরফে উম্মে জোহরাকে জিঞ্জিরা প্রাসাদে এনে কড়া পাহারায় রাখা হয়। জনশ্রুতি আছে, নবাব মীর জাফর আলী খানের পুত্র মীর সাদেক আলী খান ওরফে মীরনের নির্দেশে জমাদার বকর খান মুর্শিদাবাদে নিয়ে যাওয়ার অজুহাতে ঘসেটি বেগম ও আমেনা বেগমকে প্রাসাদ থেকে নৌকায় তুলে ধলেশ্বরী নদীতে ডুবিয়ে হত্যা করে।’
নাবিল কম্পিউটারের স্ক্রিনে ডুবে আছে। তার কোনো দিকে খেয়াল নেই। অনেকক্ষণ ধরে কে যেন দরজায় নক করছে। সে দিকে তার খেয়ালই করেনি। দরজা খুলে নাবিল অবাক। দরজার সামনে দাঁড়ানো ঘোড়া। নাবিল তো অবাক এই রাতদুপুরে চার তলার ওপরে ..
: ‘কি ব্যাপার এত অবাক হচ্ছো যে? কথা দিয়েছিলাম, যখন ডাকবে ঠিক এসো আসবো।’ নাবিল ঠিক মনে করতে পারছে না। সে বার বার মাথা চুলকাচ্ছে। বিষয়টি ঘোড়ার নজর এড়ায় না।
ঘোড়াটি বলে: ‘ঐ যে জাদুঘরের সেই টাইমমেশিন ঘোড়া, যাকে নিয়ে তুমি ইতোপূর্বে ভ্রমণে বের হয়েছিলে। মনে পড়ছে না?’ এবার নাবিলের মনে পড়ে যায়।
: হ্যাঁ মনে পড়েছে। তুমি সেই মনপবনের ঘোড়া। তোমার ওপর সওয়ার হলে এক সাথে সময় ও স্থান দুটিই পাড়ি দেয়া যায়, কারণ তুমি টাইমমেশিন ঘোড়া। তুমি এসে বেশ করেছো। তোমাকে আমার খুব প্রয়োজন
: জানি তুমি বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার আমলে ভ্রমণ করতে চাও, ঠিক আছে চলো।


নাবিল ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়ে অবাক হয়ে যায়। সে এ কী দেখছে। প্রচ- শীত আর দারিদ্র্যপীড়িত এ কোন দেশ। নাবিল ঘোড়ার কাছে প্রশ্ন করে : ‘তুমি এ আমায় কোথায় নিয়ে এলে।’
ঘোড়া উত্তর দেয়: ‘এই হলো পনরশ’ শতকের ইউরোপ। ব্রিটেনের সবচেয়ে সমৃদ্ধ শহর লন্ডনও তখন মুর্শিদাবাদের তুলনায় একটি বড় গ্রাম।’
: কেন কেন?
: কারণ শিল্প বিপ্লবের তখনও শুরু হয়নি। কৃষি কাজ. মাছ ধরাই এই সময়ের ইউরোপবাসীর বলতে গেলে একমাত্র বৈধ পেশা।
: বৈধ মানে?
: বৈধ মানে, বৈধ।
: অবৈধ পেশাও ছিল নাকি?
: ছিল না মানে, তারা ডাকাতি, দস্যুপনা, লুটপাট চালাতো দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশেও।
: বল কি, সুসভ্য এই জাতি?
: হ্যাঁ, সুসভ্যরা ব্যবসা-বাণিজ্য করতো। তবে ব্যবসা-বাণিজ্যের আড়ালে নিজের সমুদ্রসীমানায় লুটপাটও করতো। সীমানার বাইরে গিয়ে সুযোগ পেলে গোটা দেশটাকেই লুট করতোÑ এ ইতিহাস তো তোমার অজানা নয়।
: মানে?
: কেন, তোমাদের দেশটা যে ওরা দখল করেছিল তা ভুলে গেছো।
: না, সেই ১৫৫৭ সালে ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধে..
: ঠিক ঠিক মনে আছে তোমার।
নাবিল ভাবে প্রচ- শীত থেকে বাঁচতে ইট পাথরে বানানো কুটিরগুলোতে কয়লার আগুন জ্বেলে বাস করতো ইংল্যান্ডের মানুষ। সে সময় কাজের বড় অভাব ছিল ওদের দেশে। জীবিকার কারণে বিভিন্ন ব্যবসা-বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে রানির সনদ নিয়ে পাড়ি জমাতো পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। সেই সময়ের ধনী ও সমৃদ্ধ দেশগুলোর দিকে ছিল তাদের নজর। ভারতবর্ষ তখন ছিল পৃথিবীর অন্যতম সমৃদ্ধ ও ধনী দেশ। ভারতের মধ্যে বাংলাদেশ ছিল সমৃদ্ধ দেশগুলোর মধ্যে সেরা। ইউরোপবাসী ভারতবর্ষে আসার পথ না চিনলেও তাদের কাছে এই সমৃদ্ধ দেশটির খবর অজানা ছিল না। জীবন-জীবিকার প্রয়োজনেই তারা নতুনের সন্ধানে ব্যস্ত থাকতো। শত অভাব-অনটন আর দারিদ্র্যের মধ্যেও তারা লেখাপড়া, গবেষণা ও কাজের সন্ধানে সাত-সাগর তের নদী পাড়ি দিতে ভয় পেত না। হয়তো এই দরিদ্রতাই তাদেরকে এই সাহস জুগিয়েছে। সুখের সোনার হরিণ ধরতে জীবনবাজি রাখার শক্তি দিয়েছে। তাই তো ভারতবর্ষ আবিষ্কার করতে সাগরে জাহাজ ভাসিয়ে কলম্বাস চলে গেছেন আমেরিকায়। সফল হয়েছেন পুর্তুগিজ নাবিক ভাস্কো দ্য গামা।
: ‘কী ভাস্কো দ্য গামার কীভাবে ভারতবর্ষে এসেছিলে তোমার মনে আছে।’ ঘোড়া প্রশ্ন করে
: হ্যাঁ, অনেক আগে শুনেছিলাম আসাদ মিরণ মামার কাছে ‘ভাস্কো দ্য গামার ‘দখল গল্প’
: বল দেখি কেমন মনে আছে?
: তবে শোন, ভারতের এক সময়ের সমৃদ্ধশালী রাজ্য কালিকট। বাণিজ্যিক বন্দর বা ঘাট হিসেবে রাজ্যটির সমৃদ্ধির সুনাম পৃথিবীর নানা দেশে বিস্তৃত ছিল। বন্দরটির ওপর চোখ পড়লো নৌ-শক্তিতে বলীয়ান দেশ পর্তুগালের। ১৪৮৭ সালে রাজা দ্বিতীয় জন গুপ্তচরের মাধ্যমে বন্দরটি সম্পর্কে খোঁজ নেন। কয়েক বছর পর ১৪৯৭ সালে পর্তুগিজরা ভারতর্ষের সঙ্গে বাণিজ্য করার জন্য জাহাজ সাজিয়ে তৈরি হয়। এই বণিক দলের অধিনায়কের নাম ছিল ‘ভাস্কো দ্য গামা’। নামটি তখন অনেকের কাছেই পরিচিত ছিল। ইউরোপিয়ানদের মধ্যে তিনিই প্রথম লিসবন থেকে উত্তমাশা অন্তরীপ প্রদক্ষিণ করে আফ্রিকা উপকূলে আসেন। তারপর মোজাম্বিক ও মোম্বাছা হয়ে উত্তরের দিকে যাত্রা করে মালিন্দী এসে পৌঁছান। সেসময় ভাস্কো দ্য গামা সেখানে একজন নৌ-পরিচালকের খোঁজ পান। যার সমুদ্র, জ্যামিতিক ও ভৌগোলিক জ্ঞানে তিনি বিস্মিত হয়ে যান। আর ইনি হলেন আরবের বিখ্যাত সমুদ্র বিজ্ঞানী ও নাবিক ইবনে মজিদ। এই সেই ব্যক্তি যিনি ভাস্কো দ্য গামাকে পথ দেখিয়ে, নির্দেশনা দিয়ে ভারতবর্ষে নিয়ে আসেন। ইতিহাসের পাতায় ভাস্কো দ্য গামাকে ভারতে আসার জলপথের নায়ক বলা হয়। ভাস্কো দ্য গামা ১৪৯৮ সালের ২০ মে ভারতের দক্ষিণ উপকূল কালিকটের কাছে এসে নামেন। এটাই তার ভারতবর্ষে প্রথম পদার্পণ। ভারতবর্ষের মাটিতে ভাস্কো দ্য গামার হাত ধরে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তির প্রথম বীজটি রোপিত হয়।
পর্তুগিজ জাহাজগুলো ছিল উন্নত ধরনের। জাহাজের ওপর কামান সজ্জিত ছিল। বন্দরের লোকজন তেমনটি আগে কখনো দেখেনি। তারা অবাক হলো ‘জিনিস’টি কী? তবে সেখানে বসবাসরত আরব বণিকরা কিন্তু কামানের সাথে পরিচিত ছিল। কারণ আরব বণিকরা সেসময় দেশ-বিদেশ সফর করে বেড়াতো। তারা স্থানীয়দের এর বৃত্তান্ত বুঝিয়ে বলেন। বিষয়টি কালিকটবাসীকে ভাবিয়ে তোলে। পর্তুগিজদের আসল উদ্দেশ্য কী?
১৪৯৭ সালের ৮ জুলাই ভাস্কো দ্য গামা ৪টি জাহাজ নিয়ে ভারতবর্ষের উদ্দেশে যাত্রা করেন। দুটি জাহাজ কামান দ্বারা সজ্জিত ছিল। কেপ অব গুড হোপ ছাড়িয়ে তারা ভারত মহাসাগরে এসে পৌঁছালেন। তারপর মোজাম্বিক যেতে বেগ পেতে হলো না। কিন্তু তারপরই শুরু হলো কঠিন এক সমুদ্রযাত্রা। কোনোরকম তখন মিলিন্দীতে পৌঁছানোর পর সেই বিখ্যাত নাবিক মজিদ ভাস্কো দ্য গামাকে ভারতবর্ষের কালিকট রাজ্যে নিয়ে যান। সমস্ত যাত্রাপথে ভাস্কো দ্য গামার মোট সময় লাগে ১০ মাস ১২ দিন। তিনি কালিকটের রাজা জামোরিনের কাছে কালিকট বন্দরের সাথে বাণিজ্য করার অনুমতি চান। শান্তিকামী জামোরিন কামান সজ্জিত জাহাজ দেখে এমনিতেই উদ্বিগ্ন ছিলেন। তিনি অনুমতি দেন। কিন্তু তাতে ভাস্কো দ্য গামা সন্তুষ্ট হতে পারেননি। তিনি একটি অন্যায় দাবি করে বসেন। তা হলো, বন্দরের প্রচলিত শুল্কের দায় থেকে অব্যাহতি দিতে হবে। ভাস্কো দ্য গামা আরো কিছু বিষয় নিয়েও সেই যাত্রায় চিন্তিত হয়ে পড়েন। এ বন্দরে আরব বণিকরা পাকাপোক্তভাবে জায়গা করে নেয়, এমনকি রাজ্যসভার সাথেও তাদের বেশ সখ্য গড়ে ওঠে। মুসলিমদের এই প্রভাব ভাস্কো দ্য গামা মোটেও ভালো চোখে দেখলেন না। আরেকটি বিষয় নিয়েও তার ভুল ভাঙলো। পোপ ও পর্তুগিজদের ধারণা ছিলÑ ভারতবর্ষের মানুষ খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত, কিন্তু এবার দেখে তাদের সেই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। তার প্রাথমিক সফরের সমস্ত বৃত্তান্ত দেশে ফিরে রাজা ডোম ম্যানুয়েলকে জানালেন। তারা বুঝলেন সেখানে আধিপত্য বিস্তার করতে হলে তাদের বিতাড়িত করতে হবে। এছাড়া দ্বিতীয় কোনো পথ সামনে খোলা নেই। ভাস্কো দ্য গামার প্রথম সাফল্য, লোভ আর লাভের জন্য দ্বিতীয়বারের জন্য পর্তুগিজরা ভারত যাত্রার প্রস্তুতি নিলো। এবারে প্রস্তুত করা হলো ৩৩টি জাহাজ ও ১,৫০০ জন যোদ্ধা। নেতৃত্ব দিলেন পেড্রো আলভারেজ ক্যার্বোল। তাকে ম্যানুয়েল আদেশ দিয়ে পাঠালেন যে, কালিকটের রাজার কাছে একটি বাণিজ্য ঘাঁটি স্থাপন ও খ্রিস্টধর্ম প্রচারের অনুমতি নিয়ে আসার জন্য। কালিকটের রাজা জামোরিন অনুমতি দেন। কিন্তু পর্তুগিজদের উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন। তারা স্থানীয় লোকদের ওপর অত্যাচার শুরু করলো। দেখতে দেখতে অবস্থার চরম অবনতি হলো। স্থানীয়দের সাথে ক্যার্বোল বাহিনীর সংঘর্ষ হলো। এক সময় ক্যার্বোল কামান দিয়ে আক্রমণ শুরু করতে থাকে কালিকট বন্দরে। অবশেষে জামোরিনের বাহিনীর সাহসিক নৌ-যুদ্ধে পরাস্ত হয়ে ক্যার্বোল তার জাহাজ নিয়ে পালিয়ে গেল।
কিন্তু পর্তুগিজরা থামার পাত্র নয়। ১৫০২ সালে আবারো তারা অভিযান চালালো। এবারের অধিনায়ক হলেন আমাদের ইতিহাসের নায়ক ‘ভাস্কো দ্য গামা’। ২০টি জাহাজ ও ৮০০ সুশিক্ষিত সামরিক সৈন্য নিয়ে কালিকট দখল করতে রওনা হলেন। শুরু হলো ভাস্কো দ্য গামার বিভীষিকাময় ধ্বংসযজ্ঞের এক কলঙ্কিত অভিযান। ভারত মহাসাগরে প্রবেশ করেই যে জাহাজেরই দেখা পেলেন তিনি, সেগুলো লুটপাট ও ধ্বংস করতে লাগলেন। জলদস্যুর মতোই তার নিষ্ঠুরতা ও নৃশংস অত্যাচার অব্যাহত গতিতে চলতে লাগলো। সব থেকে নির্মম কাজটি তিনি এই সময়েই করে বসলেন। মক্কা থেকে হজযাত্রীদের নিয়ে কয়েকটি নিরস্ত্র জাহাজ ফিরে আসছিল। জাহাজগুলোকে ভাস্কো দ্য গামা আটক করে মালামাল সব লুট করে নেন। সৈন্যদের প্রতি তার কঠিন আদেশ ছিল, জাহাজ থেকে যেন কোনো মানুষকে তুলে আনা না হয়। তারপর সেগুলোতে আগুন দেওয়া হয়। জাহাজের সকল যাত্রী পুড়ে কয়লা হয়ে যেতে লাগলো। তাদের মধ্যে অনেক নারী ও শিশু ছিল। কেউ কেউ আবার সমুদ্রে ঝাঁপ দিলেন, কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হলো না। ডুবে মরলো অনেকেই। আর যারা ভেসে ছিলেন, তাদেরকে সৈন্যরা কুপিয়ে কুপিয়ে মারলেন। ভাস্কো দ্য গামা পরম আনন্দে সেই দৃশ্য উপভোগ করলেন! কালিকটে পৌঁছানোর আগেই ভাস্কো দ্য গামার নির্মমতার খবর নগরময় ছড়িয়ে পড়ে। তাদের মনে পর্তুগিজদের সম্পর্কে ক্ষোভ ও ঘৃণা তৈরি হলো। কালিকটে পৌঁছে ভাস্কো দ্য গামা রাজাকে জানান, শহর থেকে সকল মুসলিমকে বের করে দিতে হবে। রাজা তাতে রাজি হলেন না। ফলশ্রুতিতে উপকূলে রাজার সাথে যুদ্ধ বাধলো। ভাস্কো দ্য গামার কামানের গোলার মুহুর্মুহু আঘাতে শহরের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হতে থাকে। তারা কিছু ভারতীয় জাহাজ আটক করে কর্মীদের নাক, কান ও হাত কেটে অপমানের প্রতিশোধস্বরূপ রাজা জামোরিনের কাছে পাঠালেন। ভাস্কো দ্য গামার অত্যাচার বেশিদিন টিকলো না। এরপর কালিকটের হিন্দু বণিক, আরব বণিক সকলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে রাজার পেছনে এসে দাঁড়ালো। পর্তুগিজদের বিরুদ্ধে তাদের এই ঐক্য ও দৃঢ় সংকল্প শেষদিন পর্যন্ত টিকে ছিল। রাজা জামোরিন বুঝতে পারলো, এই যুদ্ধ কেবল একদল বণিকদের বিরুদ্ধে নয়, স্বয়ং পর্তুগিজ রাজার বিরুদ্ধে। তারপরও কালিকটের বণিকরা সকলে একত্রিত হয়, সেখানে বসবাসকারী আরব বণিকরাও একজোট হয় রাজার পক্ষে যুদ্ধ করার জন্য। কালিকটের নৌ-সেনাপতি কাশিম ঠিক করলেন কৌচিনের কাছেই তাদের মোকাবিলা করতে হবে। শুরু হয় এক অসম লড়াই কামানের বিরুদ্ধে ঢাল-তলোয়ারের। একের পর এক কালিকটের জাহাজ পর্তুগিজ কামানের গোলায় আক্রান্ত হতে লাগলো। কিন্তু হাল ছাড়লো না তারা। সেদিন নৌ-সেনাপতি কাশিমের রণচাতুর্য ছিল অসামান্য। তিনি ছোট ছোট ক্ষিপ্রগতির জাহাজগুলো এমনভাবে পরিচালনা করতে লাগলেন যাতে ভাস্কো দ্য গামার কামানের গোলা কিছুতেই লক্ষ্য ভেদ না করতে পারে। এমন অভিজ্ঞতা ভাস্কো দ্য গামার কখনো হয়নি। অবশেষে তিনি যুদ্ধ ক্ষান্ত দিয়ে পালিয়ে গেলেন। এরপরও কালিকট ও ভারতবর্ষের অন্য রাজ্যগুলো স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়তে পারেনি। পরে মিশরসহ অনেক আরব দেশ তাদেরকে সহায়তা করলেও পর্তুগিজরা বছরের পর বছর চেষ্টা করে কালিকটের আশপাশের রাজ্য কোচিন, গুজরাট, গোয়া, মুম্বাই বিজয়নগর দখল করলেও তারা কালিকট দখল করতে পারেনি। আশপাশের সকল রাজ্য পর্তুগিজদের সহায়তা করেছিল, কিন্তু কালিকটের হিন্দু-মুসলিম ঐক্য ও দেশপ্রেমের কাছে বারবার মার খেয়েছে পর্তুগিজরা।’
: তুমি কি জান, তোমার আসাদ মিরণ মামার এ গল্পটি একটি বড় পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল?
: জানি দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় ১ অক্টোবর ২ হাজার ১৬ সালে।
: ‘বাহ বাহ! তোমার স্মরণশক্তি তো খুব প্রখর’। স্মরণশক্তির প্রশংসা শুনে নাবিলের মুখ লজ্জায় রাঙা টমেটোর মতো দেখায়। লাজরাঙা মুখ নাবিল বলে: ‘পুর্তগিজরা না পারলেও তাদের দেখানো পথেই তো পরে ইংরেজরা এসে আমাদের এই দেশটা দখল করেছিল।’
: ঠিক তাই।


নাবিল ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়ে চলছে। নিচে সবুজ শস্যক্ষেত ওপরে নীল আকাশ। সে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। বাতাসে দূষণের চিহ্নমাত্র নেই। এমন নির্মূল বায়ু গাঁও-গ্রামেও এখন পাওয়া দুষ্কর। অথচ রাজধানী ঢাকায়। সে আর ভাবতে পারছে না।
: ‘কী ব্যাপার নাবিল, কি ভাবছো? ’ নাবিলের টাইমমেশিন ঘোড়া প্রশ্ন করে?
: কেন শুধু শুধু জানতে চাচ্ছো? তুমি তো সব জানো।
: এখন তুমি দেখছো ১৭৫৭ সালের ঢাকা।
: তাই তো বলি, এত নির্মল বায়ু, স্বচ্ছ পানি আর সুনীল আকাশ।
: তোমাদের এ যুগের মতো সেই সময়ে এত কলকারখানা ছিল না। মানুষ নদীর পাড় দখল করতো না। পানিকে নোংরা করতো না।
: তা এখন আমরা যাচ্ছি কোথায়?
: জিঞ্জিরা প্রাসাদে।
নাবিলের কানে মিষ্টি বেহালার মিষ্টি সুর ভেসে আসে। খুব দূরে নয় ঝলমলে প্রাসাদটা। ঐ প্রাসাদ থেকেই আসলে সুরের লহরী। প্রাসাদের বিশাল সিংহ দরজায় চার/পাঁচজন সিপাহি পাহারা দিচ্ছেন। নাবিলকে দেখে তারা সালাম দিয়ে দরজা খুলে দিলো। নাবিল ভিতরে প্রবেশ করতেই দু’জন সিপাহি এসে তাকে সাদরে ভিতরে নিয়ে যায়।
: আসসালামু আলাইকুম, কেমন আছো মহাকাল ভ্রমণকারী নাবিল জামান। একজন রাজপুরুষ নাবিলের দিকে হাত বাড়িয়ে দেন।
: আপনি আমাকে চেনেন, তোমাকে চিনবো না, তুমি এত সময়ের পথ পাড়ি দিয়ে আমাদের কাছে এসেছো, শিকড়সন্ধান করতে।
: আমি তো আপনাকে চিনলাম না।
: আমি মোগল সুবাদার ইবরাহিম খান।
: ‘এই প্রাসাদের বাসিন্দা এবং এই অঞ্চলের সুবাদার। চলো বিদেশি মেহমানদের সম্মানে জলসা চলছে। আজ তুমি আমাদের সম্মানীত মেহমান।’ ইবরাহিম সাথে সাথে নাবিল জলসায় প্রবেশ করে। গজলের আসর চলছে। বেশ কয়েকজন বিদেশি মেহমান। গজল শুনছে।
: ওনারা কারা?
: সাত সাগর তের নদীর পার হয়ে ইউরোপ থেকে আসা মেহমান। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বণিক।
: দিল্লি স¤্রাট ফররুখ সীয়ার তাদেরকে একটি ফরমান ও দুটি হুকুমনামা দিয়ে এই সুবে বাংলায় ব্যবসা-বাণিজ্য করার বিশেষ সুবিধা ও সনদ লাভ করেছে। তারা এখন আমাদের সুবে বাংলার মেহমান। তাদের খাতির যতœ না করলে বদনাম হবে। তাই তাদের সম্মানে এখানে মাঝে মাঝে জলসার আয়োজন করি। তারাও এর বিনিময়ে তাদের ব্যবসার লাভের কিছু অংশ আমাদের জন্য খরচ করেন।
: বিদেশিদেরকে এত বেশি গুরুত্ব দেয়া কি ঠিক। এরা তো এভাবে বিভিন্ন দেশে বাণিজ্য করার অনুমতি নিয়ে পরে দেশটাই দখল করছে।
: এটা মোগল সা¤্রাজ্য এর দিকে হাত বাড়ানোর সাহস বণিকরা দূরের কথা, স্বয়ং মহারানী এলিজাবেথও পাবেন না। আর তুমি তো জান স¤্রাট ইংরেজদের ব্যবসা-বাণিজ্যের সুবিধার জন্য কলকাতার আশপাশে ৩৮ গ্রাম কেনার অনুমতি দিয়েছেন।

: তুমি মহাকাল ভ্রমণকারী তুমি তো জানবেই, তা কী সেই ইতিহাস
: আপনাদের স¤্রাটের এই লোভের খেসারত এই বাংলা শুধু নয় গোট ভারতবর্ষকে দিতে হয়েছে ২ হাজার বছর ধরে।
: স¤্রাটের কি দোষ। দেশে দেশে বাণিজ্য সম্পর্ক করা কি অপরাধ।
: না, তা অপরাধ নয়, তাই বলে নিজ দেশের জমি নয় দেশের কোন কোম্পানির কাছে বিক্রির অধিকার কোন স¤্রাটের নেই।
: স¤্রাট মানে তোমাদের যুগের গণতান্ত্রিকভাবে কয়েক দিনের জন্য নির্বাচতি কোনো প্রধানমন্ত্রী, প্রেসিডেন্ট বা সরকারপ্রধান নন, তিনি সব কিছুর মালিক।
: ভুলটা তো আপনাদের ওখানে। কোনো মানুষ কোনো মানুষের বা জমিনের মালিক হতে পারেন না। আসমান জমিনের মালিক সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তায়লা। রাজা, বাদশাহ, প্রধানমন্ত্রী, প্রেসিডেন্টরা তাঁর প্রতিনিধি মাত্র। তারা মালিক নন তার শাসিত অঞ্চলের জনগণের খাদেম মাত্র। এক খাদেম জমিন বিক্রির বিক্রির ক্ষমতা পায় কোথায়?
: তুমি তো খুব কঠিন কঠিন কথা বলছো, এত ছোট বয়সে এত কিছু জানো কীভাবে?
: মানুষ হিসেবে একজন মানুষের কাজ কী। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলে দিয়েছেন। রাসূল সা. এর হাদীস আছে। আছে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও দার্শনিকদের গবেষণা এ সবের সাথে ইতিহাসের শিক্ষাকে মিলিয়ে দেখলে এই সত্য যে কেউ বুঝতে পারবে।
: আচ্ছা তুমি যে বললে এই ভুলের খেসারত তোমাদের দু’শত বছর দিতে হয়েছে।
: আপনি তো জানেন, ১৬০০ সালে ২১৮ জন ইংরেজ বণিক নিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি গঠন করেন।
: হ্যাঁ, ওদের কাছ থেকে জেনেছি। ব্রিটেনের রানি এলিজাবেথের নিকট থেকে ১৫ বছরের সনদ নিয়ে ওরা ভারতে বাণিজ্য করতে এসেছে।
: মাত্র পনেরো বছরের জন্য এলে ওদের জমি কেনার দরকার কি?
: ওরা পরে মেয়াদ বাড়িয়ে নিবে।
: কারণ
: এই দেশে ওদের ভালো লাগে। এখানে ব্যবসা-বাণিজ্য করে ওরা লাভবান হচ্ছে।
: এই লাভই পরে লোভে পরিণত হয়।
: বুঝলাম না।
: এই কথা বুঝতে একটু পিছনের ইতিহাস জানতে হবে।
: এই ভারতবর্ষের প্রতি ওদের লোভ এক দিনে সৃষ্টি হয়নি।
: আপনি তো জানেন, ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দে ভারতবর্ষে বাণিজ্যকুটি বানানোর জন্য ক্যাপ্টেন হকিন্স ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম জেমসের একটি সুপারিশ পত্র নিয়ে সম্রাট জাহাঙ্গীরের সাথে দেখা করেছিলেন। কিন্তু সেই সময় ভারতবর্ষের ব্যবসায়ী ও পর্তুগিজদের বিরোধিতার কারণে ক্যাপ্টেন হকিন্স ব্যর্থ হন। কুঠির নির্মাণ না করেই ব্যবসা চালিয়ে যান। এ নিয়ে পর্তুগিজদের সাথে ইংরেজদের বিরোধ চলতে থাকে। এক পক্ষ অন্য পক্ষের বিরুদ্ধে স¤্রাটের কান ভারি করতে থাকে।
বিরোধ চরম আকার ধারণ করলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ক্যাপ্টেন বেস্টের নেতৃত্বে পর্তুগিজ নৌবহরের ওপর হামলা করে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এই হামলা গোটা পর্তুগিজ বাণিজ্যবহর ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ইংরেজরা সুরাট বন্দরে অবস্থান করে। ক্যাপ্টেন বেস্ট স¤্রাট জাহাঙ্গীরকে বোঝাতে সক্ষম হন পর্তুগিজরা তার সা¤্রাজ্যের জন্য হুমকি। অন্যকে ইংরেজরা তার ভালো চায়। মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীর ১৬১৩ সালে এক ফরমান দ্বারা সুরাটে ইংরেজদের বাণিজ্য কুঠি নির্মাণের অনুমতি প্রদান করেন। ১৬৫১ সালে বঙ্গদেশের সুবেদার শাহ সুজা বাৎসরিক তিন হাজার টাকা শুল্ক প্রদানের বিনিময়ে ইংরেজদের এদেশে অবাধ বাণিজ্য করার সুযোগ প্রদান করেন। ১৬৭২ সালে আওরঙ্গজেব নিযুক্ত বাংলার গভর্নর শায়েস্তা খান ইংরেজদের বিনা শুল্কে বাণিজ্য করার অনুমতি প্রদান করেন।
: মোগলরা ইংরেজদের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক উন্নয়ন ছাড়া অন্য কোনো কিছু করেননি। তুমি কি জান দিল্লি স¤্রাট ফররুখ সীয়ারের অনেক আগে ১৬৩৯ সালে ফ্রান্সিসড নামে জনৈক ইংরেজ চন্দ্রগীরি নামক ক্ষুদ্র রাজ্যের রাজার নিকট হতে করমন্ডল উপকূলে কিছু জমি নিয়ে মাদ্রাজ শহরের গোড়াপত্তন করেন। এখানে একটি বাণিজ্য কেন্দ্র ও সেন্ট জর্জ দুর্গ স্থাপন করেন। এর অনেক পরে ১৬৯০ সালে জন চাইল্ড ভাগীরথী নদীর তীরে কালিকট, সুতানটি ও গোবিন্দপুর নামে তিনটি গ্রাম খরিদ করে কলকাতা নগরী প্রতিষ্ঠা করেন।
: জানি তবে ঐতিহাসিকদের কারণে হিন্দু রাজা চন্দ্রগিরির এ ঘটনার চেয়ে দিল্লি স¤্রাট ফররুখ সীয়ারের কাহিনীই বেশি বেশি প্রচার হয়েছে।
আমি আরো জানি গোল্কুন্ডার প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্র মসলিপ্ট্রম, পুলিকটোর নিকটবর্তী আমারগর, হরিহরপুর, কাশিম বাজার, পাটনা, ঢাকা, রাজমহল ও মালদাহ প্রভৃতি স্থানে বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করেছিল। সপ্তদশ শতকের দিকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বণিকরা তাদের আসল রূপ দেখায়। তারা শান্তির নীতি পরিত্যাগ করে যুদ্ধনীতি গ্রহণ করে। ১৬৬৮ সালে তারা ব্রিটিশ সরকারের এর নিকট থেকে বাণিজ্যিক স্বার্থ রক্ষার প্রয়োজনে মোগলদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণের অনুমতি লাভ করে। এই অনুমতি লাভের পরই বাংলাদেশসহ ভারতবর্ষের বিভিন্ন এলাকায় কোম্পানির বণিকরূপী দস্যুদের সাথে এ অঞ্চলের ব্যবসায়ী ও আঞ্চলিক শাসকদের সাথে সংঘর্ষ বাধে। ইংরেজদের এই রাষ্ট্রদ্রোহী কার্যকলাপের কারণে মোগল স¤্রাট আওরঙ্গজেব মুম্বাই আক্রমণের নির্দেশ দেন। জন চাইল্ড পরাজিত হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। কোম্পানি ক্ষতিপূরণ স্বরূপ দেড় লক্ষ টাকা এবং তাদের অধিকৃত অঞ্চলগুলো সম্রাটকে ফেরত দিয়ে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। কিন্তু গোপনে গোপনে তারা তাদের তৎপরতা ঠিকই চারাতে থাকে।
১৭০০ সালে কলকাতায় ফোর্ড উইলিয়াম নামে একটি সুরক্ষিত দুর্গ নির্মাণ করে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কেন্দ্র কলকাতা হতে কোম্পানি স্থানীয় সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করে। ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে বাংলা-বিহার উড়িষ্যা অঞ্চলের সরকারি কর্মকর্তা ও ধনিকশ্রেণির সাথে সখ্য গড়ে তুলে নিজেদের শক্তি বাড়াতে থকে। তাদের এ সকল কার্যকলাপ দেখে বাংলার দিওয়ান মুশিদকুলী খানের সাথে তাদের বিরোধ শুরু হয়। মুর্শিদকুলী খানের পর আলীবর্দী খানের সাথে ইংরেজদের বিরোধ বাধে। তিনি ইংরেজদের অবাধ বাণিজ্য ও দুর্গ নির্মাণের ঘোর বিরোধিতা ছিলেন। পরে এক সন্ধিচুক্তির মাধ্যমে তিনি ইংরেজদের দমিয়ে রাখতে পেরেছিলেন। এর পরের পলাশীর প্রান্তরে যুদ্ধ যুদ্ধ প্রতারণার মাধ্যমে তরুণ দেশপ্রেমিক নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়, গ্রেপ্তার আর শাহাদাতের করুণ কাহিনী তো কারো অজানা নয়।
: ‘আমাকে কি তুমি সন্দেহ করছো?’ ইবরাহিম নাবিলের কাছে জানতে চায়।
: না, তবে আপনার মতো সম্ভ্রান্ত লোকদের এমন খাতির যতœ ওদের সাহস বাড়িয়ে দিচ্ছে। এতে কোনো সন্দেহ নেই। আর আপনাদের ব্যবহার করেই ওরা দেশের নিরীহ ব্যবসায়ী ও সাধারণ লোকদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতনের সাহস দেখায়। আপনাদের মতো জিঞ্জিরা প্রাসাদের মালিকরা সতর্ক থাকলে কোনো পরাশক্তিই আমাদের পরাধীনতার জিঞ্জির পরানোর সাহস দেখাবে না। সিরাজউদ্দৌলারা তেজী ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে নাঙা তলোয়ার হাতে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা করবে যুগ যুগ ধরে। বুকের রক্ত ঢেলে শহীদ হবে। তবু মাথা নত করবে না
: ‘আজ তাহলে আসি।’ নাবিল বিদায়
: আল্লাহ হাফেজ। আবার আসবে।


মসজিদে ফজরের আজান হচ্ছে। খোলা জানালার পাশে একটি পাখি ডাকছে। ভোরের মিষ্টি হাওয়া এসে লাগছে নাবিলের চোখেমুখে। নাবিল তার টাইমমেশিন ঘোড়াটাকে বলে সামনের মসজিদে কাছে তাকে নামিয়ে দিতে।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com